Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

ইউপি নির্বাচনে অপ্রতিরোধ্য সংঘাত

ডিসেম্বর ১৯, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


ইউপি নির্বাচনে অপ্রতিরোধ্য সংঘাত

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যকার সংঘাত, সংঘর্ষ যেনো ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শত চেষ্টায়ও রোধ করা যাচ্ছে না সহিংসতা। 

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে প্রতিপক্ষের গুলিতে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। একই দিন মাদারীপুরের কালকিনিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছে প্রায় অর্ধ-শতাধিকেরও বেশি মানুষ। 

এদিকে চলতি মাসের এই কদিনেই চারজন নিহত এবং অর্ধশত আহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে লাশের সারি দীর্ঘ হয়ে পৌঁছেছে শতকের কোটায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। 

এতে আহত হয়েছেন ছয় হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১ জন, বিএনপির দুই জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং একজন সাংবাদিক মারা গেছেন। 

আবার মানবাধিকার সংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্যে জানা যায়, এবারের ইউপি নির্বাচন শুরু হওয়ার পর থেকে গত নভেম্বর মাসেই নির্বাচনি সহিংসতায় ৪৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিন ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। এই নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর গত জানুয়ারি থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয় এবং বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটতেই থাকে। 

এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশন। মেয়াদ ফুরিয়ে আসা এই কমিশনও কোনো দায় না নিয়ে ‘পাহারা দিয়ে সহিংসতা ঠেকানো যায় না’ বলায় অনেকটা নিজেদের অসহায়ত্বই ফুটে উঠছে বলে মনে করছেন অনেকই। 

তবে সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি প্রশাসনকে কাজে লাগাতে সরকারের কাছেও সংস্থাটি লিখিতভাবে সহযোগিতা চেয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্র থেকে দেয়া প্রতীকের কারণেই সহিংসতা বাড়লেও; এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা বাস্তবায়ন করতেও দেখা যাচ্ছে না দলটির হাইকমান্ডকে। প্রতীক দিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণেই আটকেই আছে সহিংসতা ঠেকানোর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত।  

গত মার্চে করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়। এরপর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ কমে এলে নির্বাচন প্রক্রিয়া ফের শুরু হওয়ার সাথে সাথে সংহিসতাও বাড়তে থাকে। 

অপর এক তথ্যে জানা যায়, নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ৯২ জন। ডিসেম্বরের এই ক’দিনে আরো চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনি সহিংসতায় লাশের সারি দীর্ঘ হয়ে শতকের কোটায় এসে পৌঁছেছে। গুরুতর আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। 

প্রাণহানির ঘটনার বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, ঘরে ঘরে, মহল্লায় মহল্লায় পুলিশ দিয়ে পাহারা দিয়ে এ জাতীয় অপ্রীতিকর ঘটনা থামানো যায় না। এটা থামানোর একমাত্র উপায় হলো নির্বাচনের সাথে যারা আছে, তাদের সহনশীলতা ও নির্বাচনসুলভ আচরণ করা। 

সমপ্রতি নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভায় তিনি বলেন, সংঘাতের দায়-দায়িত্ব প্রশাসন, পুলিশ বা নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে দিলে হবে না। তারাই যে দায়ী এটা বলার সুযোগ নেই। 

নির্বাচনে তাৎক্ষণিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে এ জাতীয় ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, আমরা কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে চলে চাই। ঘটনা প্রত্যক্ষ করি ও নির্দেশনা দেই। যথাযথ পরামর্শ দেই। যখনই সুযোগ পাই, সেখানে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উদ্বুদ্ধ করি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে চেয়ারম্যান প্রার্থী এরশাদুল হকসহ দুজন নিহত হয়েছেন। নিহত অপর যুবকের নাম বাদল সরকার। তিনি ওই ইউনিয়নের নান্দুরা গ্রামের সন্তোষ সরকারের ছেলে। 

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতে ইউনিয়নের কুড়িঘর গ্রামের বাজার এলাকায় ওয়াজ মাহফিল চলছিল। এরশাদ ও বাদলসহ কয়েকজন মোটরসাইকেলে করে সেই মাহফিলে যান। ওয়াজ মাহফিলে সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে উপস্থিত সবার কাছে দোয়া চান এরশাদ। রাত ১০টার দিকে সেখান থেকে বাদলকে সাথে নিয়ে ফিরছিলেন এরশাদ। 

পথে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়লে সামনে চালকের আসনে বসা বাদল প্রথমে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুরুতর আহত এরশাদকে উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হলে আশঙ্কাজনক অবস্থা দেখে চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠান। তবে ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় এরশাদুলের মৃত্যু হয়। 

এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর পাবনার ভাঁড়ারায় নির্বাচনি সহিংসতায় মোহাম্মদ নাসিম নামে এক কলেজছাত্র নিহত হন। ওই দিন সন্ধ্যায় সদর উপজেলার চরতারাপুর ইউনিয়নে আ.লীগ ও স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘাতে এ ঘটনা ঘটে। তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। এর দুই দিন আগে একই ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোলাগুলিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াসিন আলম নিহত হন। 

এ ঘটনায় আহত হন আরো অন্তত ১৪ জন। নির্বাচনি প্রচারণা নিয়ে ওইদিন সকালে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী সুলতান মাহমুদ খান ও ইয়াসিন আলমের সমর্থকদের সাথে নৌকা প্রতীকের আবু সাঈদ খানের সমর্থকদের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় নিহত হন ইয়াসিন। একই দিন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ২০ জন আহত হন। 

উপজেলার সিরাজকান্দি বাজারের খোকার ডোবা এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। এর আগে ২৭ নভেম্বর যশোরের শার্শা উপজেলার পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কুতুব উদ্দিন নামে একজন নিহত হন। তিনি রুদ্রপুর গ্রামের মহিউদ্দিনের ছেলে। ওই ঘটনায় আহত হন উভয় পক্ষের আরো ১১ জন। ১৬ নভেম্বর বরিশালের আগৈলঝাড়া, মাদারীপুরের কালকিনি ও গাইবান্ধায় আরো তিনজনের মৃত্যু হয় নির্বাচনি সহিংসতায়। তারা সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

এদিকে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত শুক্রবার রাতে উপজেলার ৬ নং ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহমুদুল হাসান মামুন ও একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকার কায়সার টিপুর সমর্থকদের মধ্যে কাতলাগাড়ী বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এসময় সমর্থকারীরা সাতটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ, ২০টি বাড়িতে ভঙচুর-লুটপাটের ঘটনা ঘটায় বলে জানা গেছে। 

অন্যদিকে সুনামগঞ্জের ছাতকের খুরমা উত্তর ইউনিয়নে সমপ্রতি নির্বাচনি সহিংসতায় কমপক্ষে অর্ধশত লোক আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। মাদারীপুরের শিবচরে ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল ফকির ও তার ছেলেসহ পাঁচজনকে কুপিয়ে আহত করেছে প্রতিপক্ষ। বগুড়ার ধুনটের মথুরাপুরে নৌকার প্রার্থী হাসান আহম্মেদ জেসম মল্লিকের ওপরও হামলা চালানো হয়েছে। 

এর আগেও নরসিংদীতে ভোটকে ঘিরে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৮ অক্টোবর নরসিংদীর কাছারিকান্দিতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে দুই জনের মৃত্যু হয়। ১৫ অক্টোবর মাগুরার জগদলে প্রার্থিতা নিয়ে সংঘর্ষে নিহত হয় চারজন। এর আগে, প্রথম ধাপের নির্বাচন ঘিরে সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই শাসক দলের নেতাকর্মী। 

এদিকে ২৭ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় অজ্ঞাত দুই-তিনশ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। 

একই দিনে ঢাকার ধামরাইয়ে প্রতীক বরাদ্দের দিনে স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীর ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনায় সোমভাগ ইউনিয়ন পরিষদের আ.লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আজাহার আলীর এক সহযোগীকে আটক করে পুলিশ। 

এর আগে বেনাপোলে বোমা বানানোর সময় তিনজন গুরুতর আহত হন। একই দিন ফরিদপুরের শালথায় হামলায় একজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় আলাউদ্দিন ওরফে আলাল (৪৫) নামে একজন নিহত হন। পুলিশ ওই ঘটনায় ১০ জনকে আটক করেছে। 

এদিকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার কয়ড়ায় বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধর, নির্বাচনি অফিসে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতার ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।