Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

সড়কে মৃত্যু নিয়েও রাজনীতি!

নুর মোহাম্মদ মিঠু 

ডিসেম্বর ৪, ২০২১, ০৬:৫০ পিএম


সড়কে মৃত্যু নিয়েও রাজনীতি!

ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণেই যেখানে সড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল; সেখানে সরকারের দায়িত্বশীল সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে রাজনৈতিক উস্কানির অভিযোগ করেছেন। 

তার এই অভিযোগ আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হলেও প্রশ্ন থেকেই যায় তবে কেন সড়কে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা; এমনকী গতকালও রাজধানীতে এক শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মীর মৃত্যুর ঘটনা তাহলে কেন ঘটলো— এমন প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। 

এদিকে মন্ত্রীর রাজনৈতিক উস্কানির অভিযোগের বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই-এর (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন আমার সংবাদকে বলেন, যেহেতু উনি মন্ত্রী, সেহেতু ওনার গোয়েন্দা সংস্থাসহ অনেক সোর্সও রয়েছে, সেরকমই কোনো সোর্সের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি রাজনৈতিক উস্কানির অভিযোগ করছেন কি-না তা তো বলতে পারবো না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলনটি করছে, সেটিও যে যৌক্তিক, এ কথাও ওনারাই বলেছেন।

মন্ত্রীর প্রতি প্রশ্ন রেখে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, যেহেতু তাদের দাবি যৌক্তিক আপনারাই বলছেন; তাহলে তাদের এই দাবি জিইয়ে রাখছেন কেন? দাবি যদি যৌক্তিক হয়েই থাকে তাহলে সে দাবিগুলো পূরণ হয়ে গেলেই তো আর ষড়যন্ত্রের কোনো সুযোগ থাকে না। 

তবুও কেন শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করা হচ্ছে না— প্রশ্ন ইলিয়াস কাঞ্চনের। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথাও বলছেন, দাবি আদায়ের আন্দোলনকেও যৌক্তিক বলছেন, তাহলে সমধান করছেন না কেন— এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ঝুলিয়ে না রেখে সমাধান করে ফেললেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। 

সড়ক ও সেতুমন্ত্রী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বললেও কিন্তু সড়কে মৃত্যুর ঘটনা থেমে নেই, প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে এমনটা জানিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ষড়যন্ত্র দেখবেন কিন্তু সড়কে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নিবেন না, আপনাদের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও ঠিক মতো কাজ করবে না; সেগুলোও তো দেখা দরকার।  

একই ইস্যুতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলছেন, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। আর এই অবস্থার উন্নয়নেও সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। তার ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও নটর ডেম কলেজের দুজনসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫৪ জন শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।

সংগঠনটি জানায়, নভেম্বর মাসে দেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছে ৪১৩ জন এবং আহত হয়েছে ৫৩২ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭ জন এবং শিশু ৫৮ জন এবং শিক্ষার্থী ৫৪ জন। এছাড়া এই সময়ে শুধু ঢাকায় ১৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন।

এদিকে সড়কের অনিয়ম বন্ধের দাবিতে গতকাল ‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে গতকাল রাজধানীর রামপুরা ব্রিজের ওপর অবস্থান নিয়ে ‘লাল কার্ড’ দেখান শিক্ষার্থীরা। ৯ দফা দাবিতে আজ শাহবাগ থেকে কাফনের কাপড় পরে প্রতীকী লাশের মিছিল এবং ১০ ডিসেম্বর সারা দেশে সমাবেশ করবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সব কর্মসূচি পালন করে আসছি। শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচির মাধ্যমে ৯ দফা দাবি আদায় করা হবে। এই আন্দোলনের ওপর ভর করে কেউ নাশকতা-বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।  

সড়কে একের পর এক মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে দাবি করেন কর্মসূচির নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া। খিলগাঁও মডেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘সড়ক ব্যবস্থাপনায় জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। যার ফলে আমরা দেখতে পাই রাস্তায় ফিটনেসবিহীন, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও অপেশাদার চালক নিয়োগ দেয়া হয়। 

দেশে কোনো ব্রিজ নির্মাণ হলে সেখানে যত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়ে থাকে, এর অর্ধেক অর্থ লুটপাট হয়ে যায়। আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলেও বছর যেতে না যেতেই সেই রাস্তা ভঙ্গুর হয়ে যায়।’ 

‘লাল কার্ড’ দেখানোর এই কর্মসূচি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সড়কের দুর্নীতিকে আমরা আজকে লাল কার্ড দেখাচ্ছি। মাঠে যখন ফুটবল খেলা হয়, তখন খেলোয়াড়রা কোনো ভুল বা অন্যায় করলে রেফারি লাল কার্ড দেখায়, আমরা সেই রেফারির ভূমিকা পালন করতে চাচ্ছি।’ 

৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় একের পর এক শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা ঘটছে। সবশেষ গতকাল ভোররাতেও রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে লরির চাপায় এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত হন। তার নাম মো. মেহেদী হাসান লিমন (২১)। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। এছাড়া একই রাতে মোহাম্মদপুরে ট্রাকচাপায় নিহত হন সংবাদকর্মী এমদাদ হোসেনও। 

রামপুরার শিক্ষার্থীদের পেছনে রাজনৈতিক উসকানি: নিরাপদ সড়কসহ বিভিন্ন দাবিতে কিছুদিন ধরে রাজধানীর রামপুরায় আন্দোলন করতে থাকা শিক্ষার্থীদের পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের ইন্ধন আছে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে গতকাল শনিবার সকালে সড়ক নিরাপত্তা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সড়ক নিরাপত্তামূলক রোড শোতে অংশ নিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। কাদের বলেন, ‘রাজনৈতিক দল থেকে শিক্ষার্থীদের উসকানি দেয়া হয়। সেটার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এর ভিডিও ফুটেজ আছে। এটা একটা রাজনৈতিক দলের মহানগরের মহিলা নেত্রী রামপুরায় রাস্তায় নেমে ছাত্র-ছাত্রীদের উসকানি দিচ্ছেন, স্কুলের ড্রেস পরে। তারপরও এই আন্দোলনটা একটা বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। এটা রামপুরা এলাকাতেই শুধু হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা যখন আন্দোলন শেষে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করছে, তখনই রাজনৈতিক উসকানি দিচ্ছে একটি মহল।’

বাসভাড়া অর্ধেক করার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাঝে ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় অনাবিল পরিবহনের বাসের ধাক্কায় এসএসসি পরীক্ষা দেয়া এক ছাত্রের প্রাণ যায়। 

এর আগে ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে সিটি কর্পোরেশনের একটি ময়লার গাড়ির ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন নটর ডেম কলেজের এক ছাত্র। এসব ঘটনার পর নানা দাবিতে প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পেছনে যারা জড়িত, তাদের বিচারের পাশাপাশি অন্যতম দাবি ছিলো বাসভাড়া অর্ধেক করা। এমন অবস্থায় ৩০ নভেম্বর ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়েছেন তারা। পরের দিন থেকেই ঢাকা শহরে ছাত্রদের জন্য কার্যকর করা হয় হাফ পাস।

হাফ পাসের ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে মালিক সমিতি। এর মধ্যে রয়েছে হাফ পাস কার্যকর হবে শুধু রাজধানীতে, হাফ ভাড়া দেয়ার সময় অবশ্যই ছবিসংবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড দেখাতে হবে। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোয় কোনো হাফ পাস থাকবে না। তবে রাস্তা ছাড়ছে না রামপুরার শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনই দুপুর ১২টা থেকে দুই-তিন ঘণ্টার জন্য নিয়ম করে রামপুরা ব্রিজে অবস্থান নেয় তারা। এতে বাড্ডা-এয়ারপোর্ট রোডে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট।

রাস্তা ছেড়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘প্যান্ডামিকের কারণে শিক্ষার্থীদের অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। অনেক ক্ষতি হয়েছে তাদের। তারা এখন পড়াশোনায় মনোনিবেশ করুক— এটাই আমাদের চাওয়া।’ 

শিক্ষার্থীদের গণপরিবহনে হাফ পাস ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দেখা গেছে, অনেক সরকারি দপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ির কাগজপত্র নেই। বিষয়টি সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর নজরে আনা হলে তিনি সমস্যার কথা স্বীকার করেন। 

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এগুলো আছে, সমস্যা আছে। সমস্যা যে নেই, তা না। এগুলো নজরে আসছে, এগুলো সমাধানে পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে।’ আন্দোলনের উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাওয়া হয় মন্ত্রীর কাছে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আইনগত ব্যবস্থা যেভাবে নেয়া হয় সেভাবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিষয়টি তো আমার হাতে নেই। তদন্ত করে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’