Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

“সংস্কৃতি বনাম অপসংস্কৃতি”

মে ২৫, ২০১৬, ০১:৪৯ পিএম


“সংস্কৃতি বনাম অপসংস্কৃতি”

  বর্তমান যুগে ক্রমান্বয়িক দুটি প্রজন্মের মধ্যে ফারাক ২৫/৩০ বছর তাই ২৫/৩০ বছরে প্রতিটি পরিবারই এক উল্লেখ্য পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। প্রযুক্তিগত উন্নতি, সামাজিক প্রগতি, জীবনের মূল্যবোধ, সম্পর্কের প্রতি দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বদলাতে থাকে। বর্তমান প্রজন্মের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মীয় সম্পর্কবোধ, আচার-আচরণ, অভ্যাস, মেজাজ-মর্জি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণ প্রজন্মের কাছে বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে। যদিও, একথাও সত্যি প্রবীণ প্রজন্ম সব সময়ে ঠিক বলছে না অথবা নবীন প্রজন্মও সব সময় ভুল বলে না। যদি বিশ বছর থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত অধুনা-প্রজন্ম বলে চিহ্নিত করা যায় তবে নিশ্চিতভাবে একথা বলা যায়, এই প্রজন্মের মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘আমার জীবন আমার’ অন্য সব কিছুই তাদের কাছে তুচ্ছ। তাদের জীবনে কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপ করা চলবে না, কোনো উপদেশ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় কোনো আলোচনা গ্রাহ্য হবে না। যা কিছু সিদ্ধান্ত, একান্ত ব্যক্তিগত, সে ভুলই হোক, ঠিকই হোক, কিছু যায় আসে না। তাদের বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের প্রাথমিক অধিকার। দুর্যোধনের ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি উক্তি ছিল, ‘সুখ চাই নাই মহারাজ, চেয়েছিনু জয়, আজ আমি জয়ী।’ বর্তমান প্রজন্মও প্রবীণ প্রজন্মকে একই কথা বলছে।

সুখ-শান্তি নয়, জয়ই তাদের প্রধান কাম্য বস্তু। নারীবাদীরা সবরকম লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা করে থাকেন। তবু, দৈহিক গঠন ছাড়াও দুটি বিষয়ে, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ রয়েছে, যা অনস্বীকার্য। প্রথমত, নারী জন্মদাত্রী, পালয়িত্রী। তাই সন্তান স্নেহ ও সন্তান লালন-পালনের যে তাগিদ, মেয়েদের প্রকৃতিতে বর্তমান, পুরুষের ক্ষেত্রে সেই তীব্রতা অনেক কম। তাবৎ প্রাণীকুলের প্রকৃতির রীতি এই। দ্বিতীয়ত, সন্তানের জন্য মেয়েরা যে ত্যাগ স্বীকার করে, পিতা তা করে না। তাই সব দিক থেকে সংসারকে ধরে রাখে মেয়েরাই। প্রকৃতির নিয়মে সমঝোতা সহনশীলতা মেয়েদের মজ্জায়। তাই সংসারের দায়ভার বেশিটাই মেয়েদের ওপর বর্তায়। যদিও পুরুষের সহযোগিতা সব সময় কাম্য। প্রজন্মভিত্তিক ঝড় শুরু হয় সন্তানদের বয়ঃসন্ধির শুরুতে পৌঁছানোর সময় থেকে। আর, যতদিন পর্যন্ত না তারা বড় হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এই ঝড় থামে না। এই প্রজন্মের ঔদ্ধত্য, অবাধ্যতা, গুরুজনদের প্রতি অশ্রদ্ধা-অবজ্ঞা, বর্তমান প্রতিটি পরিবারে সাধারণ অভিযোগ। কিন্তু প্রবীণজন যদি পিছন ফিরে তাকিয়ে নিজেদের কৈশোর-যৌবনকালের স্মৃতিচারণ করেন তবে মনে পড়বে তাদের পিতা-পিতামহ-পিতামহীদের তরফে, তাদের সম্পর্কেও প্রায় একই অভিযোগ ছিল। ঔদ্ধত্যের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মে বিভিন্ন মাপকাঠিতে মাপা হয়। সবটাই আপেক্ষিকতার প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। যেহেতু আমাদের দেশ এখনও পুরোপুরি সভ্য হয়ে ওঠেনি এবং যৌনহেনস্তা, নারী নির্যাতন ইত্যাদি অবাধে চলে তাই নিজের নিরাপত্তার কারণে, একটি মেয়েকে যতটা সাবধানী হতে হয়, একটি ছেলের ততটা সাবধান না-হলেও চলে। নারী নিপীড়ন সভ্যতার কলঙ্ক। পুরুষের দ্বারাই তা ঘটে থাকে। কর্মক্ষেত্রে- বাড়িতে-পথে-ঘাটে সর্বত্র মেয়েদের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করতে হয়। আগেকার দিনে বেশিরভাগ পরিবারে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, মেয়ে সন্ধ্যের আগে ঘরে ঢুকবে। এখন সে প্রশ্ন ওঠে না। তবু বাড়ির মেয়েটিকে যদি বলা হয় ‘রাতে আটটার আগে বাড়ি ফিরো,’ তার তাৎক্ষণিক জবাব হবে, ‘ওমুক মেয়ে রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না।’ তখন কিন্তু দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে না যে, ‘ওমুক মেয়ে সাতটার আগে বাড়ি ফেরে।’

বর্তমান প্রজন্ম আত্মকেন্দ্রিক যেখানে প্রবীণ প্রজন্ম ছিল আত্মীয়-সম্পর্ক-নির্ভর। যেহেতু সভ্যতার প্রগতির সূত্রপাত ও বিস্তার প্রাথমিকভাবে ও প্রধানত সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিধিতে। তাই প্রজন্মভিত্তিক পরিবর্তনও বিশেষভাবে লক্ষণীয় সমাজের এই বৃত্তেই। বর্তমান যুগে আধুনিক প্রজন্মের উচ্চমেধাবী একটি অংশ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। দেশে পড়ে থাকছেন অনাথ পিতামাতা। সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধ পিতামাতার আশেপাশে থাকবে অদূর ভবিষ্যতে তা হয়তো গল্পগাথা হয়ে দাঁড়াবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করছে প্রাচ্যের অধুনা প্রজন্মকে। শিথিল হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। নবীন প্রজন্মের মেধাবী গোষ্ঠীর রয়েছে বুদ্ধাঙ্ক (IQ বা Intelligent Quotient), আবেগাঙ্ক (EQ বা Emotional Quotient) এবং সামাজিক বৃদ্ধিমত্তা (SI বা Social Intelligence) -এর যথাযথ ও যথার্থ সমাবেশ। যা পেশাগত পর্যায়ে তাদের পৌঁছে দিচ্ছে সাফল্যের শীর্ষে। তারা দ্রুত-কর্মী, ধৈর্যের অভাব, তাৎক্ষণিক ফল লাভে বিশ্বাসী। অপেক্ষা-প্রতীক্ষা বা ধীর পর্যবেক্ষণ তাদের স্বভাবে নেই। পেশাগত সাফল্যের পশ্চাতে ঊর্ধ্বশ্বাস-ঊর্ধ্বগতির নেশা কতটা যুক্তিযুক্ত? পরিণত বয়সে তারা আক্ষেপ-অনুতাপ করবে। নাকি, স্বস্তির অবসর যাপন করবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু রাশ টানা দরকার। কোথায় থামতে হবে, জানতে হয়। আকাশ ছোঁয়া সাফল্য অর্জন করতে ছেলে-মেয়ে উভয়েই মূষিক দৌড়ের প্রতিযোগী। কাজী নজরুল বলেছিলেন, ‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা; ক্ষুধায় সুধায় মিলে পৃথিবীর যত মহাসন্তান জন্মিছে তিলে-তিলে।’ কিন্তু বিগত প্রজন্মে ভাবা হত না, নারীরও ক্ষুধা আছে এবং পুরুষের তরফে সুধা বর্ষিত হওয়া চাই।

তাই নবীন প্রজন্মের কেরিয়ারের ক্ষুধার তাড়না খানিক স্তিমিত হওয়া আবশ্যক। এই যে নিরলস দৌড়, অতি ব্যস্ততা তা কতটা বাস্তবসম্মত ভাবার সময় এসেছে। ‘আমার জীবন আমার’ এটা তো শেষ কথা নয়।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথাও ভাবতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করার দায়িত্বতো অধুনা প্রজন্মের। তার দায় না নিলে চলবে না। ব্যক্তিবিশেষের সাফল্য মূল্যহীন যদি না সেই সাফল্য পরবর্তী প্রজন্মকে আরও উচ্চাসনে বসাতে না পারে। কাজেই অতি আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে উন্নততর সমাজ গড়তে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার সময় এসেছে। আর সে দায়ভার কিন্তু মেয়েদের না নিয়ে গত্যন্তর নেই। যেহেতু প্রকৃতিগত বিচারে মেয়েরা অনেক বেশি সমঝদার, অনেক বেশি সমঝোতায় সক্ষম। তাই এই তোয়াক্কা না করা, বেপরোয়া দৌড় তার গতি শ্লথ করার উদ্যোগ মেয়েদের নেয়া প্রয়োজন। ছেলেদের সদবুদ্ধিতে চালনা করার দায় যে মেয়েদের ওপরই বর্তায়। সে ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ যাবৎ সমাজ-সংসারের বুনিয়াদ গড়ে এসেছে মেয়েরাই। গুণগত মাপকাঠিতে, মানবিকতার বিচারে ভালোবাসা-মমতা-ধৈর্য-সহ্য-ত্যাগ সবই মেয়েদের জন্মগত প্রবৃত্তি। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে, ছেলেরা ভোগ করুক আর মেয়েরা ভুগুক। ভোগ ও ভোগান্তি দুই নিয়েই সংসার। কিন্তু ভোগান্তির সময় স্বামী যেন সর্বান্তকরণে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ান। এই মনোবৃত্তি স্বামীর মনে জাগিয়ে তোলার দুরূহ গুরুদায়িত্বও স্ত্রীর। সংসার শুধু রমণীর গুণে সুন্দর হয় না, সংসার সুন্দর করে তুলতে পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কে পুরুষকে সচেতন করে তোলার কাজটাও নারীকেই করতে হয়। স্বার্থপরতায় ছেলেরা অগ্রণী। তাই পুরুষকে শিক্ষিত, শালীন ও সংস্কৃতিমনা করে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব নারীর। জননী ও শিশুর প্রথম শিক্ষাদাত্রী হিসেবে পুত্র-কন্যাকে সমান আদর্শে মানুষ করে সঠিক প্রশিক্ষণও নারীই দিতে পারে।

মানবসভ্যতার অগ্রগতির মূল প্রোথিত রয়েছে ব্যক্তি স্বাধীনতায় তাই বর্তমান সভ্যতা নিশ্চিতভাবে দ্রুতগতিতে সাফল্যের পথে অগ্রসরী। কিন্তু খোয়া যাচ্ছে, মানুষে-মানুষে আত্মীয়তার সম্পর্ক। ব্যক্তি-স্বাধীনতার দাবি এতই ঊর্ধ্বমুখী যে, প্রবীণের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান এখন একেবারেই গৌণ। আগেকার দিনে বয়স্করা বলতেন, ‘যা পেয়েছ, তাতেই খুশি থাকো। তুমি যা পেয়েছ, অনেকেই তা পায় না।’ নবীন প্রজন্ম বলছে ‘চাই, চাই..... আরও চাই তোমার চেয়ে বেশি চাই।’ ‘আমার জীবন আমার’ এই নীতিতে নিশ্চিত আত্মবিশ্বাস বাড়ে, উচ্চাশা-উচ্চাকাঙ্খা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে। খুব ভালো। কিন্তু মানুষ তো একা নয়। সমগ্র সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হলে, একক উন্নতি কোনো কাজে আসে না। আমি, আমরা, নিজের ব্যক্তিগত উন্নতি নিয়ে এমন মগ্ন রইলাম, আমার সন্তান যে গোল্লায় গেল, তা দেখবার সময় আমার হল না, এমন ব্যক্তিগত সাফল্য, ব্যর্থতার নামান্তর।

আধুনিক দম্পতি বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় সন্তান চান না। অত্যাধুনিক কেউ কেউ একটিও চান না।তাদের কাছে সন্তান আশীর্বাদ নয়, বোঝা-ক্যারিয়ারের অন্তরায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনেক কিছু বদলায়।

কিন্তু একটি অনুভূতি কখনও বদলায় না, তা হল নর-নারীর চিরন্তন আকর্ষণ। কিন্তু অত্যাধুনিক ধ্যান- ধারণায়, বিবাহ বন্ধনের প্রতিও আস্থা কমছে। অধুনা প্রজন্ম দায়বদ্ধ হতে চায় না। স্বাধীন জীবন চায়।

সমঝোতা-সহানুভূতি বা সহমর্মিতা সব নির্বোধের প্রলাপ। যতদিন খুশি একসঙ্গে থাকা, বনিবনা না হলেই ছাড়াছাড়ি। যদিও এখন পর্যন্ত সমাজে বিপর্যয় আনার মত লিভ টুগেদার বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে না তবু আশঙ্কা হয়, দূর ভবিষ্যতে হয়তো বিবাহ-নীতিই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। সবাই যেন মুক্ত বিহঙ্গ। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে’। আমি একাই চলব, কাউকে ডাকব না। নবীন প্রজন্মের এ এক ভয়াবহ স্বপ্ন। তা রোধ করতে হবে ধর্মীয় অনুশাসন ও সচেতনতার মাধ্যমে। না হলে সামাজিক বিপর্যয় অনিবার্য।

লেখক- মো:মেহেদী হাসান(রুবেল)