Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বিদেশ পাঠাতে ভাবছে সরকার

নভেম্বর ২৬, ২০২১, ০৬:৫০ পিএম


বিদেশ পাঠাতে ভাবছে সরকার

ভালো নেই খালেদা জিয়া। পারছেন না মুখে কিছু খেতে। স্যালাইনেই বেঁচে আছেন। পারছেন না নড়াচড়া করতেও। ধীরে ধীরে, ইশারায় মাঝে মধ্যে শব্দ করার চেষ্টা করছেন। হয়েছে রক্তবমি। গত ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে হিমোগ্লোবিন কমে যায়। সেই থেকে উন্নতি নেই। অবনতির কথাই বলছেন চিকিৎসকরা। তার শারীরিক জটিলতাগুলো শুধু বাড়ছেই।লিভার ও কিডনি পরিস্থিতিতি নিয়ে পেরেশানিতে চিকিৎসকরা। এখন শেষ ভরসা বিদেশের হাসপাতালে ‘অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট’। অন্যথায় নতুন জীবনে ফেরা নিয়ে অন্য কোনো পথ দেখছেন না চিকিৎসকরা। এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নিয়ে দেশে বড় একটা জনমত তৈরি হয়েছে। 

দেশের সব অঙ্গন থেকেই বিদেশ পাঠানোর সুযোগ দিতে দাবি উঠেছে। বিএনপিও কর্মসূচি ঘোষণা করে মাঠে রয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে সরকারের মধ্যেও। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতারাও খালেদা বিষয়ে মুখ খুলছেন। গত মঙ্গলবার রাতে খালেদা জিয়ার মৃত্যু গুজবের পর সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়। এখন শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী নজরে রয়েছে বলেও মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। 

নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভাষ্য, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতিতে সরকারও চিন্তিত। বিদেশ পাঠাতে নমনীয়তার ইঙ্গিত। খালেদা জিয়ার দুর্ঘটনার দায় গ্রহণ করতে চাইবে না আওয়ামী লীগ। এ জন্য ভাবা হচ্ছে এবং সব দিক বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে হলে কী আইনি প্রক্রিয়া আছে তা খতিয়ে দেখতে আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। 

আইন মন্ত্রণালয় থেকে পরামর্শ পেলে এবং খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে চিকিৎসকদের মতামত পেলে এ বিষয়ে নমনীয় হতে পারে সরকার। বিদেশ যেতে দেয়া হবে না কোনো বাধা। প্রধানমন্ত্রীও শেষ সময়ে মানবিকতার উদাহরণ রাখতে চান। দেশ-বিদেশের পরিস্থিতি আগ থেকেই আঁচ করার চেষ্টা করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। খালেদা জিয়ার পুরো বিষয়টি সরকার গভীর গুরুত্বের সাথে দেখছে। যদি মারাত্মক অবনতির দিকে যায় তাহলে সরকার শেষ সময়ে ছাড় দেবে। বিদেশ যেতে এমনই মত আওয়ামী ঘরের নীতিনির্ধারকদের। খালেদা জিয়ার চলমান অবস্থা ও সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ নজর রেখেছে। আইনজীবী ও চিকিৎসকের সাথে সরকার সব ধরনের পরিস্থিতির খবর রাখছে। আইনি ও সম্ভাব্য পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে ভাবছে বলেই মত একাধিক সূত্রের। 

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন’ বলে জানিয়েছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মেয়ে মাহমুদা খানম ভাসানী। গতকাল শুক্রবার সকালে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে নিচে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান তিনি। মাহমুদা খানম ভাসানী বলেন, ‘বেগম জিয়া কথা বলতে পারছেন, তবে খুব ধীরে ধীরে। তিনি খুবই দুর্বল। তার সাথে কথা বলার সময় তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে বিদেশে পাঠিয়ে সুচিকিৎসার সুযোগ দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানাই আমরা।’ আমরা বেগম জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলাম। তার চিকিৎসকরা বলেছেন, বেগম জিয়ার অবস্থা খারাপ। তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা সুযোগ দিতে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি জানাই।’

এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, নজরুল ইসলাম খান, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, আমানউল্লাহ আমান, আব্দুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমান, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা, এলডিপির একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রমুখ।

খালেদা জিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘ফাঁসির আসামিকেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এটি সরকারের দায়িত্ব। ফাঁসি দেয়ার আগ মুহূর্তে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। দেশের একজন সাধারণ মানুষেরও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। কারণ, রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে চিকিৎসা একটি। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ আছে— যেখানে চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাতে হয়! বিচার তখনই চাওয়া যায়, যখন ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এখন বাংলাদেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুটি এক হয়ে গেছে। এখন শেখ হাসিনা এমন অবস্থায় গেছেন, তার কথাই শেষ কথা। তার কথাই আইন, তার কথাই সংবিধান।’

খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না দিলে সরকারকে অবশ্যই ‘গণআন্দোলন’-এর মুখোমুখি হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হোক, তাকে মুক্তি দেয়া হোক। তা না হলে এই সরকারের পতনের আন্দোলনের সামনে তাদেরকে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।’

এ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সেই হিসেবে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করে দিলেই তো তিনি বিদেশে যেতে পারেন।’ একটি অভিযোগের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও তদারকির কাজ বিএনপির লোকেরাই করছে, স্লো পয়জনিং যদি করে থাকে তাহলে পাশের লোকেরাই করতে পারে। এর দায়ও তাদেরই।’ 

বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে— গত বৃহস্পতিবার যুবদলের এক কর্মসূচিতে মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার এই বক্তব্যের জবাবে কাদের বলেন, ‘ফখরুল সাহেব বলেছেন, বেগম জিয়াকে নাকি স্লো পয়জনিং করা হচ্ছে।’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। দণ্ডপ্রাপ্ত ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে বেগম জিয়া আজ যে সুবিধা গ্রহণ করছেন, এটা প্রধানমন্ত্রীর উদারতার কারণে। বেগম জিয়াকে আপনারা মাইনাস করার জন্য স্লো পয়জনিং করছেন কি-না, সে রকম কিছু করবেন বলেই কী উদুর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে আওয়ামী লীগের ওপর, শেখ হাসিনার ওপর দোষ চাপিয়ে যাচ্ছেন।’ 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, ‘খালেদা জিয়া একজন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও একজন নারী। তার শারীরিক যে অবস্থা বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে— তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এখন আবশ্যক। যদিও তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত, এটি অবশ্যই মাবতার ঊর্ধ্বে নয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটি অবশ্যই সমাধানযোগ্য। রাজপথে আন্দোলন করে এর সমাধান করা যাবে না। আমি দেশের একজন নাগরিক হিসেবে চাইবো সরকার অবশ্যই রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে। কারণ, আমি জানি না খালেদা জিয়ার কোনো অঘটন ঘটে গেলে সরকার এটি ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে দায় এড়াতে পারবেন কি-না। 

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে সচল রাখতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এর চেয়ে বেশি কিছু করার মতো সমন্বিত মাল্টি ফ্যাসিলিটেড চিকিৎসাকেন্দ্র বাংলাদেশে নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা প্রতিনিয়ত তাকে পর্যবেক্ষণ করছি। সামনের কয়েকটি দিন তার জন্য খুব ক্রিটিক্যাল।