Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

জ্বালানি তেলের দাম কমবে কবে

রেদওয়ানুল হক

নভেম্বর ৩০, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


 জ্বালানি তেলের দাম কমবে কবে
  • সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কমলো ১৫ শতাংশ, তেলের দাম ডলারের সাথে সমন্বয় করা উচিত : এফবিসিসিআই
  • বিষয়টি সরকারকে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে: বিপিসি চেয়ারম্যান 
  • দাম বাড়ানোই ঠিক হয়নি: ক্যাব সভাপতি
  • বাজার পর্যবেক্ষণ করছি: জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে গত ৪ নভেম্বর সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করে। এর প্রভাবে অস্থির হয়ে ওঠে জনজীবন। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পরপরই দেশের সব ধরনের পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়। 

এরপর বাড়ানো হয় পণ্য পরিবাহী ট্রাক ও লাইটার জাহাজের ভাড়া। একই সাথে দাম বৃদ্ধির তালিকায় আছে বিদ্যুৎ। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে  ইতোমধ্যে বাড়ানো হয়েছে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। বিদ্যুতের দাম বাড়লে বাড়বে উৎপাদন খরচ। 

এতে পণ্যের দাম বাড়বে আরেক দফা। ইতোমধ্যে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও কৃষিফার্মগুলো ক্ষতির মুখে পড়েছে। কিন্তু যে অজুহাত দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে সেই বিশ্ববাজারেই এখন চলছে জ্বালানি তেলের টানা দরপতন। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রভাবে এ দরপতন অব্যাহতথাকবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তাই সমালোচনার মুখে পড়েছে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে এক সাথে ১৫ টাকা দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে কোনোভাবেই মানতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে দাবি উঠেছে দ্রুত জ্বালানি তেলের দাম কমানোর। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে সরকারকে ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) বিরুদ্ধে। 

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, গত সাত বছর তেলের দাম ছিলো অনেক কম। বিপিসি তখন কম দামে তেল কিনে দেশের ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই সাত বছরে সরকার মাত্র একবার দাম কমায়, তা-ও অতি সামান্য, মাত্র তিন টাকা প্রতি লিটারে। কিন্তু দাম বাড়তে শুরু করার এক মাসের মধ্যেই বিপিসির দেয়া প্রস্তাব মেনে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়িয়ে দেয় লিটারে ১৫ টাকা।

দেশের বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষক থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন গরিব ও মধ্যবিত্তরা। বাস, ট্রাক, কভার্ড ভ্যান, লঞ্চ ও লাইটার জাহাজের ভাড়া বাড়ায় বেড়েছে যাতায়াত ও পরিবহন খরচ। 

এছাড়া এর পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে অনেক খাতে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কৃষকের ওপর, দ্বিতীয়ত রপ্তানিমুখী শিল্পের ওপর। কৃষকের একটা বড় খরচ সেচকাজ ও জমিতে চাষ দেয়া। সেখানে ডিজেল ব্যবহার হয়। এরপর ট্রাক কিংবা নৌযানের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় শাক-সবজি থেকে শুরু করে যেসব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে, তার সবগুলোরই দাম বেড়েছে। ফলে ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত একটা চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাগুলো। 

এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে এর বড় প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়। তারা মনে করছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সার্বিক সক্ষমতায় চাপ পড়তে পারে এ পরিস্থিতিতে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে অর্থনীতি এমনিতেই একটু সঙ্কুচিত অবস্থায়। সেখানে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। 

তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দেখা যায়, একটা বাজারে যখন সরবরাহের চাইতে চাহিদা বেশি, তখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তেলের মূল্য বৃদ্ধির সুযোগে অনেকে সেটা মজুত করে রাখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সেটাও মজুত করে রাখে। তখন বাজারে একটা কৃত্রিম চাপ সৃষ্টি হয় এবং যখন এই মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষের ওপর গিয়ে পড়ে, তখন সামগ্রিকভাবে মানুষের আয়ের ওপর চাপ পড়ে। ইতোমধ্যে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ১১ শতাংশ। 

এসব সংকট যে বিষয়টিকে ঘিরে সেই জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমেই চলেছে। ২০২০ সালের এপ্রিলের পর গত শুক্রবার সবচেয়ে বড় দরপতন হয়। গত শুক্রবার প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের মূল্য ছিলো ৭২.৭২ ডলার, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ৮ শতাংশ কম। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য আরও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

এর আগে ব্যারেলপ্রতি দাম ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত ১৯ নভেম্বর আরেক দফা কমেছিল আন্তর্জাতিক বাজারে। তখন ৮৫ ডলার থেকে কমে ৭৯ ডলারে নেমে আসে। অর্থাৎ আট দিনের ব্যবধানে (১৯-২৬ নভেম্বর) দাম কমে প্রায় ১৫ শতাংশ। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তাই তেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ানো উচিত হয়নি জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘তেলের দাম ডলারের দামের সাথে সমন্বয় করা উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কমে যাবে বাংলাদেশেও কমবে। আর যখন বাড়বে তখন বাংলাদেশেও বাড়বে। এতে একসাথে তেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না।’ 

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোই ঠিক হয়নি। যেখানে বিপিসি দীর্ঘদিন লাভ করেছে এমনকি সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে। এরপর বিশ্ববাজারে বাড়ার সাথে সাথেই দেশে বাড়িয়ে দেয়া অনৈতিক হয়েছে বলে মনে করি। এ ছাড়া তেলের দাম বাড়ানোর সাথে সাথে গণপরিবহন ও পণ্যপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এগুলো সাধারণত একবার বাড়লে আর কমানো হয় না। তাই আমরা প্রত্যাশা করি, যেহেতু বিশ্ববাজারে দাম কমেছে তাই যত দ্রুত সম্ভব সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমাবে।’

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার প্রেক্ষাপটে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে কি-না জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এনডিসি (সচিব) বলেন, ‘দাম কমার হার পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারকে অবহিত করা হচ্ছে নিয়মিত।’

করোনার মধ্যে কোনোভাবেই দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘যেহেতু করোনার মধ্যে সবাই খারাপ অবস্থায় আছে তাই জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে যদি ঊর্ধ্বমুখীও হতো তবুও পরিস্থিতি বিবেচনায় তেলের দাম বাড়ানোটা সাধারণ মানুষের জন্য চাপের সৃষ্টি করে। এটি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর বড় প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে কৃষকের সেচের ও পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে খরচ অনেক বেড়ে গেছে।  সরকার যদি ভর্তুকি তুলে নিতে চায়, তবুও সময় বিবেচনায় ভর্তুকি তোলার এখন সময় নয়। আমরা আশা করি, বিশ্ববাজারে যেহেতু দাম কমেছে তাই সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।’

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় দেশের বাজারেও কমানোর আভাস দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত শনিবার তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। দাম কমছে। তবে, এই কমার প্রভাব এখনো বাজারে পড়েনি। যদি পড়ে তাহলে আমরাও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করব।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যদি কেনার সময় কম দামে পাই তাহলে অবশ্যই কমাব।’

অন্যদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন পেট্রোলিয়াম জাতীয় জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের জন্য ২০১২ সালে তিনটি বিধিমালা প্রস্তুত করেছিল। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন অনুযায়ী ডিজেল-কেরোসিনসহ অন্যান্য পেট্রোলিয়াম জাতীয় জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করতে কেন আদেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) করা এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে গত সোমবার এ আদেশ দেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার হাইকোর্ট বেঞ্চ।