Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

শ্রেণি বৈষম্যের প্রতিযোগিতায় ‘অসুস্থ্য সমাজ’

আলী হোসেন

জুন ২৫, ২০২০, ০১:০৩ পিএম


শ্রেণি বৈষম্যের প্রতিযোগিতায় ‘অসুস্থ্য সমাজ’

একটি জনপ্রিয় নাট্য চরিত্রের নাম ‘ফিরকি’। সম্ভ্রান্ত এবং ধর্ণাঢ্য পরিবারে জন্ম হলেও ফিরকি চরিত্রের মেয়েটিকে নবজাতক অবস্থায় কুড়িয়ে পায় লক্ষ্মী নামক চরিত্রের অভিনেত্রী এক হিজড়া। কোলে পিঠে করে শিশু ফিরকি মেয়েটিকে বড় করেন লক্ষ্মী। তাকে হিজড়াদের মত যেন বড় হতে না হয়, সেজন্য মানুষের মত মানুষ হিসেবে বড় করে তোলার প্রতিজ্ঞা নেয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের বয়স হলে পালিত মা’ লক্ষ্মী তাকে স্কুলে নিয়ে যায় ভর্তি করাতে। কিন্তু হিজড়ার মেয়ে বলে তাকে ভর্তি করেনি। এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে ঘুরতে থাকেন, তবুও মেয়েকে ভর্তির সুযোগ পায় না। বরঞ্চ নানা অপমান সহ্য করতে হয় হিজড়া পরিবার বলে মা ও মেয়েকে। শেষে মেয়েটি একটি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায় এবং এক ক্লাস, দুই ক্লাস করে ফিরকি মেয়েটি হিজড়াদের পরিচয়ে মেট্রিক পাশ করে।

মেয়েকে ভর্তি করাতে গিয়ে যখন মা’ লক্ষ্মী বিভিন্ন তীর্যক ভাষায় অপমাণিত হচ্ছিল এবং বলা হচ্ছে তোদের ছোট জাত। তোরা আবার পড়ালেখার দরকার কী? তখন, মেয়েটি মাকে প্রশ্ন করে মা’ জাত কী গো? মা’ তখন মেয়েকে উত্তর দেয়, জাত হচ্ছে এ সমাজে বসবাসকারী উঁচু শ্রেণির মানুষের তৈরি করা একটি বেড়া বা দেয়াল। যেখানে ধর্ণাঢ্য পরিবারগুলোর মানুষেরা জাত বেজাত বলে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। গরীবদের জাতের বেড়াজালে ফেলে তাদের নাগরিক ও সামাজিক মর্যাদা হরণ করে। এতক্ষণ যে চরিত্রটি বললাম সেটি হচ্ছে, হিজড়াদের জীবনধারা নিয়ে ভারতীয় চ্যানেল জি-বাংলায় সম্প্রচারিত একটি জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘‘ফিরকি”। আমার মেয়েদের কাছে ফিরকি চরিত্রটি বেশ প্রিয়। উপরে ফিরকি চরিত্রের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরাসহ বাংলা ভাষাবাসী অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জীবনধারার সাথে বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা ও কৃষ্টি কালচারের অনেক মিল রয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধূলা, পারিবারিক আচার অনুষ্ঠান অনেক কিছুর সাথে মিলে যায় আমাদের দু’দেশের সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের সমাজে ধনীক শ্রেণির লোকজনের নিজস্ব তৈরি করা জাত বেজাতের সংস্কৃতির আদলে সমাজের মধ্যে নানা বিভাজন তৈরি করে রাখা হয়েছে। এতে সমাজে বসবাসকারীদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পক্ষান্তরে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা, বাড়ছে হানাহানি ও শ্রেণি বৈষম্য।

একবিংশ শতাব্দীর মানব সভ্যতার মাঝে এখনো শ্রেণি বৈষম্য যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজের বৃহৎ নিম্ন শ্রেণির মানুষদের এখনো যেন মানুষ ভাবার সচেতন দৃষ্টি ভঙ্গি অনুপস্থিত।

সমাজে অনেক শিশু আছে যারা প্রতিদিন না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। ওরা যখন আমাদের কাছে হাত পাতে তখন আমরা ওদের সাথে খারাপ আচরণ করে থাকি। ৭০০ কোটির এ বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ০১ জন থাকে অনাহারী, সেখানে উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বে ক্ষুধা দারিদ্র্যতা আমাদের নিত্য সঙ্গী। অথচ আমরা একটু সচেতন হলে, মানসিকতার পরিবর্তন করলে ও মানবতাবাদী হলে এ অবস্থার সামান্যতম হলেও উন্নতি সম্ভব হতো।

বিনা কাজে মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছি, ফেসবুক চালাচ্ছি, ধূমপান করছি, অহেতুক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে টাকা নষ্ট করছি। আমরা কী পারি না, ওদের একটু সাহায্য করতে?

বাংলাদেশের বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গের সমমর্যাদা দেওয়াসহ ছোট ছোট উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির লোকজনের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাদেরকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যেই নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। যাতে বাংলাদেশে বসবাসকারী কোনো শ্রেণির মানুষের সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট না হয়। আমাদের সমাজে প্রতিটি স্তরে স্তরে বিভাজন তৈরি করে রেখেছে একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ বা সমাজপতিরা। যে সমাজে একসময় নানা চুতোয় ছোট জাতের পরিবারকে একঘরে করে রাখার ঘোষণা দিতো গ্রাম্য মোড়ল বা কথিত সমাজপতিরা। এখনকার রাষ্ট্রীয় এবং বিচার ব্যবস্থায় কোনো সমাজে কাউকে একঘরে করে রাখা বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কোনো সুযোগ নেই।

পৃথিবীর দেশে দেশে এমনকি একই সমাজে শ্রেণি বৈষম্য, উঁচু-নিচু, সাদা আর কালো জাত, ছোট জাত ইত্যাদি কারণে দাঙ্গা হাঙ্গামা, যুদ্ধ বা সংগ্রাম একেবারে কম হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই সংগ্রাম করেছেন বর্ণবাদ বিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। সাদা জাতের বিরুদ্ধে কালো জাতের মানুষদের এই সংগ্রামে শেষপর্যন্ত কালো মানুষেরাই জয়ী হয়েছে। অথচ সাদা-কালো, জাত বেজাত, উঁচু-নিচু সবই একই স্রষ্টার সৃষ্টি।

১৯৪৭ সালে পৌঁনে দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান। এরপর ধর্মীয় দ্বি-জাতি ত্বত্তের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থার জাঁতাকলে পরিচালিত হচ্ছিল। ২৪ বছরের শাসনে বাংলাদেশের মানুষ সর্বক্ষেত্রে শ্রেণি বৈষম্যের শিকার হয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, চাকুরীর নিশ্চয়তাসহ কোনো ক্ষেত্রেই পূর্ব বাংলার মানুষ তার ন্যায্য অধিকার পায়নি। প্রতিটি পদে পদে অধিকার হারানো মানুষগুলোর ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে কৈশর জীবন থেকে সংগ্রাম শুরু করেন, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া সেই ছোট্ট খোকা শেখ মুজিবুর রহমান। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে করতে একসময় তিনিই হয়ে যান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে উপাধি লাভ করেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই নয়মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করেন বাঙালি জাতি। বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় লাল সবুজের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল শোষন বঞ্চনামুক্ত এবং শ্রেণি বৈষম্যমুক্ত একটি সুখি সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। যার জন্য তিনি জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই আজীবন লালিত স্বপ্ন বৈষম্যহীন একটি সমাজ ব্যবস্থা আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই সমাজে এখনো ধনীক শ্রেণির কাছে নির্যাতিত গরীব শ্রেণির মানুষেরা। সমাজে একশ্রেণির মানুষের কাছে অঢেল টাকা, তারা বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। আরেকদিকে অর্থাভাবে ক্ষুদায় কাতর লাখো মানুষ। প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ে শিক্ষা থেকে। শিক্ষিত হাজারো বেকার যুবক পরিবারের বোঝা হয়ে বিপথে পা বাড়াচ্ছে। শেষে হতাশাগ্রস্ত জীবন নিয়ে এসব টগবগে যুবকেরা নেশার জগতে পা বাড়ায়। ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চিত ভবিষ্যত।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য দূরী করণে সরকারের পাশাপাশি ধনীক শ্রেণির মানুষজনকে এগিয়ে আসতে হবে। ভোগ বিলাসে পড়ে না থেকে সামাজিক এবং ধর্মীয় দায়বদ্ধতা থেকে ধনীদের কিছু একটা করতে হবে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য বেশি বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাদেরকে হতাশাগ্রস্ত জীবন থেকে বের করে আনতে হবে। এর মাধ্যমে সমাজে আয় বৈষম্য কমবে। বেকার যুবকরা তাদের পরিবারের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে। এতে সমাজ থেকে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা দূর হবে এবং অপরাধ কমবে। তাহলেই কেবল সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রেণি বৈষম্য কমে আসবে এবং বাংলাদেশ একটি সুখি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।

লেখক: সাংবাদিক

আলী হোসেন, লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি (দৈনিক আমার সংবাদ)

ahossain640@gmail.com

আমারসংবাদ/এমআর