Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

শৃঙ্খলা রক্ষায় হার্ডলাইনে আ.লীগ

রফিকুল ইসলাম

নভেম্বর ২০, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


শৃঙ্খলা রক্ষায় হার্ডলাইনে আ.লীগ

দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগ। ভবিষ্যতে দল বা সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেনো কোনোভাবেই দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হয়— এ জন্য মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন দল। 

দলের নেতারা বলছেন, জাহাঙ্গীরের মতো আর কেউ যেনো জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি করার সাহস না দেখায়। দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দলীয় ঐক্য ঠিক রাখতে শৃঙ্খলাবিরোধীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। একই সাথে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ওই নৌকাবিরোধীদের ছাড় দেয়ার প্রশ্নই আসে না বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা। 

সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক। অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে দলীয় সভানেত্রীর কাছে তৃণমূলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা। তাদের সাংগঠনিক রিপোর্টে উঠে আসে তৃণমূলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কোন্দল ও বিভাজন-বিভক্তির রাজনৈতিক চিত্র। বিশেষ করে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিভিন্ন জেলার প্রভাবশালী নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদত দেয়ার অভিযোগ উঠে আসে। 

এছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তির বিষয়টি দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বেশি গুরুত্ব পায়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন উপস্থিত নেতারা। 

তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করে জাহাঙ্গীর চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। সে আমাদের হূৎপিণ্ডে আঘাত দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যাতে আর কেউ জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি করার সাহস না দেখায়। এরা নীতি ও আদর্শহীন। এদের এখনই কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এরপর গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করেন দলটির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আ.লীগ সূত্রে জানা যায়, তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কলহ নিরসন ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, দল বা সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তিসহ দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কাজ করলেই তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়া হবে। কোন্দল মিটিয়ে সংগঠনকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী রাখাই তাদের মূল চ্যালেঞ্জ বলে জানান। 

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করায় মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটি দলীয় সিদ্ধান্ত। এ ধরনের কটূক্তি বা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। দল ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিটি ইউনিটির নেতাকর্মীরা  আগামীতে কেউ যেনো এ ধরনের কর্মকাণ্ড না করে। তাদের জন্য আমাদের এটি কঠোর বার্তা।’

বিএনপিবিহীন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে ব্যাপক অস্বস্তিতে রয়েছে আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনে ভোটের মাঠে দুই শতাধিক স্থানে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। সেই বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে দেখছেন ক্ষমতাসীন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। মূলত বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদত দিচ্ছেন স্থানীয় জেলা-উপজেলার প্রভাবশালী নেতা ও স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা। সাংসদ ও প্রভাবশালীদের নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তিনি বিদ্রোহীদের মদতদাতাদের চিহ্নিত করার জন্য বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের দায়িত্ব দিয়েছেন। স্থানীয় নেতা, এমপি-মন্ত্রীর কার কী ভূমিকা তা লিখিত আকারে জমা দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘যে সব এমপি-মন্ত্রী বা দলের প্রভাবশালী নেতা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষায় নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। এ জন্য কাজ শুরু হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেবেন তার বিজয় নিশ্চিত করতে দলের সব ইউনিটির নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি বিরোধিতা করে সে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাকে ছাড় দেয়া হবে না।’

আমৃত্যু আ.লীগের সমর্থক থাকতে জাহাঙ্গীরের আকুতি: গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘আমি কোনো ভুল করিনি, তবুও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা মাথা পেতে নেবো।’ গতকাল সকালে ছয়দানা এলাকায় তার নিজ বাড়িতে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। 

মেয়র জাহাঙ্গীর আলম তার আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি, অপরাধ করিনি। আমি এ সাধারণ সম্পাদক পদ চাই না, বাকি জীবন আওয়ামী লীগের সাধারণ সদস্য ও সমর্থক হয়ে থাকতে চাই।’ এসময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লে উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মীরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে সেখানে এক হূদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। 

মেয়র অভিযোগ করে বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি করার সময় থেকে একটি প্রতিপক্ষ নানাভাবে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমার ঘরের ভেতরে বসে তিন ঘণ্টার আলাপচারিতাকে খণ্ড খণ্ড করে জোড়া দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।’

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় কেঁদে ফেলেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, দলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করবেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা আমার সম্পর্কে ভুলভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেছে। আমি যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি আমার ওই অডিও-ভিডিওর বিষয়ে কথা বলতে পারতাম, তবে প্রধানমন্ত্রী সব কিছু বুঝতে পারতেন। তখন তিনি হয়তো আমার ব্যাপারে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন না। 

এসময় তিনি আবারো দাবি করেন, তার বক্তব্য কাটছাঁট করে বিকৃতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া হয়েছে। বক্তব্যে একটি অংশ সুপার এডিট করে তার ভিডিও এবং অডিও করে ইন্টারনেটে ভাইরাল করা হয়েছে। জাহাঙ্গীর বলেন, আমাকে বহিষ্কার করে আমার, আমার পরিবারের এবং আমার অস্তিত্বের মধ্যে যে আঘাত দেয়া হয়েছে, সেটা আমি মানসিকভাবে মেনে নিতে পারছি না। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আমি কোনো পাপ ও অন্যায়ের সাথে জড়িত নই।’ 

তিনি বলেন, ‘আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেই আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের সাথে আছি। আমার অস্তিত্বের মধ্যে সব জায়গায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর আদর্শ স্থান। বঙ্গবন্ধুর জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্য যদি আমাকে জীবন দিতে হয়,  আমি দেবো।  আমার অনুরোধ আমাকে যেনো  মিথ্যা কিছুর মধ্যে জড়িত না করা হয়। মিথ্যা অপবাদ যেনো না দেয়া হয়।’ 

জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মেয়র হিসেবে তিন বছর আমি কোথাও চিফ গেস্ট হতে চাইনি। আমি রাস্তার ধারে ধারে ঘুরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহযোগিতায় মানুষের জন্য কাজ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আকুল আবেদন করব গাজীপুরবাসী এবং আমার জন্য।’ 

সংবাদ সম্মেলনে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের সাথে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনিরুজ্জামানসহ কয়েকজন কাউন্সিলর ছিলেন। তবে জেলা বা মহানগর আওয়ামী লীগের বড় কোনো নেতাকে সেখানে দেখা যায়নি।