ঢাকা
শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,
অনিক আহমেদ, গবি
মার্চ ১৮, ২০২০, ০৪:১৫ পিএম
মো. লিমন হোসেন। ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারেরর সন্তান। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ পড়ন্ত বিকেলে মাঠে গরু আনতে গিয়ে র্যাবের গুলিতে পা হারান। র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৮ এর একটি দল শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরতে গিয়ে লিমনকে একটি ব্রিজের উপর একা বসে থাকতে দেখে সন্দেহ করে। সন্দেহ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ, তারপর সন্ত্রাসী সাজানোর অপচেষ্টা।
ছোট থেকেই সংগ্রাম করে উঠে আসা লিমনের নতুন সংগ্রামময় জীবনের শুরু হয়। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ২০১৭ সালে সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে অনার্স আর ২০১৯ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে ছাপিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের একজন যুবকের শিক্ষক হয়ে উঠার গল্প সাক্ষাৎকারে তুলে নিয়েছেন তানভীর আহম্মেদ ও অনিক আহমেদ।
দৈনিক আমার সংবাদ: ছোটবেলায় কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
মো. লিমন হোসেন: যেহেতু অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের একজন সন্তান ছিলাম, স্বপ্নটাও ছিল ওই কেন্দ্রিক। তবে অনেক বড় একজন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এমন বড় মানুষ হতে চেয়েছিলাম যে মানুষের কোনো অভাব থাকবে না। পরিবারের মানুষগুলোকে সুখে রাখতে পারবো, নিজেও সুখে থাকবো। একটি সুখী জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতাম।
দৈনিক আমার সংবাদ: চরম অনিশ্চয়তার মাঝে স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটানো কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
মো. লিমন হোসেন: অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। তবুও মনের ভিতর একটা শক্তি কাজ করতো। আমার এখান থেকে বের হতে হবে, উঠে দাঁড়াতে হবে। বাবা-মায়ের কথা ভাবতাম, তাঁদের নিয়ে চিন্তা করতাম। এসবের সাথে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক, দেশবাসী, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ সবাই আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিল, অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, সাহস দিয়েছিল। সকল ধরনের মানুষ আর সংগঠনের এসব উপাদানই আমাকে বাঁচার নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সবার সাহায্য, সহযোগিতা এবং দোয়া আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এই আত্মবিশ্বাস সাথে নিয়েই নিজেকে স্বপ্নের দোয়ারে দাঁড় করেছি বারবার।
দৈনিক আমার সংবাদ: র্যাবের গুলি খাওয়ার পরে মামলায় ফেঁসে যাওয়া বিষয়টা কিভাবে দেখছেন?
মো. লিমন হোসেন: র্যাব এসে যখন আমার কলার ধরে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা চালায় তখনই বলেছিলাম আমি একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান। এখানে গরু চরাতে এসেছি। আমি একজন ছাত্র, আমি নির্দোষ স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন। তবুও অন্যায়ভাবে গুলি করা হয়েছিল। গুলি করা শেষে তাদের অন্যায়, অপকর্ম ঢাকার জন্য মামলা দিয়ে আমাকে মিথ্যা হয়রানি করেছে। আমার উপর চরম অন্যায় করা হয়েছিল। আমি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চরম জঘন্যতার শিকার। শুধু একটা কথাই সবসময় ভাবতাম, সত্যের কখনো পরাজয় হয় না। সত্য একদিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নামে জড়িয়ে যাওয়া মিথ্যা কলঙ্কটাকে ছুড়ে ফেলবেই। সত্যি আজ সত্যটা আমার জন্য সত্যি হয়ে ফুটেছে। শুধু মাঝখানে আমার জীবনটাকে দুঃসাধ্য করে তুলেছিল।
দৈনিক আমার সংবাদ: রাষ্ট্রীয় হয়রানি, দারিদ্র্য এবং মানসিক প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন কিভাবে?
মো. লিমন হোসেন: আমি গুলিবিদ্ধ পা নিয়ে অসুস্থ ছিলাম প্রায় সাত মাস। ওই সাত মাস অসুস্থ আবার প্রিজন সেলেও বন্দি থাকতে হয়েছে। এসবের জন্য আমার জীবন থেকে ১ বছর হারিয়ে যায়। এসময় পড়াশোনা করতে পারিনি এবং ভবিষ্যতে পড়াশোনা করতে পারবো কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ ছিল। কিন্তু মানুষজনের এতো ভালোবাসা আর সাহায্য পেয়েছিলাম যে আমাকে পড়াশোনায় ফিরে আসতে বেগ পেতে হয়নি। দেশের সর্বস্তরের মানুষ আমাকে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। বিশেষ করে প্রথম আলো এবং গণস্বাস্থ্যের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। এই দুইটা প্রতিষ্ঠানের অবদান সবচেয়ে বেশি। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং সবার সাপোর্ট আমাকে সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
দৈনিক আমার সংবাদ: পড়ার বিষয় হিসেবে আইনকে কেন বেছে নিলেন?
মো. লিমন হোসেন: আমার মাকে শুধু ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। বিষয়টা আমাকে বিমর্ষ করে দিয়েছিল। আমিও আইনের সুশাসনের অভাবে বড় ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হয়েছি। এসব ঘটনা আমাকে আইন পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ভাবিয়ে তুলছিল একজন সঠিক আইনের মানুষ হয়ে মানুষকে সাহায্য করতে, ন্যায় বিচার করে পাশে থাকার জন্য। এসব কিছু থেকে মূলত আইনে পড়ার ইচ্ছে হয় এবং এই বিষয়ে পড়াশোনা করি।
দৈনিক আমার সংবাদ: গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয় আইনে ভর্তি হওয়ার অনুভূতি কেমন ছিল?
মো. লিমন হোসেন: আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না কতটা খুশি হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু কোথাও সুযোগ হলো না। শেষে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার আমাকে এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেন। আমি এই মানুষটাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করতে পারবো না। এখানে ভর্তি হতে পেরে অসম্ভব খুশি হয়েছি আমি। এক কথায় অসাধারণ অনুভূতি ছিল আমার।
দৈনিক আমার সংবাদ: অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আপনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিষয়টা ভাবতে কেমন লাগে?
মো. লিমন হোসেন: আমি যে শিক্ষক হবো সেটা কখনো কল্পনাও করতে পারি নাই। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরকে কিভাবে ধন্যবাদ দিব তা আমার জানা নাই। শিক্ষক হওয়ার পেছনে উনার অবদান সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল প্রমুখ উঁচুমানের ব্যক্তিরা পথ দেখিয়েছিলেন। আমি মনে করি, শিক্ষক হওয়ার জন্য যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়। হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও আমি সেভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছি। এই গড়ে তুলাটাই আমাকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে সাহায্য করেছে।
দৈনিক আমার সংবাদ: র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন এখন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এই অনুভূতিটা কেমন?
মো. লিমন হোসেন: এই প্রশ্নটা আমার মাকে জিজ্ঞেস করলে বোধ হয় বেশি ভালো হতো। কারণ মায়ের অনুভূতিটা আমার থেকে হাজার গুণে বেশি। গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত মহিলা। এসব বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষদের গর্ভের সাথে যেভাবে বলে বেড়ায় তাতে মনে হয় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হয়েছি। তখন চোখে পানি এসে যায়। মায়ের এই গর্বের অনুভূতিটাই আমার হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়। আমার সুখ এখানেই।
দৈনিক আমার সংবাদ: শিক্ষক হিসবে কেমন সহায়তা পাচ্ছন, সবাই কীভাবে গ্রহণ করছে?
মো. লিমন হোসেন: ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে এখানে যোগদান করি। অল্প দিনেই সবাই খুব আপন করে নিয়েছে। সবাই আমার বিষয়টা জানে। সবাই খুবই সাহায্য করে। এদিক থেকে বলতে পারি সবাই বেশ ভালোভাবেই আমাকে গ্রহণ করেছে।
দৈনিক আমার সংবাদ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. লিমন হোসেন: আপাতত শিক্ষক হিসবে নিজেকে ধরে রাখতে চাই। সামনে জুড়িশিয়াল পরীক্ষার ফলাফল আসবে সেটা দেখার পরে নতুন করে ভাববো। তবে আমি যাই হই না কেন আইনের সুশানের জন্য আমি লড়াই করে যাবো। আমার মতো আর একটা লিমন যেন তৈরি না হয় তাঁর জন্য লড়াই করবো।
দৈনিক আমার সংবাদ: অদম্য লড়াই করে যারা এগিয়ে যাচ্ছে এবং যারা এগিয়ে যেতে চাই তাদের সম্পর্কে কি বলার আছে?
মো. লিমন হোসেন: তাঁদের বলবো যতো কঠিন বাধাই আসুক না কেন থেমে যেও না। থেমে গেলে তো হেরে গেলে। পড়াশোনা করতে হবে, এটার বিকল্প কিছু নাই। সবসময় বুকে সাহস রাখতে হবে। কখনো অপশক্তি দেখে ভয় পেলে চলবে না। সর্বদা আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। কারণ, আত্মবিশ্বাস এগিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আমারসংবাদ/এমআর
