Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

নৌকা বিরোধীরা সরকারি দল

রফিকুল ইসলাম

নভেম্বর ২৯, ২০২১, ০৬:৫০ পিএম


নৌকা বিরোধীরা সরকারি দল
  • নিজ বলয় ও পছন্দের প্রার্থীদের নিয়ে কৌশলী এমপিরা
  • এমপিরা বিরুদ্ধে থাকায় অনেক জায়গায় দাঁড়াতেই পারেনি অনেক নৌকার প্রার্থীরা
  • এমপিদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়েছিলেন দলীয় অনেক প্রার্থী  
  • অভিযোগ এলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি কেন্দ্র

‘এমপির পকেটের লোক নৌকা পেলে নৌকা, না পেলে নৌকা ডোঙ্গা! এমপি মতাদর্শীরা নৌকা না পেলেই পুলিশ প্রশাসনও বিরোধিতা করে। পরিস্থিতি এমন যে, ভোটের মাঠে নৌকাবিরোধী রাজনৈতিক দল আর বিদ্রোহীরা সরকারি। নৌকা চলে গেলে এমপিরা এই খেলা আর খেলতে পারবে না। চেয়ার না থাকলে তাদের নৌকাবিরোধী অবস্থানও থাকবে না। এমপিরা দায়িত্বে না থাকলে আওয়ামী লীগ আবার শক্তিশালী হয়ে যাবে। থাকলে আওয়ামী লীগ শেষ’— তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নড়াইলের কালিয়া উপজেলায় নৌকার পরাজয় হওয়ায় এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন  জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান নিলু।

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকের প্রার্থীদের হারানোর জন্য নৌকার লোকরাই বিরোধিতা করছেন।’

খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নড়াইলের কালিয়া উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টিতে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। সেখানে জয়লাভ করেছেন দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক  ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বলয়ভিত্তিক রাজনীতি দীর্ঘদিনের।

অভিযোগ রয়েছে, সদ্য অনুষ্ঠিত কালিয়া উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা। এতে মনোনয়ন বঞ্চিত হন এমপিপন্থিরা। ফলে ভোটের মাঠে বিদ্রোহ করে স্থানীয় এমপির অনুসারীরা। ওইসব বিদ্রোহীর বিজয় নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনকেও ব্যবহার করেন স্থানীয় এমপি। 

নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান নিলু মুঠো ফোনে বলেন, নির্বাচনে কে নৌকা পেলো আর কে পেলো না— সেটি বিষয় নয়। আমরা আওয়ামী লীগের লোক, আমরা বঙ্গবন্ধুর লোক, আমরা শেখ হাসিনার লোক। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড যাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন তাদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু দেখলাম, নৌকার মনোনীত প্রার্থীকে হারানোর জন্য দলীয় লোকরাই বিরোধিতা করছেন। পুলিশ প্রশাসনও নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, নির্বাচনে নৌকাবিরোধী রাজনৈতিক দল আর বিদ্রোহীরা সরকারি দল। নির্বাচনে এমপিদের এমন অবস্থান আগামীর আলামত ভালো নয়। এমপির পকেটের লোক নৌকা পেলে নৌকা, না পেলেই নৌকা তাদের কাছে ডোঙ্গা! ওই নৌকা নৌকা না, এমপির পকেটের লোক নৌকা পেলেই ওইটা আসল নৌকা। এমপির নৌকা চলে গেলে এই খেলা এমপি আর খেলতে পারবে না। এসব এমপি দায়িত্বে না থাকলে আওয়ামী লীগ আবার শক্তিশালী হয়ে যাবে, নইলে আওয়ামী লীগ শেষ। তবে চেষ্টা করেও নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হকের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

নিজ বলয় ও পছন্দের প্রার্থী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মাগুরা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীরেন শিকদার, মহম্মদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক কামাল সিদ্দিকি লিটন। তাদের নৌকাবিরোধী অবস্থানে উপজেলার মহম্মদপুর, পলাশবাড়িয়া, রাজাপুর ও নহাটা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের ভরাভুবি হয়েছে। অথচ নির্বাচনের আগে নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থায় নেয়ায় স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন নহাটা ইউনিয়নে নৌকার মনোনীত প্রার্থী মো. আলী মিয়া। লিখিত ওই অভিযোগে তিনি দাবি করেছিলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নৌকার বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। 

এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রে অনুরোধও করেছিলেন নৌকার প্রার্থী মো. আলী মিয়া। কিন্তু তার ওই অভিযোগ আমলে নেয়নি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। ফলে ভোটের মাঠে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে হেরে যান তিনি। যদিও নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থানের বিষয়টি মানতে নারাজ স্থানীয় সাংসদ বীরেন শিকদার। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ বাজে কথা। যে যার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। 

তিনি আরও বলেন, একজন যদি (বিদ্রোহী) দাঁড়িয়ে যায় এবং আমি তাকে থামাতে না পারি এর জন্য তো আমার দোষ হতে পারে না। এমন অভিযোগ শত্রুতাবশত। এমন শত্রুতা আগেও আমার বিরুদ্ধে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কেন্দ্রে দেয়া ওই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি। 
তৃতীয় ধাপে সাতক্ষীরায় নৌকার মনোনীত প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। জেলার কালীগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার ১৭টির মধ্যে ১১টি ইউনিয়নে দলটির দলীয় বিদ্রোহীরা জয়লাভ করেছেন। 

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলা ও জেলাটির বিভিন্ন উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও দলীয় এমপির মধ্যে ব্যাপক কোন্দল রয়েছে। চলমান দ্বন্দ্ব থেকেই নৌকার দিরুদ্ধে মদত দিয়েছেন স্থানীয় এমপি ও দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। যদিও জেলা আওয়ামী লীগের দাবি— যোগ্য, পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে অযোগ্য এবং অজনপ্রিয় ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। 

জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম নজরুল     ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, নৌকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করবে, এমন শক্তি কারো নেই। কিন্তু যারা বিদ্রোহী করেছেন। কোনো না কোনো প্রভাবশালী নেতা তো বিদ্রোহীদের মদত দিয়েছেন।

কোন্দল বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথে আমার দ্বন্দ্ব নেই। একজন এমপির সাথে মতো বিরোধ থাকতে পারে কিন্তু তার প্রভাব নির্বাচনে পড়েনি। এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, যোগ্য, পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে অযোগ্য এবং অজনপ্রিয় ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। 

গত রোববার সারাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ওই নির্বাচনের মতোই তৃতীয় ধাপে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন নৌকার মনোনীত প্রার্থীরা। একাধিক স্থানে জামানত হারিয়েছেন কেউ কেউ। আর এই নৌকাডুবির পেছনে ইন্ধন রয়েছে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী এবং জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের। তারা নিজ নিজ বলয় ও পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে গিয়ে নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ভোটের মাঠে নৌকার মনোনীত প্রার্থী ১২০ ভোট পেয়ে রেকর্ড গড়েছেন তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে। ঘটনাটি ঘটেছে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নে। সেখানে নৌকা প্রতীক নিয়ে এইচ এম আর কে খোকন পেয়েছেন মাত্র ১২০ ভোট। 

তিনি বলেন, দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে। মূলত সারা দেশে নৌকার ভরাডুবির বড় কারণ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্ব। ফলে বিএনপিবিহীন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মুখোমুখি অবস্থানে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। দলটির দলীয় ও বিদ্রেহী প্রার্থী এবং সমর্থকদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন হামলা, সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, নির্বাচনি কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ নির্বাচনি সহিংসতায় ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ দলীয় বিদ্রোহী ও তাদের ইন্ধন দাতাদের নৌকাবিরোধী কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নৌকার বিপক্ষে কাজ করা অনেক এমপি-মন্ত্রী ও  জেলা-উপজেলার প্রভাবশালী এমপিদের নাম এখন তার টেবিলে। অভিযুক্ত এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে। তবে দলের এমন কঠোর বার্তা কাছে আসছে না।  তারা নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন।