Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

ই-কমার্সের কালো অধ্যায়

জানুয়ারি ৪, ২০২২, ০৯:৫৫ পিএম


ই-কমার্সের কালো অধ্যায়

২০২১ সালের করোনাকালীন সময়ে আর্থিক খাতে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর উত্থান ঘটে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার মাধ্যম ই-কমার্সের। বছরটিতেই আবার ই-প্রতারকদের অর্থ আত্মসাতের মানসিকতায় চাঞ্চল্যকর পতনের কবলে পড়ে এই খাত। উত্থান-পতনের মাঝেই সীমিত সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকাও আত্মসাৎ করে নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয় ১৭টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। সবকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই মামলা করে গ্রাহকরা। 

এসব মামলার তদন্তে নেমে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণও পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারই ধারাবাহিকতায় অন্যসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে সংস্থাটি। জানা গেছে, কেবল চারটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই গ্রাহকদের সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণও পায় সিআইডি। 

এছাড়া ডেসিটিনির মতো প্রতারণার জাল ফেলে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রাহকদের আন্দোলন ও মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছেন বেশকজন ই-প্রতারক। গেল বছর করোনাকালীন পুরো সময়জুড়েই যাদের দৌরাত্ম্য ছিল আলোচনায়, আত্মসাতের প্রবল মানসিকতায় এখন তাদের দিন কাটছে কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি অবস্থায়। 

প্রায় অর্ধেক দামে মিলবে লাখ টাকার মোটরবাইক, এসি, ফ্রিজ টেলিভিশন, হাজার টাকার নিত্যপণ্যের কেনাকাটাও করা যাবে নামমাত্র মূল্যে। তবে এসব অফারের সুবিধা মিলবে পণ্যের আগাম দাম পরিশোধে।     

এমএলএম প্রতিষ্ঠান ডেসটিনির বিজনেস মডেলে ২০২১-এর শুরুর দিকে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর হয়েও এমন ব্যবসার সূচনা করে ই-ভ্যালি। দেশের ই-কমার্স জগতেও সবচেয়ে বড় আলোড়ন সৃষ্টি করে এ প্রতিষ্ঠানটি। ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য ছাড়ে পণ্য দিতে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের বিস্তর অভিযোগ জমা হয় এ বছরেই। মামলাও হয় বেশকটি। গ্রেপ্তার হন ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৪০৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের। 

ইভ্যালির পরপরই আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। প্রতারণামূলকভাবে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন এক গ্রাহক। মামলার পরই প্রতিষ্ঠানটির মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা মাসুকুর রহমান ও অন্যতম কর্ণধার পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই গা ঢাকা দেন।

 পরে অবশ্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হন সোহেল রানা। এছাড়া ক্রিকেটার মাশরাফী বিন মোর্ত্তজাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে টেলিভিশনসহ নানান মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষের নজর কাড়ে ই-অরেঞ্জ। পিছিয়ে ছিল না ধামাকা, কিউ-কম, আলেশা মার্টের মতো ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠানও। 

সবকটি প্রতিষ্ঠানই জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন এবং শুরুর দিকে গ্রাহকের অর্ডার করা বাইকসহ কিছু পণ্য বুঝিয়ে দিয়ে আস্থা অর্জন করে। আর এমন লোভের ফাঁদে পড়ে পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে লাখ লাখ গ্রাহক। কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেন অনেকেই। 

এর আগে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ‘ধামাকা ডিজিটাল’ ‘ধামাকা শপিং ডটকম’ নামে রূপান্তরিত হয় ২০২০ সালে। বিভিন্ন ধরনের অফার দিয়ে আলোচনায় আসা ধামাকা শপিং ডটকমের বিরুদ্ধে ১২৯ কোটি ৭৬ লাখ ৪৩২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলে মামলা করে গ্রাহকরা। 

এসব মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের ৭৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও প্রতিষ্ঠানটির মালিক চিশতির ২৪০ কোটি টাকার সম্পদ পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। 

রিং আইডিও পিছিয়ে ছিল না প্রতারণার কোনো অংশেই। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডি জানিয়েছিল, শুধু তিন মাসে রিং আইডি ২১৩ কোটিরও বেশি টাকা আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাধারণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরে তারা বিভিন্ন সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানতকারীদের থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ শুরু করে। 

তাদের প্রতিশ্রুত সেবার মধ্যে ছিল মূলত বৈদেশিক বিনিয়োগ ও কমিউনিটি জবস। করোনার সময়ও তারা অনুদান সংগ্রহ করে। কমিউনিটি জবস খাতে উপার্জনের লোভ দেখিয়ে শুধু মে মাসে রিং আইডি ২৩ দশমিক ৯৪ কোটি টাকা, জুন মাসে ১০৯ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা এবং জুলাই মাসে ৭৯ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।  

অন্যদিকে একইভাবে প্রতারণায় অংশ নিয়ে পাওনাদার ও গ্রাহকদের চাপ সামলাতে না পেরে ইভ্যালির মতো কার্যালয় বন্ধ করে দেয় কিউকম। ফেসবুক লাইভে এসে অফিস বন্ধ করে বাসায় বসে কাজ করার ঘোষণা দেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ও সিইও রিপন মিয়া এবং তার সহযোগী সাবেক রেডিও জকি (আরজে) নিরব। 

এই সময়ে গ্রাহকদের তাদের বাসাবাড়ির নিচে ভিড় না করার অনুরোধও করেন তারা। করোনা মহামারিকালে ই-কমার্সের প্রসার ঘটার পাশাপাশি বিভিন্ন সাইট খুলে প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। ইভ্যালির অনুকরণে যাত্রা শুরু করে কিউকমও গ্রাহকের চারশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।

এসব বিষয়ে সমপ্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামানের নেতৃত্বে সিআইডি, এসবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট, আইন মন্ত্রণালয়, কিউকম ও ফস্টারের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। কিউকমের পক্ষে তিনজন আইনজীবী এবং কারাগারে থাকা কোম্পানির চেয়ারম্যান রিপন মিয়ার একজন আত্মীয় উপস্থিত ছিলেন। 

বৈঠকের পর সফিকুজ্জামান বলেন, কিউকমের ৩৯৭ কোটি টাকা আটকা আছে ফস্টারের কাছে। এর মধ্যে কিছু টাকা পাবে কিউকম এবং কিছু টাকা গ্রাহকের কাছে ফেরত যাওয়ার কথা। ফস্টার ও কিউকমের লোকজন বসে কোন পক্ষে কত টাকা যেতে পারে, সেটা যেন আগামী ১০ জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যেন প্রতিবেদন দেয়া হয়- বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তও হয়। 

এছাড়া সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম, দালাল প্লাস, এসপিসি ওয়ার্ল্ড (আত্মসাৎ করেছে এক কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা), টুয়েন্টিফোর টিকেটি ডটকম (আত্মসাৎ করেছে চার কোটি ৪৪ লাখ টাকা), র্যাপিড ক্যাশ, সহজ লাইফ অ্যান্ড লাভলি লাইফ (আত্মসাৎ করেছে কোটি টাকা), আনন্দের বাজার, থলে ডটকম ও ইউকম ডটকম (আত্মসাৎ করেছে আড়াই কোটি টাকা), আলিফ ওয়ার্ল্ড, আলেশা মার্টও একইভাবে উত্থান-পথনের অংশীদার হয় গেল বছরে।  

এদিকে দেশের ই-কমার্স সেক্টরের সামপ্রতিক সময়ে সৃষ্ট নানা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন আইন ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি না করে প্রচলিত আইন সংশোধন ও মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। 

সবশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জানা যায়, প্রতারণার মানসিকতা নিয়েই সৃষ্ট সবকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারক মালিকদের এখন দিন কাটছে কারাগারে, আর প্রতারিত-ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা রয়েছেন টাকা ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কায়।