Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

জিপিএ-৫ এর চাপে বাড়ছে আত্মহত্যা

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০, ০৯:৩৫ এএম


জিপিএ-৫ এর চাপে বাড়ছে আত্মহত্যা

এবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে গত বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর। পরদিন চলতি বছরের ১ জানুয়ারি গণমাধ্যমে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ। সারা দেশে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিনই বাউফল, কলমাকান্দা, বরিশাল, গোসাইরহাট ও রাজবাড়ীতে পাঁচ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেল ও জিপিএ-৫ না পেয়ে আত্মহনন করেছে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বড় ডালিমা গ্রামের মো. উরহাদ হোসেন পিইসি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন বিকেলে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছে; নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামে বার্ষিক পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় রুদ্র সরকার আলয় (১২) নামের এক শিক্ষার্থী রাতে আত্মহত্যা করেছে; বরিশাল নগরীতে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে সারিয়া আক্তার (১৪) নামে এক শিক্ষার্থী।

পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর দুপুর ১টার দিকে নগরীর কাউনিয়া ১ম গলিতে নিজ বাড়িতে এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে; জেএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় শরিয়তপুর জেলার গোসাইরহাটে ফাতেমা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

ফলাফল জানার পর নিজ ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে সে আত্মহত্যা করে; রাজবাড়ী জেলার সদর উপজেলার মিজানপুরে জেএসসি পরীক্ষায় ফেল করে মিম আক্তার (১৪) নামে এক শিক্ষার্থী, নিজ বসতঘরে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে; বরিশাল জেলার কাউনিয়া উপজেলা সদরের প্রথমগলি এলাকার বাসিন্দা সাহিদা আক্তার (১৬), জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেয়ে দুপুর ১টার দিকে নিজ বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

তার স্বজনরা জানান, নিহত সাহিদা প্রত্যাশা করেছিল জেএসসিতে জিপিএ-৫ পাবে। তবে ফলাফল দেখে জানতে পারে সে ‘এ গ্রেড’ পেয়েছে। এরপর সে বাসায় ফিরে কাঁদছিল। পরে বাসার সকলের অগোচরে রুমের দরজা লাগিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেচিয়ে ফাঁস দেয়। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাহিদাকে মৃত ঘোষণা করেন।

উপরোক্ত চরম দুঃখজনক ঘটনাগুলো পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পরদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়। এছাড়া আরো কয়েক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে জানা গেছে। প্রতি বছর পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি ফলাফল ঘোষণার পর এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে।

কেন এই আত্মহত্যা, এর দায় কার? আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাস করতে সমাজের করণীয় নিয়ে ভাবনা জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়াটা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে।

শুধু পরীক্ষায় ফেল নয়, জিপিএ-৫ না পেলেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে গত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখন ভুলতেই বসেছে পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ছাড়াও অন্য পয়েন্টে পাস করে সমাজ ও রাষ্ট্রে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। শুধু কি পরীক্ষার্থী? না তা নয়।

অভিভাবকদের মধ্যেও জিপিএ-৫ এর এক অলিখিত প্রতিযোগিতা চলে আসছে। কার সন্তান কোন গ্রেডে পাশ করেছে তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে চলে কথামালার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আর অভিভাবকদের এ প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপ নিয়ে মানসিকভাবে যন্ত্রণাময় থাকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। শুধু কি তাই?

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র পরীক্ষায় জিপিএ-৫ কেই মেধার মানদণ্ড হিসেবে মূল্যায়ণ করছে। অর্থাৎ পরীক্ষায় জিপিএ-৫ মানেই ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরি লাভে অনেকটা অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হয়। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এতে কারো বিন্দু পরিমাণ কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং শিক্ষাব্যবস্থা এখনো শতভাগ উন্নত শিখরে পৌছেনি। এখনো আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন মানে পৌছেনি যে, শতভাগ শিক্ষার্থী পাশ করবে বা জিপিএ-৫ পাবে।

কিন্তু এই বাস্তবতাকে মেনে নেবার মানসিকতা এখনো আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। শিক্ষার্থীরা তো দূরের কথা অভিভাবকদের মধ্যেও এমন মানসিকতা গড়ে ওঠেনি যে, যে কোন পরীক্ষার ফলাফলই সন্তানের মেধার শতভাগ মূল্যায়ন হতে পারে না।

যার ফলে সকল পরীক্ষার পরই পরীক্ষায় ফেল করে বা জিপিএ-৫ না পেয়ে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমাদের দেশে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেতে হলে ১০টি বিষয়ের মধ্যে কমপক্ষে ৯টি বিষয়ে এ+ পেতে হয়। আর এ+ মানেই হলো কমপক্ষে ৮০ নম্বর।

প্রতিটি বিষয়ে ৮০ নম্বর বা তার বেশি পাওয়া একেবারে সহজসাধ্য বিষয় নয়। কিন্তু ইদানিংকালে এ কঠিন কাজটিই অনেকটা সহজ। আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়।

সে বছর সারা দেশে মাত্র ৭৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। আর ২০০২ সালে পেয়েছিল ৩৩০ জন, ২০০৩ সালে ১ হাজার ৫৯৭ জন, ২০০৪ সালে ৮ হাজার ৫৯৭ জন। ধারাবাহিকভাবে এভাবে চলার পর ২০১৭ সালে জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন, ২০১৮ সালে পায় ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ এর সুনামীতে শিক্ষার্থীদের মান কি বেড়েছে? দেশের শিক্ষাবিদদের অভিমত, জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বৃদ্ধি শিক্ষার্থীদের মান বৃদ্ধি পায়নি, বরং কমেছে।

জিপিএ-৫ এর সংখ্যা যতই বাড়ছে জিপিএ-৫ এর নিচে যারা পেয়েছে তারা ততই পিছিয়ে পড়ে আরও তলানিতে চলে যাচ্ছে। দেখা যায়, শুধু এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে কলেজে ভর্তি ও নিয়মের বেড়াজালে জিপিএ-৫ প্রাপ্তরা ভালো কলেজগুলোতে লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও, যারা পায়নি তারা ভালো কলেজে ভর্তি ও আবেদন করা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে।

এছাড়া চাকরির বেলায় বেসরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই যারা জিপিএ-৫ পায়নি তারা এক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। একটা সময় শুনা গিয়েছিল ‘পরীক্ষায় পাস করা খুবই সহজ, ফেল করা খুবই কঠিন।

কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত থাকলেই হলো। তার পাস করা ঠেকায় কে?’ বর্তমানে জিপিএ-৫ এর সুনামীতে কেউ এর নিচে পেলে বা কম পেলে অভিভাবকরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। পাড়া-প্রতিবেশীরা ওই শিক্ষার্থীকে নিয়ে হাসা-হাসি করেন।

সমাজ ও পরিবার শিক্ষার্থীর মেধা ও দক্ষতা নিয়ে উপহাস করেন। সমাজ ও পরিবারের বঞ্চনা, গঞ্জনা, গ্লানি পুরোটাই বইতে হচ্ছে শিক্ষার্থীকে। ভালো ফল না করার দায় নিতে হচ্ছে তাকেই। জিপিএ-৫ না পাওয়া যেন বিশাল একটা অপরাধ এমন ব্যবহারে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।

৩১ ডিসেম্বর-২০১৯ পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনে আমার প্রতিবেশী এক ব্যক্তি তার জেএসসি উত্তীর্ণ মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুনেছি ‘তালুকদার সাহেবের মেয়ে আর তুমি একই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করো।

একই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ো, সে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে বলে তালুকদার সাহেব রাস্তায় গর্ব করে আমাকে জানালেন। তুমি কি করলে? আমি লজ্জায় মুখ দেখাবো কেমন করে?’ এভাবেই দেশের শতকরা ৫০ শতাংশ পরিবারেই তাদের সন্তানদের শিক্ষার্থীদের মানসিক নির্যাতন করে চলেছেন। একদিকে সমাজের বঞ্চনা অপরদিকে পরিবারের গঞ্জনা একটি জিপিএ-৫ না পাওয়া শিক্ষার্থীকে পুুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলে।

এর ফলে মাত্র ১৩-১৬ বছর বয়সী কিশোর বা কিশোরীরা প্রচণ্ড মানসিক চাপ অনুভব করে। একটা সময় এ চাপ থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতে পিছুপা হয় না। আমরা অবলীলায় ভুলে যাই ‘যে জিনিস সহজলভ্য সেটির মূল্যায়ন কম’।

মনে আছে কয়েক বছর আগে দেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে কৃষক বাবা তার এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করা সন্তানকে মানসিকভাবে দৃঢ় করার লক্ষ্যে ফলাফল প্রকাশের দিনই গলায় মালা পরিয়ে, সারা গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন।

প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘বর্তমান সময়ে ফেল করা বহু কঠিন একটি কাজ। সারা গ্রামে এ কঠিন কাজটি কেউ করতে পারেনি পেরেছে একমাত্র আমার সন্তান। তাই এ আয়োজন’। এটি উদাহরণ হোক তা আমার কাম্য নয়। তবে কোনো শিক্ষার্থী যদি ফেল করে বা প্রত্যাশিত ফলাফল করতে না পারে তবে সমাজ ও পরিবারের প্রথমেই উচিত ওই শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো এবং মনোবল দেয়া।

না হলে সুনামীর গতিতে যেভাবে জিপিএ-৫ বাড়ছে, সেই গতিতে আরো বাড়বে আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা! ‘পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও আত্মহত্যা’ এটি এখন একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার পন্থা খুঁজে বের করতে হবে এখনই।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এমএআই