Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

আন্দোলনে সমর্থন শীর্ষ ছাত্রসংগঠনের

রেদওয়ানুল হক

নভেম্বর ২৫, ২০২১, ০৭:২০ পিএম


আন্দোলনে সমর্থন শীর্ষ ছাত্রসংগঠনের

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এরপর থেকেই হাফ ভাড়ার ইস্যুতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন করছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এজন্য সরকারের তরফ থেকে প্রজ্ঞাপন দাবি করে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হাফ ভাড়া কার্যকরের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। 

গত মঙ্গলবার তাদের আন্দোলনে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া সমপ্রতি অর্ধেক ভাড়া (হাফ পাশ) নিয়ে ঢাকায় বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ঠিকানা বাসে হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেয় চালকের সহকারী। পরে ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে গাড়িচালকের ওই সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রাজধানীর ইম্পেরিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী হাফ পাশ দিতে চাওয়ায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় রাইদা পরিবহনের এক চেকার। ১৫ নভেম্বরের সেই ঘটনায় ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। আটকে দেন রাইদা পরিবহনের ৫০টি বাস। সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। 

এরপর হাফ পাশের অঙ্গীকার মেলার পরই বাস ও সড়ক ছাড়েন তারা। মঙ্গলবার সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হাফ পাশের দাবিতে বাস আটকিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ ইতিহাস পরিবহনে এক ছাত্রী হাফ ভাড়া দিতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এরপর বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইম নিহত হলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। একই সাথে শুরু হয় নিরাপদ সড়ক ও হাফ পাশের আন্দোলন। 

গতকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে রাজধানীর রাজপথ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে রাজধানীর গুলিস্তান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, শান্তিনগর, উত্তরা ও ফার্মগেটসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন। এ সময় ব্যস্ত সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। হাফ ভাড়ার বিষয়ে সরকারি ঘোষণা ও প্রজ্ঞাপন জারির দাবি আদায়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন তারা।

হাফ পাশের এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বড় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো কর্মসূচি নেই। অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দিচ্ছে ছাত্রলীগ। তবে দলীয় কর্মসূচি না থাকলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন শীর্ষ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা। দৈনিক আমার সংবাদের সাথে আলাপকালে গতকাল তারা এ সমর্থনের কথা জানান।  

ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি ছাত্রলীগের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। হাফ পাশের নিয়ম শুধু বাংলাদেশে নয় বরং সারা পৃথিবীতেই চালু আছে। তাই ছাত্রলীগ চায় হাফ পাশের একটি সুষ্ঠু সমাধান হোক। 

এসময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেয়ার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের সকল ইউনিটের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করছে। ছাত্রলীগ আলাদা কর্মসূচি দিবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, ‘সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে আমাদের মৌন সমর্থন রয়েছে। সরকার যাতে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে তাই আপাতত আমাদের কর্মীরা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে না। মেডামের (খালেদা জিয়ার) অসুস্থতার জন্য ছাত্রদল কর্মসূচি বন্ধ রেখেছে। তবে শিগগিরই এ বিষয়ে আমরা কর্মসূচির ঘোষণা দেবো’ 

ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাউদ্দিন আইয়ুবী বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে সম্পূর্ণ একমত। ইতোমধ্যে এ দাবির সাথে সমর্থন জানিয়ে আমরা গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের আরও কিছু মৌলিক দাবিতে সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শিগগিরই একটি যৌথ বিবৃতি দেয়া হবে। 

শুধু বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি রাজপথে আন্দোলন দেয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিগগিরই আমরা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামবো। কিন্তু শিবির কর্মসূচি দিলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করে সরকার বলে অভিযোগ করেন তিনি। 

তিনি বলেন, আমরা আশা করছি সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেবে অন্যথায় আমরা রাজপথে নামবো। এ বিষয়ে একই কথা বলেছেন চরমোনাই পীরের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি নুরুল করীম আকরাম। 

তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে সম্পূর্ণ একমত কিন্তু শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিতে রাজনৈতিক তকমা দেয়া হতে পারে তাই আমরা কর্মসূচি দিচ্ছি না। তবে শিগগিরই এ বিষয়ে কর্মসূচি নিয়ে আমরা মাঠে নামবো। 

ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি অনিক রায় বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি আমাদের সমর্থন আছে। সরকারের উচিত প্রজ্ঞাপন দিয়ে হাফ পাশের বিষয়টি সমাধান করা। এ ইস্যুতে আমরা ইতোমধ্যে আন্দোলন করছি এবং আগামী ২৯ নভেম্বর শাহবাগে আমাদের একটি কর্মসূচি আছে। 

শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার সমালোচনা করে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একাত্মতা জানিয়ে ইতোমধ্যে আমরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ এবং মশাল মিছিল করেছি। সরকার যদি ন্যায্য দাবি মেনে না নেয় তাহলে অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে ছাত্র অধিকার পরিষদ।

এদিকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, শাহবাগ, মতিঝিল এবং পল্টন এলাকায় দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট জানান, হাফ ভাড়ার বিষয়ে সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন নেই। এছাড়া ট্রাফিক আইনে কোনো নির্দেশনা না থাকা এবং অফিস আদেশ না থাকার কারণে এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না। প্রায়ই শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেন কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের করার কিছু নেই। মূলত দেশের গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া দেয়ার কোনো নীতিমালা কখনো ছিলো না। 

তবে বিভিন্ন স্থানে নিয়ম করেই পরিবহনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেয়া হয়ে থাকে। রাজধানীতেও কিছু পরিবহন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিত। করোনার পর থেকে কোনো বাসেই হাফ ভাড়া নেয়া হয় না।

৬৯-এর আন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির মধ্যে ছিলো বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার ইত্যাদিতে শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়া দেবেন। গণঅভ্যুত্থানে এই দাবি মেনেও নিয়েছিলেন তৎকালীন সরকার। অলিখিতভাবে এই নিয়ম  মেনে আসছিল কিছু কিছু পরিবহন। ঢাকায় সিটিং সার্ভিসের নামে যেসব বাস চলে তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেয় না। এসব বাসে গায়ে ‘হাফ পাস নেই’ বলে নির্দেশনাও লেখা থাকে।

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। স্মরণকালের বৃহৎ এই আন্দোলনে টনক নড়েছিল সব পক্ষের। এই আন্দোলনের পর সড়ক আইন হলেও শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রধান দাবি ‘হাফ পাশ’টি উপেক্ষিতই থেকে যায়। 

অন্যদিকে অর্ধেক ভাড়া নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটা সমাধানের পথ দেখিয়েছে। সদরঘাট পর্যন্ত যাতায়াত করে এমন বাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে অর্ধেক ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। পরিবহন মালিক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৈঠক করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।

এছাড়া সম্প্রতি ঢাকা কলেজে কয়েক দফা বৈঠকে কয়েকটি বাসের হাফ ভাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তবে সরকার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলে বিষয়টির স্থায়ী সমাধান হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া কার্যকরে আদালতে রিট আবেদন করা হয়েছে। শনিবার (২৭ নভেম্বর) রিটের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।