Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

মুরাদকে পদত্যাগের নির্দেশ

ডিসেম্বর ৬, ২০২১, ০৫:২৫ পিএম


মুরাদকে পদত্যাগের নির্দেশ
  • মুরাদের নারীর প্রতি কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য অপসারণ দাবি সর্বমহলের  
  • ক্ষমা না চাইলে নেয়া হবে আইনি ব্যবস্থা —রুহুল কুদ্দুস কাজল 
  • দণ্ডবিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে: ব্যারিস্টার সারা হোসেন
  • শপথ ভঙ্গ করায় সাংবিধানিকভাবে মন্ত্রী থাকতে পারেন না: দাবি নারী অধিকারকর্মীদের

বেশ কয়েকমাস ধরেই বিতর্ক আর সমালোচনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছিলেন তথ্য ও সমপ্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। সর্বশেষ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জায়মা রহমান সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির মধ্যকার কথোপকথনের একটি কল রেকর্ড ছড়িয়ে পড়লে সোস্যাল মিডিয়ায় ফুঁসে ওঠেন সর্বমহল। এর প্রেক্ষিতে গতকাল রাতে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে আজ মঙ্গলবারের  মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। 

গতকাল রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার বাসভবনে ডা. মুরাদ হাসানের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আজ (সোমবার) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। আমি প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছি।’

এর আগে গতকাল সারাদিন অডিও ক্লিপটি এই মুহূর্তে টক অব কান্ট্রিতে পরিণত হয়। চারিদিকে বইছে সমালোচনার ঝড়। কেউ নিন্দা জানাচ্ছেন। কেউবা বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন। সোস্যাল মিডিয়ায় সারা দেশের মানুষ নানা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। তবে মুরাদ হোসেনকে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে উপযুক্ত শাস্তির দাবি তুলেছেন নেটিজেনরা। 

এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জায়মা রহমান সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেয়ায় মুরাদ হাসানকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন নারী অধিকার কর্মীরাও। লিখিত বিবৃতি দিয়ে তাকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন তারা। একজন সংসদ সদস্য হয়ে নারীকে ‘অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য করায় তার শপথ ভঙ্গ হয়েছে বলে মত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা। 

তারা বলছেন, সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সবার প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবো’ মর্মে মন্ত্রী হিসেবে তিনি যে সাংবিধানিক শপথ গ্রহণ করেছেন, তিনি ক্রমাগতভাবে তার নানাবিধ মন্তব্য/কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা ভঙ্গ করে চলেছেন। তাই সাংবিধানিকভাবে তিনি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী থাকতে পারেন না।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেছেন, মুরাদ হাসান বিভিন্ন ব্যক্তি, বিশেষ করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে লাগামহীনভাবে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেই চলেছেন। তার এ ধরনের বক্তব্য দেশের নাগরিকের জন্য বিশেষ করে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক চরম অবমাননাকর। 

আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে (ডা. মুরাদ হাসান) জাতির সামনে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। তা না হলে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’ এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ওপর শপথ নেয়া একজন মানুষ এ ধরনের বক্তব্য দেবে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা সংবিধান অবমাননা। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় এবং সংসদ থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। নারী অধিকারকর্মীরা প্রশ্ন তুলে বলছেন, কি এমন ক্ষমতা লোকটার? খুঁটির জোর কোথায়? রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নিজের ভোগ বিলাসে ব্যবহারেরও কি পরিমাণ দম্ভোক্তি তার কণ্ঠে। 

গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতদেরও তিনি চরমভাবে হেয় করেছেন। তুচ্ছতাচ্ছিল্যভাব দেখিয়েছেন যেনো এসব সংস্থাকে চাইলেই অন্যায় কাজে ব্যবহার করা যায়। ধর্ষণের ইচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে হেয় করায় এই লোকটার বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে কাউকে তুলে এনে ধর্ষণের হুমকি দেয়া ফৌজদারি অপরাধ।’ খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে দেয়া আপত্তিকর মন্তব্য প্রত্যাহার করবেন না বলে জানিয়েছেন। 

গতকাল সোমবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এসব বক্তব্য দিয়ে কোনো ভুল করেননি। এগুলো তিনি প্রত্যাহারও করবেন না। প্রত্যাহার করার ব্যাপারে সরকার ও দলের পক্ষ থেকে কোনো চাপও নেই।

প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বক্তব্যের ভিডিওটি সোস্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির আইনজীবী খন্দকার রেজা ই রাকিব। 

এদিকে গতকাল চিত্রনায়িকা মাহির সাথে কথোপকথনের ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপটিতে শোনা যায়, মাহিকে তাৎক্ষণিক তার কাছে যেতে বলছেন মুরাদ। মাহি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হুমকি দিচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী। ফোনালাপে থাকা চিত্রনায়ক ইমন ইতোমধ্যে সেটি স্বীকারও করেছেন। ফাঁস হওয়া ওই কথোপকথনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। 

পুরো বক্তব্যে ‘অশ্রাব্য’ কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। তবে এ নিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী কিংবা মাহিয়া মাহির সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, এরকম একটি পদে আসীন যেকোনো ব্যক্তির এ ধরনের ফোনালাপ প্রকাশ পাওয়ার পরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি-না।

এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘উনি (তথ্য প্রতিমন্ত্রী) ক্যানসারের ডাক্তার। ক্যানসারের বীজ উনার মাথার ভেতরে ঢুকে গেছে। বেচারা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন মঞ্চে আসার জন্য। উনি হয়তো ভাবছেন— এ জাতীয় কথা বললে উনাকে হয়তো পূর্ণ মন্ত্রী বানাবেন। কিন্তু উনার ক্যানসার উনার মাথাটা খেয়ে দেবে।’ এর আগে নানাভাবে এই প্রতিমন্ত্রী আলোচনায় আসেন। 

গত ৪ ডিসেম্বর বেসরকারি একটি টেলিভিশনের টকশোতে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান অপর আলোচক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়ার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী পাপিয়াকে ‘মানসিক রোগে আক্রান্ত’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি নিজে একজন ‘চিকিৎসক হিসেবে’ বিএনপির এই নেত্রীর (পাপিয়া) ‘চিকিৎসা দরকার’ মনে করেন বলেও মন্তব্য করেন। এসময় দু’জনের মধ্যে তীব্র বাগ্বিতণ্ডা হয়। 

এর দুদিন আগেই ইউটিউবে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়ার পরিবারের এক নারী সদস্যকে উদ্দেশ্য করে অশালীন বক্তব্য দেন ডা. মুরাদ হাসান। প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের এক প্রশ্নের জবাবে হাস্যরস করতে করতে ওই নারীকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়েও ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করতে শোনা যায় তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে। 

এরই মধ্যে এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ৪০ নারী অধিকারকর্মী। তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যকে ‘লিঙ্গবাদী’, ‘কুৎসিত যৌন হয়রানিমূলক’ বলেও আখ্যা দিয়ে তার অপসারণ দাবি করেন তারা। 

বিবৃতিতে নারী অধিকারকর্মীরা বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পদে আসীন একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর মুখে এই ভাষা বাংলাদেশের আপামর নারীদের অপমান এবং অসম্মান করেছে বলে আমরা মনে করি। এর মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিকে সমাজ এবং রাষ্ট্রে কাঠামোগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার বৈধতা দেয়া হয়।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ফোনালাপটি ফাঁস হয়। ফোনালাপের শুরুতে ডা. মুরাদের দাবি করা কণ্ঠের অন্যপাশে চিত্রনায়ক ইমনকে কথা বলতে শোনা যায়। চিত্রনায়ক ইমন ডা. মুরাদকে জানান, তিনি বনানীর একটি রেস্তোরাঁয় রয়েছেন। কথা বলার একপর্যায়ে মাহিয়া মাহিও তার সাথে রয়েছেন জানিয়ে ইমন ডা. মুরাদের সাথে কথা বলিয়ে দেন। ডা. মুরাদ মাহিয়া মাহিকে ফোনে পেয়ে বিভিন্ন অশ্লীল কথাবার্তা বলতে থাকেন। 

একপর্যায়ে ‘অশ্লীল ভাষায়’ দেখা করার জন্য ‘নির্দেশ’ দেন। প্রয়োজনে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী পাঠানোরও হুমকি দেন তিনি। ওই কথোপকথনের দ্বিতীয় ধাপে আবার কথা হয় এই দুজনের। ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপটি ‘সঠিক’ বলে স্বীকার করেছেন চিত্রনায়ক ইমন।

 ঘটনাটি দুই বছর আগের দাবি করে ইমন জানান, একটি ছবির মহরত অনুষ্ঠানের আগের রাতে ফোন দেন প্রতিমন্ত্রী। ইমন বলেন, ডিরেক্টর সুমন ভাইসহ (ওয়াজেদ আলী সুমন) আমরা মিটিং করছিলাম। তখন উনি (প্রতিমন্ত্রী) হঠাৎ ফোন দিয়েছেন। তিনি কিন্তু প্রথমেই বলেছেন, ‘তুই ফোন ধরস নাই কেন?’ পরে উনিই আবার ফোন দিয়েছেন। এটা ২০২০ সালের করোনারও আগের ঘটনা। একজন মন্ত্রী বারবার ফোন দিচ্ছেন, আমি কিন্তু বলেছি, ‘হ্যাঁ, ভাই আসতেছি। দেখছি ভাই’। 

তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ডা. মুরাদ যেকোনো আর্টিস্টকে ফোন দিতেই পারেন উল্লেখ করলেও চিত্রনায়ক ইমন মনে করেন, ‘এমন আচরণ অগ্রহণযোগ্য’। তবে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, তিনি নিজে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র। এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে সম্ভব হয়নি। এদিকে মাহিকে বারবার ফোন করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

প্রসঙ্গত, ডা. মো. মুরাদ হাসান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালেও তিনি একই আসনে থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে সরকার গঠনের সময় মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ৫ মাসের মাথায় ওই বছরের ১৯ মে তার দফতর পরিবর্তন করে তথ্য প্রতিমন্ত্রী করা হয়।