Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বিধিনিষেধে হ্যাঁ লকডাউনে না

জানুয়ারি ৯, ২০২২, ০৬:২৫ পিএম


বিধিনিষেধে হ্যাঁ লকডাউনে না

করোনায় শনাক্তের হার বেড়েছে। ওমিক্রনেও উত্তেজনা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে সংক্রমণ বাড়বে।  স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, করোনা সংক্রমণ চারশগুণ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও দেশের বেশির ভাগ মানুষ সাহস রেখেছে। সবাই সরকারের নির্দেশনার আলোকে বিধিনিষেধ মেনে প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে চান। স্কুল-কলেজে যেতে চান। কেউ চাচ্ছেন না লকডাউন। 

তারা বলছেন, এখনই স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়ি আরোপ করা প্রয়োজন, মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা; স্বাস্থ্যবিধি না মানলে প্রয়োজনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা। মাঠে সরকারের বিশেষ টিম কাজ করা। দেশের সব নির্বাচন, রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় সমাবেশ ও মেলায় নিষেধাজ্ঞা আবশ্যক। করোনা ও ওমিক্রন আতঙ্ক থাকলেও সচেতনতার মাধ্যমে মোকাবিলা প্রয়োজন। 

সমপ্রতি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংক্রমণের হার বাড়তে থাকলে আবারো লকডাউনের মতো কঠোর বিধিনিষেধ জারি হতে পারে। কিন্তু দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ কেউ লকডাউন চাচ্ছেন না। গত লকডাউনের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। শিক্ষায় এসেছে বড় আঘাত। অনেকে হারিয়েছেন চাকরির বয়স। 

এছাড়া বিচক্ষণ জনগণের একটি অংশ থেকে দাবি উঠেছে, লকডাউনের বদলে দেশে সব কর্মকাণ্ড ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দিলে ভালো হবে। সরকারি অফিসগুলো রাত ১০টা থেকে শুরু করে ভোর ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকতে পারে। মার্কেট ও শপিংমলগুলো বিকেল ৪টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকতে পারে। 

পরিবহন সার্ভিস, চিকিৎসাসেবা, আইনিসেবা, হাট-বাজার ইত্যাদি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা উচিত। এতে করে জনসমাগম হবে না। মানুষের চাপও থাকবে না। এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষও বেঁচে থাকবে। সরকারের ওপর চাপ বাড়বে না। এটি হতে পারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য মডেল। 

জানা গেছে, বাংলাদেশে করোনার অতিসংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে ২১ জনের দেহে। তারা সবাই ঢাকার। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রনের ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন হয়েছে ঢাকায় এবং সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে সারা দেশে ডেল্টার মতো ওমিক্রনও ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না। এছাড়া গত ৩ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

সেখানে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, সিদ্ধান্তগুলো আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে— মাস্ক না পরে ঘরের বাইরে গেলে জরিমানা, গণপরিহনে নির্ধারিত আসনের চেয়ে কম যাত্রী বহন, দোকানপাট-বাস-ট্রেন-মসজিদ সর্বোপরি সব জায়গায় মাস্ক পরা; না পরলে তাকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হবে বলে সেদিন জাহিদ মালেক জানান। 

এছাড়া সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সংখ্যা যেন সীমিত করা হয়; টিকার সনদ ছাড়া রেস্টুরেন্টে যেন খেতে যাওয়া না হয়, কেউ যদি যায় তাহলে সেই রেস্টুরেন্টকেও জরিমানা করা হবে— এমন সব শর্ত রেখে প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে বলা হয়।

একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ম মানলে লকডাউন দরকার হবে না। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেনের ভাষ্য, ‘শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহন সবাইকে বলা দরকার, যদি দীর্ঘদিন কাজ চালিয়ে যেতে ইচ্ছা হয়, লকডাউন যদি কেউ না চান; তাহলে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে লকডাউন দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম হয়ে উঠছে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মো. তুহিন মিয়া বলেন, ‘যে সব শিক্ষার্থী সেশনজট আর কোভিড-১৯ এর প্রথম লকডাউনের মধ্যে পড়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেছিল তাদের এখন চাকরির আবেদনের  বয়সসীমা শেষ প্রান্তে বিরাজমান করছে, অনেকের শেষ হয়েছে। আবার যদি লকডাউন হয় তারা চরম হতাশার মধ্যে পড়ে যাবে, পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হবে,     
আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।’ 

অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী  শামীম আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ বলেন, ‘সব বিধিনিষেধ শুধু শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হচ্ছে, রাজনৈতিক ও সরকারি-বেসরকারি সব কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কোনো বক্তব্য নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, করোনা ছড়ানোর জন্য শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দায়ী। বাণিজ্যমেলায় ৫০ হাজারের বেশি লোক সমাগম হচ্ছে। তাতেও কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।’

ইমরান হোসাইন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘বড়লোক ভয় পায় করোনা, আর গরিব ভয় পায় লকডাউন। লকডাউন কোনো সমাধান হতে পারে না। করোনায় বাঁচতে হবে এবং বাঁচাতেও হবে। লকডাউনের বদলে দেশে সকল কর্মকাণ্ড ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দিলে ভালো হয়। সরকারি অফিসগুলো রাত ১০টা থেকে শুরু করে ভোর ৬টা পর্যন্ত খোলা রাখা উচিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা উচিত। মার্কেট ও শপিংমলগুলো বিকেল ৪টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা রাখা উচিত। পরিবহন সার্ভিস, চিকিৎসাসেবা, আইনিসেবা, হাট-বাজার ইত্যাদি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা উচিত। এতে করে জনসমাগম হবে না। মানুষের চাপ থাকবে না বললেই চলে।’

নাগিব মাহফুজুর রহমান দিপ্ত বলেন, ‘আগেরবার লকডাউন দেয়ায় সংক্রমণ থামানো তো যায়নি, উল্টো অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এসব লকডাউনের জন্য গরিব মানুষরা করোনায় না মরলেও না খেতে পেরে ঠিকই মরবে। সংক্রমণ ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়ি করা, মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে প্রয়োজনে কঠোর শাস্তি দেয়া হোক, তবে লকডাউন একেবারেই নয়। স্বাস্থ্যবিধির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেই সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব, লকডাউন দিয়ে নয়।’ 

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দেশে টিকা বের হয়েছে। মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। জরুরিভিত্তিতে সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে সংক্রমণ কমে যাবে। লকডাউনের প্রয়োজন নেই। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, লকডাউন ছাড়াও করোনা সংক্রমণ রোধ করা যায়। এ ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করা গেলে লকডাউনের প্রয়োজন হবে না। করোনার প্রথম ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ কাজ হারায়। অস্বাভাবিক জীবন যাত্রায় পড়ে। এখন মানুষ কিছুটা নতুন করে গোছাতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে ফের লকডাউনের চিন্তা থাকতে পারে বলে আমি মনে করছি না।’ 

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। বেকারত্ব বেড়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামে। এ কারণে লকডাউনের বিকল্প হিসেবে কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে হবে। মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে সুযোগ দিতে হবে। এখন লকডাউনের চিন্তা করা যাবে না।’ 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজুর রহমান খান আমার সংবাদকে বলেন, ‘লকডাউন দিলে অবশ্যই নিম্ন আয়ের মানুষ বড় বিপদে পড়বে। বিশেষ করে ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, ভাসমান মানুষ এ শ্রেণির লোকরা অসুবিধায় বেশি পড়বে।’