Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

রাজনীতিতে শিষ্টাচারে ‘দলদাস’ লেখকের প্রলাপ

ফারিহা হোসেন প্রভা

জানুয়ারি ৪, ২০২২, ১০:১০ পিএম


রাজনীতিতে শিষ্টাচারে ‘দলদাস’ লেখকের প্রলাপ

রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ কলুষিত, প্রতিহিংসা, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মতো ঘৃণ্যতম ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের নেতাদের লক্ষ করে ব্যক্তিপর্যায়ে আক্রমণাত্মক, অশালীন, শিষ্টাচারবর্জিত, অশোভন ভাষার ব্যবহারও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে দেশের সাধারণ মানুষ এ ধরনের কর্মকাণ্ড, বক্তব্য-বিবৃতি আশা করে না। 

রাজনীতিতে, রাজপথে রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ড কখনো গণতন্ত্রের জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। অনুরূপ সাংবাদিক নামধারী দলদাস, দলকানাদের কর্মকাণ্ড সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিভাজন, সংঘাতময় উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে। নিকট অতীতে এ ধরনের ঘটনার বহু নজির আছে। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় শিষ্টাচার বর্জিত, অশোভন ও অশালীন বক্তব্য-বিবৃতি, প্রতিহিংসার লেশমাত্র ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠে এই সত্যের প্রতিফলন মেলে পরতে পরতে। 

ঠিক অনুরূপ তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন, রাজনীতি, কর্ম তার পিতার মতোই। মূলত একজন দলদাস মিডিয়াকর্মী কর্তৃক আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে নিয়ে আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষমূলক, সম্ভবত অন্য কারো প্ররোচনায় ধান ভানতে শিবের গীত গাইলেন এবং এই লেখক নিজেই পাগলের প্রলাপ বকেছেন তার নিবন্ধে। তিনি তার নিবন্ধে ড. হাছান মাহমুদের সমালোচনা করতে গিয়ে নিজেই শিষ্টাচারবর্জিত ভাষা ব্যবহার করে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। অথচ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ড. হাছান মাহমুদের নাম বিকৃত করে যে বক্তব্য দিলেন এবং শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন— সে সম্পর্কে কিছুই লেখেননি নিবন্ধে। তাই তার এই নিবন্ধ একপেশে, পক্ষপাত দোষেও দুষ্ট।

গত ৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার মতামত বিভাগে মহিউদ্দিন খান মোহনের পাগল পাগল মনরে আমার... শিরোনামে একটি নিবন্ধ পড়ে বিস্মিত ও হতবাক হয়েছি। নিবন্ধটি পড়ে মনে হয়েছে তিনি দলদাস, অন্ধ, দলকানা হয়ে নিজেই পাগলের মতো প্রলাপ করেছেন। তাই একজন দলদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লিখিত নিবন্ধকে নিবন্ধ না বলে পাগল নিয়ে রীতিমতো পাগলের প্রলাপ বকেছেন বলে মনে হয়েছে। যতটুকু মনে পড়ে, এই নিবন্ধের লেখক হিসেবে তিনি যত না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্ততায়। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব পদে নিয়োজিত ছিলেন। তারও আগে তিনি বিএনপি দলীয় একটি দৈনিকের সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত ছিলেন। 

এতে ধরে নেয়া যায় তিনি বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। তবে রাজনীতি করা কোনো ব্যক্তির দোষের নয়। যে কেউ যে কোনো দলের আদর্শ লালন করতে পারে, দলের কোনো পদে থাকাও দোষের নয়। সাধারণত এসব পরিচয় ধারণ ও বহন করলে তখন ওই সংবাদকর্মী, সংবাদপত্রসেবীর পক্ষে কোনো সংবাদ বা নিবন্ধ লিখলে তাতে নিরপেক্ষতা রক্ষা বা নির্মোহ বিশ্লেষণ সম্ভব হয় না। 

কারণ, একজন লেখক যখন দলকানা, দলদাস, দলের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন, যদি অন্য দলকে বা দলের কোনো নেতাকে নিয়ে লেখেন, তখন ওই লেখকের পক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার। মহিউদ্দিন খান মোহনের নিবন্ধ পাঠে অন্তত তা-ই মনে হয়েছে। তাছাড়া তার নিবন্ধে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে নিয়ে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো, কিংবা আষাঢ়ের গল্পের অবতারণা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। 

মূলত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ড. হাছান মাহমুদের নাম ব্যঙ্গাত্মকরূপে ‘হাছা মাহমুদ’ উল্লেখ করে তাকে ‘নাবালক’ আখ্যা দিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন— যা পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্য মূলত রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থি। একই সঙ্গে কোনো মুসলমানের নাম বিকৃত করে সম্বোধন করা ইসলামেরও পরিপন্থি। 

যাক সে কথা। মির্জা ফখরুলের এ ধরনের বক্তব্য প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা ড. হাছান মাহমুদের অভিমত জানতে চাইলে তিনি বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে একজন ভদ্রলোক হিসেবে জানতাম। এমন বক্তব্য তার ব্যক্তিত্বের সাথেও সাংঘর্ষিক। তখন ড. হাছান মাহমুদ উপমা হিসেবে রাস্তার একজন ভবঘুরে, পাগল প্রসঙ্গ এনে বলেছেন, একজন পাগল যখন রাস্তায় হাঁটে, তখন রাস্তার অন্যকেও তার মতোই পাগল ভাবে’— এটাই বাস্তবতা। 

অথচ ড. হাছান মাহমুদ সরাসরি মির্জা ফখরুল ইসলামকে ‘পাগল’ বলেননি। তাছাড়া ড. হাছান মাহমুদের এই বক্তব্য নিয়ে পরবর্তীতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা তার দল কোনো মন্তব্য করেছে বলে সংবাদপত্রে কোনো মন্তব্য, বক্তব্য-বিবৃতি দেখা যায়নি। তাহলে মহিউদ্দিন খান মোহনই উপযাচক, অতিউৎসাহী হয়ে এ প্রসঙ্গ টেনে এনে তার এই নিবন্ধ লিখলেন কেন, এর রহস্য বা উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলে। 

অন্যদিকে এ দেশের মিডিয়া জগত, রাজনৈতিক মহল, সুশীল সমাজের অনেকেই জানেন ড. হাছান মাহমুদকে একজন সজ্জন, বিনয়ী, ভদ্র, মার্জিত ও মানবিক মানুষ হিসেবে। যতটুকু জানা যায়, তিনি একজন পরিবেশবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষকও। এর আগে তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। তিনি দু-দুবার করোনায় আক্রান্ত হয়েও আর্তমানবতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংবাদপত্রসেবীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দাঁড়িয়েছেন দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে। দেশের অনেক রাজনীতিক, নেতাকর্মী তাকে এ ঘরানার লোক হিসেবেই জানেন। 

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হাই স্কুলে পড়াকালে ড. হাছান মাহমুদ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতি করার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করে মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুদূর প্রবাসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালেও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার প্রায় ৪৫ বছরের। 

ড. হাছান মাহমুদের ওই বক্তব্যকে শিষ্টাচারবর্জিত বলে তাকে পত্রিকার পাঠক মহলসহ দেশের আপামর মানুষের কাছে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে এ নিবন্ধে। সেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এখন কতটা শিষ্টাচারবহির্ভূত, কতটা আক্রমণাত্মক এবং অশালীন— তা হরহামেশাই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এতে সময় সময় রাজনৈতিক অঙ্গনকে ভীষণভাবে কলুষিত করা হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ থাকবেই। তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করাও দোষের কিছু নয়। কিন্তু এরও তো একটা সীমা থাকা উচিত। 

এর আগে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে সালাহ্উদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেক নেতাই বিভিন্ন ধরনের বেফাঁস মন্তব্য করার মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। রাজনীতিতে শিষ্টাচার ফেরানোর দায়িত্ব শুধু ড. হাছান মাহমুদ বা তার দল আওয়ামী লীগের একার নয়। অতিসম্প্রতি বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যেভাবে কুরুচিকর বক্তব্য প্রদান করেছেন, সে বিষয়েও বিএনপির কাছ থেকে শক্ত সিদ্ধান্ত দেশবাসী আশা করেছিল। কিন্তু তা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করা যায়নি।

একসময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে ঝোলানো সাকা চৌধুরী ‘লেজে কুকুর নাড়ায়’ বলে মন্তব্য করলেও সাকার বিরুদ্ধে বিএনপি টুঁ-শব্দও করেনি, নেয়নি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। দেশে পরিচ্ছন্ন, শান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির জন্য আওয়ামী লীগপ্রধান যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, অন্যদেরও অনুসরণ করা উচিত। তাই বিএনপি সত্যিই যদি শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে নিন্দা জানায়, তাহলে তাদের উচিত হবে আলালকে দ্রুত দল থেকে বহিষ্কার করা। 

প্রসঙ্গত অশোভন, শিষ্টাচারবর্জিত আচরণের জন্য সম্প্রতি মন্ত্রিত্ব থেকে, দল থেকে সরিয়ে দিয়ে ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা বিএনপির ক্ষেত্রে ঘটেনি। অনুরূপ অতিসম্প্রতি গাজীপুর, পাবনাসহ দেশের কয়েক স্থানে কয়েকজন মেয়রের এ রকম শিষ্টাচারবর্জিত কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের পদ থেকে বহিষ্কার ও আইনি ব্যবস্থা নিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল আওয়ামী লীগ সরকার, সেরকম দৃষ্টান্ত যদি বিএনপি স্থাপন করতে পারে, তবেই রাজনীতিতে শিষ্টাচার ফিরে আসবে।

তাছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক রহমানসহ তাদের অনেক নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অপমান করে কথা বলেন। তারেক রহমান বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হাসিনা’ বলেন। প্রসঙ্গত, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন সমবেদনা-সহানুভূতি জানাতে। কিন্তু সেদিন তাকে বাসায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনা দলদাস সাংবাদিক মোহন সাহেব কীভাবে মূল্যায়ন করবেন— এটিও প্রশ্ন থেকে যায়।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলাম লেখক