Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ফের তুঙ্গে শামীম-আইভীর দ্বন্দ্ব!

জানুয়ারি ৯, ২০২২, ০৬:৫০ পিএম


ফের তুঙ্গে শামীম-আইভীর দ্বন্দ্ব!
  • ভোটের আগে দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজে আসছে না কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রেসক্রিপশন  
  • আমার জনগণ গডফাদার, চাঁদাবাজ, খুনিকে গ্রহণ করেনি: আইভী
  • প্রশাসন বাড়ি-ঘরে হানা দিয়ে ভয়ভীতির সৃষ্টি করছে : তৈমূর

ফের তুঙ্গে শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব। আগামী ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে দোষারোপের রাজনীতি। সিটি নির্বাচনের আগে এ দুজনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলটির মনোনীত মেয়রপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমর্থকরা নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত। 

কিন্তু নৌকার প্রার্থীর পক্ষে এখনো প্রচারণায় নামেননি সাংসদ শামীম ওসমানের কর্মী-সমর্থকরা। তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। সিটি ভোটের আগে শামীম-আইভীর এ দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজে আসছে না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের প্রেসক্রিপশন। 

তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়াতলে দাঁড়িয়ে যখন কেউ নৌকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, তখন দুঃখ হয়। কেউ যদি নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাদের জন্য আওয়ামী লীগের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এটাই আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

এদিকে প্রশাসন বাড়ি-ঘরে হানা দিয়ে ভয়ভীতির সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করছেন স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। আর আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়রপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বলছেন, আওয়ামী লীগ একটি বিশাল বড় দল। এখানে সবার স্থান আছে। জনপ্রিয় মানুষের যেমন স্থান আছে, তেমন বির্তকিত মানুষেরও স্থান আছে। এখানে যে টিকে থাকার সে টিকে থাকবে, যে চলে যাওয়ার সে চলে যাবে। তবে প্রকাশ্যে আসা দ্বন্দ্ব নিয়ে আজ সোমবার সংবাদ সম্মেলন করবেন স্থানীয় সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান।  

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জমজমাট নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মাঠ। আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী না কি  স্বতন্ত্রের ব্যানারে তৈমূর আলম খন্দকার, কে হবেন সিটির মেয়র। তা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে মুখিয়ে রয়েছেন স্থানীয় ভোটাররা। নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনি এলাকায় প্রতিদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন। 

তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই আইভীর ও শামীম ওসমানের  দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুজনের মধ্যে শুরু হয়েছে বাগযুদ্ধ। ফলে বিভক্তি দেখা দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে। ভোটের রাজনীতিতে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা থাকলেও আইভীকে লড়াই করতে হচ্ছে দলের খণ্ড অংশ নিয়ে। 

তবে ভোটের আগে আওয়ামী লীগের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুবিধা পাচ্ছেন স্বতন্ত্রের প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। তার পক্ষে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের একাংশ কাজ করছেন। ফলে স্বস্তিতে নেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই তাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

গতকাল নারায়ণগঞ্জে নৌকার নির্বাচনি প্রচারণায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নাসিক নির্বাচনের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই ড. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রপ্রার্থীর মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। লক্ষাধিক ভোট বেশি পেয়ে আইভী নির্বাচিত হবেন। আর বিএনপির তালাক দেয়া তৈমূর আলম খন্দকার ঘুঘু দেখেছেন, ঘুঘুর ফাঁদ দেখেননি।’ 

নগরের এক, দুই, তিন ও চার নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে সিদ্ধিরগঞ্জের সিআইখোলা এলাকায় আয়োজিত কর্মী-সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। 

নানক আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে নেতা মানবেন, তার নির্দেশ মানবেন না এমন কেহ আওয়ামী লীগের নেতা হতে পারে না।’ 

বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘তালাক দেয়া তৈমূর আলমকে ভোট দেবেন না। তৈমূর আলম দাবি করেন, তিনি বিএনপি না তাহলে আপনি কে? আপনি এখন বন্য হাতিতে পরিণত হয়েছেন।’ 

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়াতলে দাঁড়িয়ে যখন কেউ নৌকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, তখন দুঃখ হয়। কেউ যদি নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তার জন্য আওয়ামী লীগের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এটাই আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ 

আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়রপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘আমার জনগণ কখনো কোনো সন্ত্রাসী, গডফাদার, চাঁদাবাজ, খুনিকে গ্রহণ করেনি। নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। আমার নারায়ণগঞ্জের জনগণ কখনো গ্রহণ করেনি, করবেও না।’  গতকাল রোববার সকালে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে বন্দর খেয়াঘাটে প্রচারকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি ওই ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন ও ভোট চান। 

দলের নেতা শামীম ওসমানকে গডফাদার বলা প্রসঙ্গে আইভী বলেন, ‘শামীম ওসমানকে গডফাদার উপাধি আমি দেইনি। এটা তার গত ৩০ বছরের উপাধি, শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষ তা জানে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বিশাল বড় দল। এখানে সবার স্থান আছে। জনপ্রিয় মানুষের যেমন স্থান আছে, তেমন বিতর্কিত মানুষেরও স্থান আছে। সব দলের মধ্যে সবাই থাকে। আওয়ামী লীগ একটি বিশাল জনসমুদ্র, এখানে যে টিকে থাকার সে টিকে থাকবে, যে চলে যাওয়ার সে চলে যাবে।’ 

শেষ পর্যন্ত দলীয় সাংসদ শামীম ওসমানের সমর্থন পাবেন কি না, জানতে চাইলে আইভী বলেন, ‘উনি (শামীম ওসমান) দিলে দেবে, না দিলে না দেবে। আমাকে উনি অপছন্দ করতেই পারেন। এটা কোনো ব্যাপার না।’ 

তিনি বলেন, আমি আমার বড় ভাইকে (শামীম ওসমান) সম্মান দেখিয়ে বহুবারই চেষ্টা করেছি। উনি যদি ওনার দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে কিছু করার নেই। জনতা যে রায় দেবে, সেটাই রায়।’ 

নির্বাচনে ষড়যন্ত্র হবে কি না জানতে চাইলে আইভী বলেন, নির্বাচন এলেই ষড়যন্ত্র হয়। তো, ষড়যন্ত্র হবেই, ধ্বংস করে দেবে জনগণ। প্রধানমন্ত্রী জানেন, নারায়ণগঞ্জের জনগণ তার পাশে আছেন। সে কী করল, না করল, তাতে কিছু যায়-আসে না। 

আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা তার কথা বলেন, ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তার কথা বলেন। তার বিরুদ্ধে গত দিনে প্রচুর অপপ্রচার চালানো হয়েছে, বিভ্রান্ত ছড়ানো হয়েছে। ধর্মীয় ব্যাপারে উসকানি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটাতেই কাজ হবে না। আগেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। জনপ্রতিনিধি জনগণের। গত তিনবার পাস করার পর আমি বলেছি, আমি সবার ভোটে পাস করেছি। কিন্তু আমার পরিচয় আমি আওয়ামী লীগ। আমি বংশগতভাবে আওয়ামী লীগ করি, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। কিন্তু আমি কাজ করব সবার জন্য। আমি যখন রাস্তা করি তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি দেখি না। সুতরাং আমি দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করব। এখনো করছি, ভবিষ্যতেও করব। কিন্তু আমার পরিচিতি আমার জয় বাংলা।

এদিকে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন  নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি বলেন, যারা সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় নামেননি, তাদের কমিটি ভেঙে দেয়া হচ্ছে, তাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে, হুমকি দেয়া হচ্ছে। প্রশাসনের লোকজন বাড়ি-ঘরে হানা দিয়ে ভয়ভীতির সৃষ্টি করছে। এসব নিয়ে নারায়ণগঞ্জে একটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে সরকারি দল। গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুর এলাকায় নির্বাচনি গণসংযোগকালে তিনি এই অভিযোগ করেন। 

তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তার নিজ দলের এমপিদের গডফাদার বলছেন। বিষয়টি তাদের নিজস্ব ও দলীয় ব্যাপার। এখানে আমাকে জড়ানো হয়েছে, সে ব্যাপারে আমার বক্তব্য স্পষ্ট। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী তিনবার বলেছেন, তৈমূর আলম জেতার মতো প্রার্থী। গত ৫০ বছরে মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীও আমাকে ভোট দিতেন। সেলিনা হায়াৎ আইভী যদি আজকে প্রার্থী না হতেন, তিনিই আমার নির্বাচনি পরিচালনার অন্যতম দায়িত্বে থাকতেন। আমাকে ভোট দিতেন। আমার কোনো সময় গণবিরোধী ভূমিকা ছিল না। 

নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, আমি কোনো দলের ব্যানারে নির্বাচনে দাঁড়াইনি। আপনারা পত্রিকায় দেখেছেন বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো আমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তৈমূর অভিযোগ করেন, গত শুক্রবার আমার নির্বাচনি প্রচারণায় ধামগড় ইউপি চেয়ারম্যানসহ চারজন চেয়ারম্যান ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ এস এম আকরাম আমার মিছিলে ছিলেন। 

গত শনিবার রাতে ধামগড় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েছে। তার বাড়ি থেকে নিরাপত্তা প্রহরীকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার দলের ও অন্য অনেকের বাড়ি-ঘরে গিয়ে পুলিশ হানা দিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। সাদা পোশাকে পুলিশ গিয়ে বলছে, নৌকার নির্বাচন করতে হবে। ট্রাকে ট্রাকে অপোশাকধারী পুলিশ গিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।