Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রশাসনের উদাসীনতায় বিশৃঙ্খল কুবির ছাত্রী হল

আহমেদ ইউসুফ, কুবি

জানুয়ারি ২৫, ২০২২, ০৭:৩৫ পিএম


প্রশাসনের উদাসীনতায় বিশৃঙ্খল কুবির ছাত্রী হল

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলে প্রশাসনের উদাসীনতা এবং অপরাধের বিচারহীনতার কারণে চলছে বিশৃঙ্খল অবস্থা। এমনকি ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের আগ্রাসী আচরণের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় হল ছেড়ে মেসে পাড়ি জমিয়েছেন অনেক ছাত্রী। বিষয়টি নিয়ে অবস্থানকারী ছাত্রীরা নির্যাতন এবং সিট হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে হলটিতে অবস্থানরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের নির্যাতন, শিক্ষার্থীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, ডিজে পার্টির তালে সিনিয়র শিক্ষার্থীকে মারধর, মারধরের বিচার না হওয়া, ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে হলের ডাইনিংয়ে ফ্রি খাওয়ায় ডাইনিং বন্ধ হওয়া, হল প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে ছাত্রলীগ নেত্রীদের সিট নিয়ন্ত্রণ, অপছন্দের শিক্ষার্থীকে (ছাত্রলীগের কর্মী হলেও) হল থেকে বের করে দেয়াসহ নানা অভিযোগ-অনিয়মের বিচার না হওয়ায় বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। আর এসব সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় হল প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।

গত ২২ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে ফয়জুন্নেছা হলের ২০৯ নম্বর কক্ষে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক ও আইসিটি বিভাগের ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিফায়েত জাহান উপমার হাতে মারধরের শিকার হয়ে লোক প্রশাসন বিভাগের দশম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আয়েশা আফরিন বালিকা একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন। এ ঘটনার এখনো সুষ্ঠু কোনো বিচার না হওয়ায় এমন বিশৃঙ্খলার দৃশ্য পুনরায় সামনে আসে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই একই কক্ষে অবস্থান করলেও বিভিন্ন সময় অভিযুক্ত জুনিয়রের হাতে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে আসছেন তিনি। এ বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ ও শাখা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দকে জানানো হলেও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার রাত ৮টার দিকে হলের লকারের চাবিকে কেন্দ্রকে করে সিনিয়র ছাত্রীকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন এ ছাত্রলীগ নেত্রী। এর প্রতিবাদ করলে তখন সিনিয়র ছাত্রীর চুলের মুঠি চেপে মারধর করতে থাকেন। একপর্যায়ে এ ছাত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে হলে অবস্থানকারী অন্যান্য ছাত্রীদের সহযোগিতায় তিনি জ্ঞান ফিরে পান। 

হল ছাত্রলীগের আরেক নেত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রলীগের কমিটিতে তার (উপ-ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক) পদ থাকলেও তাকে কখনো দলীয় কোনো কার্যক্রমে দেখা যায় না। পদ ব্যবহার করে হলে সে বিভিন্ন সময় প্রভাব বিস্তার করে আসছে। 

এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হলের সিনিয়র শিক্ষার্থী ও ডাইনিং ম্যানেজার লিপি আক্তারকে ৫১০নং কক্ষে নিয়ে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে মারধর করেন শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আইভি রহমান, ছাত্রলীগ নেতা ইসরাত জাহান জেরিন, অপর্ণা নাথনসহ কয়েকজন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের টিভি রুম ও ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষে নিয়ে শাসানো হয়। এমনকি অনেককে হল থেকে বের করে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়। এছাড়া ১১৩নং কক্ষে এবং হলের টিভি রুমে নিয়মিত ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে শাসানোর অভিযোগ পাওয়া যায়।

আবার ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্রলীগ কর্মী সিসিলি জামানের জন্মদিনে রাত ৯টার দিকে হলের টিভি কক্ষে ছাত্রলীগ নেত্রী অর্পণা নাথ, জিনাত ইভার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের অন্য কর্মীরা পার্টি করছিল। এতে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা থাকায় তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছিল। বিষয়টি তাদের জানানোর পরও পার্টি ও গান বন্ধ না করে আরও উচ্চ শব্দে গান বাজিয়েছেন বলে জানান অবস্থানরত ছাত্রীরা। 

একপর্যায়ে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদকর্মী জান্নাতুল ফেরদৌস সেখানে গিয়ে উচ্চশব্দে গান না বাজানোর অনুরোধ করলে তার সাথেও দুর্ব্যবহার করেন ছাত্রলীগ নেত্রী অপর্ণা নাথ। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার দাপটে হলের ডাইনিংয়ে টাকা না দিয়ে খাবার গ্রহণের অভিযোগ আছে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে। 

পাশাপাশি হলের ডাইনিংয়ের মিল বন্ধ করা, জোরপূর্বক নেত্রীরা তাদের পক্ষে জুনিয়রদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট ও কমেন্ট করানোর অভিযোগ, নিজেদের ইচ্ছামত হলে ছাত্রী উঠানো, ছাত্রী হলে রাত ৯টার পর প্রবেশ এবং বাইরে যাওয়া নিয়ে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকলে এসব ছাত্রলীগ নেত্রী তা মানেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। 

তবে এসব বিষয়ে অবগত হওয়ার পরও কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না সে বিষয়ে সদুত্তর পাওয়া যায়নি হল প্রশাসনের কাছে। এমনকি পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর কোনো সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা কোনো বিচার না হওয়ায় তৈরি হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বিষয়টি নিয়ে হল প্রশাসনের দিকে আঙ্গুল তুলছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলাকে শাখা ছাত্রলীগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এবারের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রীর কোনো দলীয় পরিচয় নেই। ছাত্রী হলের বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আমরা এখন পর্যন্ত সেখানে সাংগঠনিক কোনো ইউনিট ঘোষণা করিনি। আমি হল প্রভোস্টের সাথে কথা বলেছি। প্রশাসনিকভাবে তদন্তসাপেক্ষে যে দোষী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি।

বিষয়টি নিয়ে ফয়জুন্নেছা হলের প্রাধ্যক্ষ মো. সাদেকুজ্জামান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট জমা দিলে সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তবে হলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বিষয়ে অস্বীকার করে তিনি বলেন এ ঘটনায় কোনোভাবে হলে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে না। হলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতেই আছে। বরং সব অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে অবগত রয়েছি। যেহেতু হল প্রশাসন রয়েছে তাই সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি সেখানে ভূমিকা রাখতে পারে না। তবে এর আগের কোনো ঘটনায় সেখানে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। আমরা হল প্রাধ্যক্ষকে বলেছি বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখার জন্য। 

রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, গঠিত তদন্ত কমিটি এবং হল প্রশাসন আমাদের কাছে রিপোর্ট পেশ করলে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এসব অনিয়মকে আমরা প্রশ্রয় দিতে চাই না।