Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

যত গর্জে ততো বর্ষে না

ডিসেম্বর ১৩, ২০২১, ০৬:৫৫ পিএম


যত গর্জে ততো বর্ষে না
  • গতকালও পাবনায় নির্বাচনি সহিংসতায় কিশোর নিহত 
  • নির্বাচনে উৎসবের আমেজ এখন শুধুই স্মৃতি 
  • ক্ষমতাসীন দলের প্রতীকের প্রার্থী-বিদ্রোহী উভয়ের সঙ্গেই প্রশাসনের সখ্য, সংঘাত নিয়ন্ত্রণে বেকায়দায় প্রশাসন

একটা সময় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন মানেই ছিলো উৎসবের আমেজ। সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বনিম্ন এই স্তরটি ছিলো রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষপাতের বাইরে। এখানে এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন, একই সঙ্গে প্রচারে অংশ নিতেন।পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যেতো গ্রামের পর গ্রাম। রীতিমতো হইচই পড়ে যেতো নির্বাচনি এলাকায়। নির্বাচনের পর আবার যে যার মতো বিজয়ী প্রার্থীকে সহযোগিতা, সম্মান করতেন। কিন্তু এখন সেসব কথা শুধুই অতীত।

২০১৬ সালের ২২ মার্চ দেশে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন শুরু হয়। এরপর থেকেই নষ্ট হয় আগের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ। শুরু হয় সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতা। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা হয়ে ওঠে রক্তাক্ত। বর্তমানে নির্বাচন চলাকালেও প্রায় প্রতিদিনই মারামারি, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, গ্রেপ্তার চলছেই। গতকালও পাবনা সদরের  চরতারাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রচারণাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ মনোনীত  প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ চলাকালে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে নাসিম হাসান নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় কমপক্ষে পাঁচজন আহত হয়েছেন। আহতদের নাম জানা যায়নি।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা থামাতে মাঠপ্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন বৈঠক করে নির্দেশনা দিলেও কার্যত থামেনি প্রাণহানি, বরং একের পর এক সহিংসতায় বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। যদিও প্রতিটি ধাপে নির্বাচনের আগে খোদ প্রার্থীদের নিয়েই সভা-সমাবেশ করে সব অনিয়ম-সংঘর্ষ-সহিংসতা কঠোরভাবে দমনের হুঙ্কার দিচ্ছে প্রশাসন।

বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ভোটের দিন কিংবা এর দু-চারদিন আগে-পরের সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঠেকাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে প্রশাসন। এসব ঘটনায় আবার উদ্বিগ্ন ও বিব্রত বোধ করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা। 

তিনি বলেছেন, প্রাণহানি খুবই দুঃখজনক। প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে ইউপি ভোট বাতিল ও নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া হবে।  চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দিয়ে নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ। আসন্ন চতুর্থ ধাপেও ইতোমধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও খোদ দলের কেন্দ্র থেকে দেয়া নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে দাঁড়াচ্ছে দলের অন্য নেতারা। 

এর বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও বিদ্রোহী দমনে এখন পর্যন্ত ব্যর্থতার জানান দিচ্ছে দলটি। এই ইস্যুটি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপনও করেছেন বলে জানা গেছে। কয়েকজন সদস্য অন্তত ইউনিয়ন পরিষদে প্রতীক না রাখার পরামর্শও দেন। প্রধানমন্ত্রীও জানতে চান ইউপি নির্বাচনে প্রতীক রাখা না রাখার সুফল ও কুফল। বোর্ড সভায় উপস্থিত সদস্যরা সুফল-কুফল দুটোই তুলে ধরেন। যদিও এখন পর্যন্ত প্রতীক থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। 

এরই মধ্যে আসন্ন চতুর্থ ধাপের নির্বাচনকেও সামনে রেখে জেলায় জেলায় ইতোমধ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সহিংসতা ততই বাড়ছে। ভোটের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। 

এর আগের ধাপগুলোতে প্রভাব-জবরদস্তির কারণে দুই শতাধিক ইউপিতে ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীতরা। অন্যদিকে নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে মাঠে নেই বিএনপি। দল মনোনীত একক প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন না পেয়ে অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতারাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা-তারাই নির্বাচনি মাঠ দখলে জড়াচ্ছেন সংঘাত-সহিংসতায়। 

সবশেষ খবরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া, ঢাকার সাভার ও ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ অন্তত ২৮ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচনি কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। পাবনা সদরের ভাঁড়ারা ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াসিন আলম গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় হয়েছে হত্যামামলা। পিস্তল-গুলিসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।

কলাপাড়া উপজেলার চাকামাইয়া ইউনিয়নে নৌকা ও ঘোড়া প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ছয়জন আহত হন। গত শনিবার রাতের এ ঘটনায় আহতরা হলেন— বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মজিবর হাওলাদার, তার ভাতিজা রনি হাওলাদার, নৌকার প্রার্থী হুমায়ুন কবির কেরামতের ছেলে হাসিবুল হাসান ও কর্মী হাসান গাজী, হারুন সরদার ও গোলাম মস্তফা। আহতরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। 

কলাপাড়া থানার ওসি জসিম জানান, পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের শ্রীফলতলা গ্রামে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়। ৮ নম্বর ওয়ার্ডে সদস্য প্রার্থী সাইদুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। 

হরিণাকুণ্ডু থানার ওসি আব্দুর রহিম মোল্লা জানান, আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি এবং গ্রামটিতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। 

নোয়াখালীর সদর উপজেলার এওজবালিয়া ইউনিয়নের চরশুল্লকিয়া খাসেরহাট বাজারে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুজ জাহেরের নির্বাচনি কার্যালয় ভাঙচুর ও আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে কার্যালয়ে থাকা ব্যানার, ফেস্টুন ও নৌকার তোরণ পুড়ে গেছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও তার সমর্থকরা। 

প্রার্থী আবদুজ জাহের বলেন, আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ (স্বতন্ত্র) প্রার্থী মো. বেলাল হোসেনের লোকজন অকটেন দিয়ে এ আগুন দিয়েছে। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে। 

তবে বেলাল হোসেন বলেন, ‘নৌকার প্রার্থীর লোকজনই এ আগুন দিয়েছে।’ সুধারাম মডেল থানার ওসি সাহেদ উদ্দিন জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার মাসুমা আক্তার বলেন, এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

পাবনার ভাঁড়ারের ঘটনায় গত শনিবার রাতে ভাঁড়ারা ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান ও প্রার্থী মোজাম্মেল হোসেন খাঁ এবং পাবনা সদর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ খানকে প্রধান আসামি করে সদর থানায় একটি মামলা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় নলদহ গ্রামের মুন্নাফ খান, নলদহ বাজারের নজরুল সরদার, আ. আলিম ও শাহরিয়ার শামীমকে। 

পাবনা সদর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম জানান, ৩৪ জনের নামে এবং অচেনা আরও ৪০-৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে গোলাগুলিতে ব্যবহূত একটি বিদেশি পিস্তল এবং একটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে।

সাভার উপজেলার বনগাঁও ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডে সদস্য পদপ্রার্থী যুবলীগ নেতা আলাউদ্দিনের প্রস্তুতি সভায় হামলার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী সাইফুল ইসলামের ভাই আজিজুলসহ সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এতে আলাউদ্দিন, তার ভাই গিয়াস উদ্দিনসহ কয়েকজন আহত হন। ভাঙচুর করা হয় নির্বাচন ও বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে নির্মিত প্যান্ডেল। কোন্ডা এলাকার এ ঘটনায় গিয়াস উদ্দিন ও চেয়ারম্যানপক্ষের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমিসহ পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’ তবে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগটি মিথ্যা।’ সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মোখলেছুর রহমান বলেন, মামলা করে গ্রেপ্তার দুজনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। 

সূত্র বলছে, তৃণমূলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দেশে প্রায় ছয় হাজার ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এই ভোট প্রতীক বাদ দিয়ে করলে বিদ্রোহী প্রার্থীমুক্ত থাকতে পারবে আওয়ামী লীগ। কোন চেয়ারম্যান প্রার্থী যোগ্য-অযোগ্য, সেটি স্থানীয় জনগণই নির্বাচন করবে। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্যরা নির্ভার থাকতে পারবেন। এখন জেলা-উপজেলা ও সংসদ সদস্যদের প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে যে বেগ পেতে হয়, সেটি আর থাকবে না।

বিএনপি নেতারা বলছেন, বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বিরোধী ছিলো। এখনো সেটি সমর্থন করে না বিএনপি। কারণ এর মধ্যে দিয়ে জনগণকে বিভাজন করা হয়েছে। এই বিভাজনের কারণেই সন্ত্রাস হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, মানুষ যাদের পছন্দ করতো, আগে তাদের ভোট দিতো। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দিয়েছে। ফলে সমাজের জনপ্রিয় ব্যক্তিরা নির্বাচনে যাচ্ছেন না। এখন সন্ত্রাসীরা ভোট করছেন। ফলে সন্ত্রাস হচ্ছে। বিএনপি কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেলে এই ব্যবস্থা উঠিয়ে দেবে বলেও জানায় দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনে অন্য দলের কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে কার্যত ক্ষমতাসীনরাই। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বেকায়দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। স্থানীয়ভাবে দুপক্ষই শক্তিশালী হওয়ায় কিছু জায়গায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উভয়পক্ষের সাথে সখ্যতা থাকার কারণেও সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।