Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

সেই সার্চ কমিটিতেই ইসি গঠন

জানুয়ারি ১৭, ২০২২, ০৭:০৫ পিএম


সেই সার্চ কমিটিতেই ইসি গঠন

দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দল, সুশীল, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কূটনীতিকসহ সব পক্ষেরই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার তাগিদ ছিল। চলমান নানা বিতর্কের মধ্যে ইসি গঠনে আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

চলমান প্রক্রিয়াকে বহাল রেখেই অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠনের নিয়ম রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। অনুমোদন পাওয়া আইনটি আইন মন্ত্রণালয় হয়ে জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন এ আইনের মাধ্যমেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি ও কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে।

গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

বিশ্লেষকদের মতে, ইসি গঠন প্রক্রিয়ার আইনের খসড়ায় উল্লেখযোগ্য বড় পরিবর্তন নেই। গত দুই মেয়াদে গঠিত প্রক্রিয়াকেই আইনি কাঠামোয় আনা হয়েছে। শুধু আইন করার দাবি মানা হয়েছে, চাওয়ার কোনো প্রতিফলন হয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নতুন আইনের খসড়া প্রসঙ্গে আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমি শুনেছি আইনটির খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এর মাধ্যমে কে এম নুরুল হুদা ও কাজী রকিবুদ্দিন আহমদের অবৈধ কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এ দুই কমিশন বাংলাদেশের ভোট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ভোটাধিকার হরণ করেছে। নীতি বহির্ভূত কাজ করে গেছে। এদেরকে এখন সরকার বাঁচানোর চেষ্টা করছে।     

একসময় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন হয়েছে, যেমন— আবু হেনা কমিশন, শামসুল হুদা কমিশন— তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সামপ্রতিককালে যারা এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। কারো উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছেন।’ 

বদিউল আলম আরও বলেন, ‘শুধু আইন করলে হবে না, যাদের রাখা হবে তাদের বিচক্ষণতা ও স্বচ্ছতাও দেখতে হবে। যোগ্যতার একটি মাপকাঠি থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে যাদের রাখা হবে যাদের নাম প্রস্তাবনায় আসবে তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে। যাতে জনগণ তাদের মত প্রকাশ করতে পারে।’

নতুন আইনের খসড়া প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ এর চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে। সংবিধানের ১১৮(১)-এ বিধান আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ আইনটি নিয়ে আসা হয়েছে। খুব বেশি বড় আইন নয় এটি। এ জাতীয় আইন যেহেতু আমরা হ্যান্ডেল করে আসছি, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন আছে। মোটামুটি সেই অনুযায়ী এটি করা হয়েছে। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে। অন্যান্য আইনে যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই। একটি অনুসন্ধান কমিটিও করা হবে, সেটাও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে। অনুসন্ধান কমিটি যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করবে। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার কারা হতে পারবেন আর কারা হতে পারবেন না তা খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘যোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা-সরকারি বা বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তা হলে কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন।’

অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘আদালতের মাধ্যমে কেউ অপ্রকৃতিস্থ হিসেবে ঘোষিত হন, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হলে, অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলন এবং সে ক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দু-বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দণ্ডিত হলে, রাষ্ট্রীয় পদে থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না।’ 

আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘যদি এর মধ্যে হয়ে যায় তাহলে হবে। আজকে অনুমোদন দেয়া হলো, হয়তো কাল-পরশু দুদিন লাগবে আইন মন্ত্রণালয়ের। তারপর যদি তারা সংসদে পাঠায়, সংসদেও তো কয়েক দিন লাগবে। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে যাবে, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। যদি হয় তো হয়ে যাবে, অসুবিধা তো নেই। আইনটি চূড়ান্ত করতে আমরা আশা করছি খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়, ছোট আইন। আইনের জন্য বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি বিধি করে দেয়া হবে। যাতে প্রক্রিয়াগত বিষয়ে বারবার আইন সংশোধন করতে না হয়।’

আইন ভাঙলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ কীভাবে হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার তো যতদূর মনে পড়ে, যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ করা হয় একই পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে। বাকিগুলো হয়তো বিধিতে উল্লেখ করে দেয়া হবে।’ 

সার্চ কমিটির বিষয়ে আইনে কী বলা হয়েছে— জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সার্চ কমিটিতে এক নম্বরে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, তিনি কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। এরপর থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পিএসসির চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিটিতে সাচিবিক সহায়তা দেবে।’

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ইসি গঠন আইন চলতি সপ্তাহেই সংসদ কার্যালয়ে পাঠানো হবে। এরপর আগামী সপ্তাহে সংসদ অধিবেশনে পাস হবে। এদিকে, সরকার চলতি সংসদ অধিবেশনেই নির্বাচন কমিশন আইন পাসের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে বলে গতকাল সন্ধ্যায় জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। 

এদিকে, গতকাল বিকেল ৪টায় বঙ্গভবনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সাথে চলমান সংলাপে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেয়। ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির শেষ সংলাপ ছিল এটি। সংলাপে আওয়ামী লীগও আইন প্রণয়নসহ ইসিকে শক্তিশালী করতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা দেয়।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ইসি নিয়োগ দেয়ার পর আবদুল হামিদও সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আসছেন। সর্বশেষ  ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে তাদের মেয়াদ, সেই হিসাবে এর আগেই নতুন ইসি নিয়োগ দিতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। চলতি সপ্তাহেই নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করবেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন আইন অনুসারে ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কাজ শুরু করেছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। 

গত ২০ ডিসেম্বর থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। সংলাপে এখন পর্যন্ত অংশ নেয়া ২৩টি দল হচ্ছে— জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামি ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বিকল্পধারা, গণফোরাম, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, গণফ্রন্ট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাপ, কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), জাকের পার্টি ও এনপিপি। 

রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), এলডিপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলীম লীগ। সংলাপকে অর্থহীন বলাসহ নানা ধরনের বাহাস করছেন দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা। সংলাপে অংশ নেয়া সব দলই অন্যসব দাবির সাথে আইন প্রণয়নের কথা বলেছে। তবে সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে কেউ আপত্তি করেনি।