Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

বকশিশ ছাড়া নথি নড়ে না

নভেম্বর ২৮, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম


বকশিশ ছাড়া নথি নড়ে না
  • পিয়ন, পেশকার, পুলিশকে বকশিশ না দিলে মেলে না সেবা 
  • বকশিশবাণিজ্য ঠেকানোর কার্যকরী উদ্যোগ নেই
  • আদালতসংশ্লিষ্টদের নীরবতার সুযোগ নিচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
  • আদালত-পুলিশ ও কর্মচারীদের কাছে জিম্মি আইনজীবীরাও
  • বকশিশ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা চান বিচারপ্রার্থীরা

থানায় মামলা হওয়ার পরই এজাহার পাঠিয়ে দেয়া হয় আদালতে। আসামি গ্রেপ্তার হলে পুলিশ প্রতিবেদনসহ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। শুরু হয় আইনি লড়াই। এখানে থেকে শুরু হয় ঘাটে ঘাটে টাকা দেয়ার খেলাও। চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। মূলত মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেয়া, ওকালতনামায় সই করা, জামিননামা দেয়া, মামলা লিস্টে আনা, শুনানির সিরিয়াল এগিয়ে আনা, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলাসংক্রান্ত যেকোনো সেবায়  বকশিশ বা খরচাপাতি ছাড়া এখন চলেই না।

বকশিশের পরিমাণ কখনো ১০০ টাকা, আবার  কখনো দুই হাজারও ছাড়িয়ে যায়। এতে নিন্ম আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীরা পদে পদে চরম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। যেনো দেখার নেউ নেই। যুগের পর যুগ বকশিশ বাণিজ্যে আটকে আছেন বিচারপ্রার্থীরা। বকশিশ ছাড়া মেলে না সেবা। মামলার ফাইলও নড়ে না। ফলে বাধ্য হয়েও গুনতে হচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। 

এতে অতিরিক্ত মামলা ব্যয়ে নিঃস্ব অনেকে। কেউ কেউ মামলা চালাতে গিয়ে বিক্রি করছেন জমি-জিরাতও। তবুও সহসা নিস্তার মিলছে না খরচাপাতি বাণিজ্য থেকে। তবে বিচারপ্রার্থীরা নিঃস্ব হলেও অর্থ-বিত্তে ফুলে-ফেঁপে উঠছে আদালতকেন্দ্রিক পেশাজীবী শ্রেণি। কেউ কেউ গড়ছেন আলিশান অট্টালিকাও। আইন আদালতের বিষয়ে বহুকাল থেকে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে— ‘আদালতের ইটেও ঘুষ খায়’। বাস্তবেও তার ব্যতিক্রম নয়। 

আদালতে এলেই ঘাটে ঘাটে দিতে হয় বকশিশ। অধিকাংশ সময় আইনজীবীরা এসব বকশিশ বা খরচাপাতি নেন সহকারীদের মাধ্যমে। তবে এত সবের পরও আদালতকেন্দ্রীক দুর্নীতি ঠেকানোর কোনো কার্যকরী উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি কখনোই। এ বিষয়ে নেই কোনো নজরদারিও। সংশ্লিষ্ট সবার সামনেই ঘটছে এসব খরচাপাতি বাণিজ্য। এদিকে আদালতে এসব বকশিশ বা খরচাপাতির ব্যবস্থা চরম দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ নীরবতার সুযোগ নিয়ে উৎসাহিত হয় আদালতের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিন্ম আদালতে অনিয়মের চিহ্নিত স্থানগুলো হলো— ফাইলিং শাখা, সেরেস্তা, জিআর শাখা, আদালতের পেশকার, উমেদার, মামলার জিআরও, আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর, বিচারকদের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডেসপাস শাখা। এসব জায়গায় বেশির ভাগ কর্মচারী অনিয়মের সাথে জড়িত। টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগতিতে। তাই আদালতাঙ্গনে অনিয়মের এই টাকা দেয়াকে বলা হয় খরচাপাতি। তবে বকশিশ ও খরচাপাতিকে আদালতের 
উকিল, মুহুরি, পিয়ন, পেশকার ও পুলিশ কেউই এটাকে ‘ঘুষ’ বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য— নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করতে ‘বকশিশ’ দিতে হয় অনেককে।

সরেজমিন দেখা যায়, ওকালতনামায় আসামিপক্ষ থেকে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা, জামিন শুনানির পুটআপ নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী, পিয়ন, উমেদারদের ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া রিলিজ অর্ডার বা মুক্তিনামা কারাগারে পাঠানোর আগে জামিননামা যাচাই করতে পুলিশের জিআর শাখায় দিতে হয় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা। কারাগার থেকে বের হতে দ্রুত রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠাতে দুই হাজার টাকা। আসামির জামিন হওয়ার পর প্রতি মাসে দু-একবার বা আদালতের নির্ধারিত তারিখে আসামিকে হাজির হতে হয়। প্রতি হাজিরা দিতে জিআর শাখায় সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি দিতে হয়। আদালতে আসামিকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হলে তার সাথে পিয়ন পেশকার আরো দুইশ টাকা সংযুক্ত করে আদায় করেন। নিজ বসতবাড়ি নিয়ে প্রতিবেশীর সাথে বিরোধে জড়িয়েছিলেন মাদারীপুরের আলাউদ্দিন। বেদখল হওয়া জমি ফিরে পেতে মাদারীপুর সহকারী জেলা জজ আদালতের শরণাপন্ন হন। বাপ-দাদার বসতভিটা উদ্ধার করতে শুরু হয় আইনি লড়াই। 

১৯৮৮ সাল থেকে নিম্ন আদালতে ১০ বছর মামলা চালিয়ে অবশেষে হেরে যান আলাউদ্দিন। তবে ১০ বছরে আদালতে পিয়ন, পেশকার, আরদালি, পুলিশ সবাইকে টাকা দিতে দিতে হয়রান হয়েছেন তিনি। তবুও মামলার চূড়ান্ত ফলাফল মেলেনি। জমি ফিরে পেতে আপিল করেন উচ্চ আদালতে। হাইকোর্টে তিন বছর মামলা চালিয়ে ২০০১ সালে অপূর্ণ আশা নিয়েই মারা যান আলাউদ্দিন। পরবর্তীতে মামলার হাল ধরেন ছেলে নুরুল ইসলাম। কিন্তু মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায়ই তুলতে পারেননি। নুরুল বাদী হওয়ার পর মামলা চালাচ্ছেন ১৮ বছর ধরে। তিনি বলেন, বাবা ধানিজমি বিক্রি করে টাকা খরচ করেছেন। এখন আমিও করে যাচ্ছি। বাবাসহ আমি অন্তত ৬০ বার এ মামলার জন্য আদালতে দাঁড়িয়েছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ডজনেরও বেশি বার এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত কিংবা পাল্টা স্থগিত হয়েছে। এতে প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে। টাকার পরিমাণ ৩০ লাখের অধিক। খরচ বহন করতে করতে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি।’ 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে অবৈধ বকশিশ বাণিজ্য, যার সবটাই বহন করতে হয় বিচারপ্রার্থীকে। পুলিশ, পেশকার, পিয়ন, আরদালিসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সবাই অবৈধভাবে এসব পয়সা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন। এটা চরম দুর্নীতি।’ 

এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান রচি বলেন, ‘চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আমাদের ডেকে বলে দিয়েছেন— কোনো আইনজীবী যেনো আদালত সংশ্লিষ্ট কাউকে বকশিশের নামে ঘুষ না দেন। যেকোনোভাবেই হোক আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট করা যাবে না। বিচারপ্রার্থীরা যেনো ভোগান্তিতে না পড়েন।’ তিনি বলেন, ‘আমরাও তার নির্দেশনা সব আইনজীবীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি। অথচ এখনো অনেক আইনজীবী দ্রুত কাজ শেষ করতে বকশিশ দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাচ্ছি। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীরাও দায়ী। তারাও অনেক সময় বাড়তি টাকা দিয়ে দ্রুত কাজ করাতে চান।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইমরুল হাসান বলেন, ‘আসলে বকশিশ প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অবৈধ। বকশিশ দেয়া-নেয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু তবুও এ বিষয়টি আদালতপাড়ায় অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। আসলে দ্রুত সেবা পেতে বিচারপ্রার্থীদের বকশিশ না দিয়েও উপায় থাকে না। সাধারণ প্রক্রিয়ায় একটি মামলার শুনানি বা জামিনাদেশ পেতে অনেক সময় লেগে যায়। তখনই বিষয়টি দ্রুত করতে বকশিশ বা কিছু খরচাপাতি দিতে হয়। এখন প্রতিটি ধাপে একটি নির্ধারিত সীমা বেঁধে দিয়েছে কর্মচারী ও আদালত-পুলিশ। ওই সীমার নিচে বকশিশ দেয়া যায় না। কম দিলে পরবর্তী সময়ে ওই আইনজীবী অন্য কোনো মামলা নিয়ে গেলে তাকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বা পুলিশ সহযোগিতা করেন না। এক কথায়, আদালত-পুলিশ ও কর্মচারীদের হাতে অনেকটা জিম্মি আইনজীবীরা।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে পুলিশের একজন জিআরও বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আসার পর থেকে কারো কাছ থেকে ঘুষ বা বকশিশের বিনিময়ে কাজ করিনি। আগে কেউ করে থাকলে সেটা বলতে পারব না।’ 

সিএমএম আদালতের একজন পেশকারও বকশিশের বিনিময়ে কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এই কোর্টে বকশিশের বিনিময়ে কোনো কাজ হয় না। অন্য কোর্টের কথা আমি জানি না।’

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট কবির হোসেন বলেন, ‘আদালতে ঘাটে ঘাটে পয়সা দিতে হয়। পুলিশ, পেশকার, পিয়ন, আরদালি, উমেদার— এরা অবৈধভাবে এসব পয়সা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকে। এটা চরম দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতির অর্থ শুধু যে কর্মচারীরা নেয় তা নয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ভাগ দিতে হয়। আবার এসব স্থানে বদলি হয়ে আসেও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে আদালতের কর্মচারীরাও ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়। পুরো ব্যবস্থা পাল্টে ফেলতে না পারলে এগুলো বন্ধ হবে না।’