Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

শেখ কামাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক

আগস্ট ৪, ২০২০, ১১:১৫ এএম


শেখ কামাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের ৬৯তম জন্মদিন পালিত হয়েছে গত ৫ আগস্ট। অন্যদের মতো সেদিন এ উপলক্ষে ৬৯ কেজি ওজনের কেক কাটা হয়নি। এ বদ-কালচারটি বঙ্গবন্ধু পরিবারে নেই। সেদিন বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সেগুলোতে শেখ কামালের সাদাসিধা জীবন, অনেক অজানা তথ্য ও তার বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর প্রয়োজন রয়েছে।

কারণ আমাদের দেশের কিছু মহল থেকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেক আজগুবী অসত্য তথ্য নিরবিচ্ছিন্ন ও পরিকল্পিতভাবে প্রচার করা হয়েছে, জনমনে তাদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যে। তারা সফল হয়নি। কিন্তু তাদের প্রচার এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইন্টারনেটে ঢুকলে এসব অপপ্রচার এখনো পাওয়া যায়, বিশেষ করে পাকিস্তান-বেসড্ ওয়েব পেজগুলোতে।

এসব অপপ্রচারের জবাবও অনেকে দিচ্ছেন, সত্যকে তুলে ধরছেন, কিন্তু তা খুব সংগঠিতভাবে দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। অথচ বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে সত্যকে প্রকাশ করার জন্য। তবে শেখ কামাল সম্পর্কে যারা লিখেছেন বা আলোচনা করেছেন তারা একটি সত্য এখনো প্রকাশ করেননি। এটি তাদের না জানার কথা নয়। হয়তো তার অনেক অবদানের ভিড়ে সেটি তারা উল্লেখ করে ওঠতে পারেননি। সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন শুরুর কথা।

আমার ও আমার বন্ধুদের সৌভাগ্য যে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষ স্নাতকে আমরা শেখ কামাল, আমাদের কামাল ভাইকে, সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন সোশিওলজিতে আর আমরা অন্যান্য বিভাগে। তাই তিনি আমাদের ক্লাশমেট ছিলেন না, ছিলেন ব্যাচমেট। সৌভাগ্য বলছি এজন্য যে তিনি ছিলেন সেই সময় আক্ষরিক অর্থেই একজন লিজেন্ড।

কিন্তু তা শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান বলেই নয়। তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে ঊনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানে মাঠ পর্যায়ে রাজপথে অংশ নিয়েছেন। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে তিনি অনায়াসেই ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা হতে পারতেন। কিন্তু উপর্যুপরি অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তা হননি। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তাও অন্যরা জোর করাতে। তিনি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত সক্রিয় কর্মীর মতো রাজপথে মিছিল করেছেন, শ্লোগান দিয়েছেন, পুলিশের তাড়া ও কাঁদানে গ্যাস খেয়েছেন, আশেপাশের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি মিলিটারি বন্দী করার পর ছোটভাইকে নিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করেছেন। অন্যদের সাথে কঠিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নৈপুণ্যের জন্য আর্মির ওয়ারটাইম কমিশন পেয়েছেন। এরপর এইড-দ্য-ক্যাম্প (এডিসি) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে সহায়তা করেছেন।

বিজয়ের পর সামরিক বাহিনীতে না থেকে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে ফিরে এসেছেন। লেখাপড়ায় মনোনিবেশের পাশাপাশি ছায়ানটে গিয়ে সেতার বাজানো শিখতেন। তিনি ভালো সেতার বাজাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তুমুল উৎসাহ জোগাতেন। নাটক পাগল ছিলেন। তখন সদ্য স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাটকের গতানুগতিক ধারার বিপরীতে একটি নব নাট্য আন্দোলন চলছিল যেখানে জবরজং পোশাক, ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাক সিন ইত্যাদির বালাই ছিল না, কিন্তু উপস্থাপনার চমৎকারিত্ব ছিল। থিয়েটার, নাগরিক ইত্যাদি নতুন নাট্য দলের পাশাপাশি শেখ কামাল এ আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য ‘নাট্যচক্র’ ও ‘ঢাকা থিয়েটার’ নামে গ্রুপ থিয়েটার দল গঠনে হাত লাগালেন। নিজে ভালো খেলতেন। বিশেষ করে ক্রিকেট ও বাস্কেট বলে ফার্স্ট ডিভিশন খেলোয়ার ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে কারা ভালো ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, বাস্টকে বল, হকি খেলছে তা লক্ষ্য রাখতেন এবং তাদের উৎকর্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতেন। খেলার জগতে ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ নামে নতুন ঘরানার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমন একটি অফুরন্ত প্রাণশক্তির গতিময় বর্ণিল প্রতিভাধর ছাত্রটি আবার ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র ও সদালাপী। ভাবা যায়! তিনি তো লিজেন্ড হবেনই। এমন একজন লিজেন্ডের সহপাঠী হওয়া অবশ্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার।

একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তাকে আমরা ‘কামালভাই’ ডাকতাম কারণ তিনি ছিলেন আমাদের তিন বছরের বড়। না, তিনি খারাপ ছাত্র ছিলেন না যে উপর্যুপরি ড্রপ দেয়ার কারণে আমাদের সাথে চলে এসেছেন। বরং কারণটা ছিল কামাল ভাইয়ের স্কুল জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই বঙ্গবন্ধুকে জেলে কাটাতে হয়েছে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষটি যখন একটানা জেলে থাকে তখন চরম আর্থিক দুর্দশায় নিপতিত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটবে এটাই তো স্বাভাবিক। পাকিস্তানি মিলিটারি শাসকদের সেটাই ছিল লক্ষ্য। সে কারণেই কামালভাইর জীবন থেকে তিনটি শিক্ষা-বছর হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এজন্য কামালভাইর কোনো খেদ ছিল না। এজন্য আমরা তাকে অন্তর থেকেই আরো শ্রদ্ধা করতাম।

কামালভাই তার অন্যান্য কাজের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ উন্নতকরণের জন্য যে কাজটি শুরু করেছিলেন তা বর্তমানেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং কিছুটা হলেও আলোচনার দাবি রাখে। সেই সময় যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা শিক্ষক ছিলেন তারাও নিশ্চয়ই এই আলোচনায় আরো তথ্য যোগ করতে পারবেন। কামালভাইয়ের নেতৃত্বে এ আন্দোলনের মূলকথা ছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রথিতযশা শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠ নিচ্ছেন। এর পাঠ্যসূচি ও শিক্ষকবৃন্দ যেমন উন্নত, শিক্ষার পরিবেশটুকুও তেমনি উন্নত হওয়া চাই।

পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব সবটুকুই প্রশাসনের এমন ভাবলে চলবে না, শিক্ষার্থীদেরও এ ব্যাপারে অনেক কিছু করার আছে। তিনি এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আহ্বান জানালেন প্রতিটি বিভাগ থেকে সবচেয়ে মেধাবী তিনজন করে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের। কিন্তু এতে কোনো জোরাজুরি নেই। যদি কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী এতে যোগ দিতে না চান তাহলে তার পরের মেধাবী জন যোগ দেবেন। তিনিও না এলে তার পরের জন। আর স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হলো প্রতি বিভাগ থেকে একজন করে সবচেয়ে মেধাবী মুখ নিয়ে। এই প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থীরা পুরুষ না মহিলা তা বিবেচ্য নয়। সবার অধিকার সমান। কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতি মাসে একবার টিএসসিতে বৈঠক বসবে। আর ষ্টিয়ারিং কমিটি বসবে প্রয়োজনমতো, তবে দু’সপ্তাহে অন্তত একবার।
আবহাওয়া প্রতিকুল না থাকলে সভা বসার ব্যাপারে কামালভাইয়ের প্রথম পছন্দ ছিল খোলা মাঠ। আমরা এভাবে কলা ভবন, কার্জন হল, সাইন্স এনেক্স ও টিএসসির লনে ঘুরে ঘুরে অনেকবার বসেছি। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা বাদাম আর চা ছিল আমাদের সভার নিত্যকার মেন্যু। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় পার হওয়াতে কমিটির সবার নাম মনে নেই। তবে আমাদের কার্জন হল এলাকার কয়েকজনের নাম মনে আছে। যেমন ফিজিক্সের রকীব ও ইকবাল, এপ্লাইড ফিজিক্সের তরীকুল, কেমিস্ট্রির জাহাঙ্গীর ও আলাউদ্দিন, বোটানির সানি, বায়োকেমিস্ট্রির রহমত ও মোসাদ্দেক, সয়েল সাইন্সের এনায়েত, জিওলজির বদরুল, স্ট্যাটিসটিক্সের খন্দকার, ইন্টারন্যাশনাল রিলেসন্সের আহমেদ আনিসুর রহমান, ইকোনমিক্সের শিবলী, আইনের মকবুল প্রমুখ। এরা সবাই ছিল যার যার বিভাগের প্রথম শ্রেণীতে প্রথম বা দ্বিতীয়। আমি এরকম মেধাবী ছিলাম না। কিন্তু আমার বিভাগের বন্ধুরা স্টিয়ারিং কমিটিতে ফার্মেসি বিভাগের প্রতিনিধিত্বের জন্য আমাকেই মনোনীত করেছিল।

শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। তখন অধিকাংশ মেধাবীরা রাজনীতি বিমুখ ছিলেন না। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি তো বটেই, এমনকি স্টিয়ারিং কমিটিতেও অধিকাংশই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং ছাত্রলীগের পাশাপাশি ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজবাদী ছাত্র জোট প্রভৃতি সংগঠনের সদস্য। কিন্তু অন্য ছাত্র সংগঠনের হলেও তাদের সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে কামালভাই বা অন্যদের কারো কোনো সমস্যা হয়নি। এই আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি। তখন বাণিজ্য অনুষদের সবগুলো বিভাগ ছিল কলাভবনে অবস্থিত। ক্লাশরুম খালি না থাকাতে বিভিন্ন বিভাগের অনেক ক্লাশ সময়মতো হতে পারতো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগ অনেক জায়গা অপ্রয়োজনে দখল করে রাখলেও অনেকের প্রয়োজনীয় জায়গাটুকুও ছিল না। কার্জন হলের বিভাগগুলোরও অনেকের এই সমস্যা ছিল। মনে আছে, আমাদের ফার্মেসি বিভাগেই প্রয়োজনীয় ক্লাশরুমের অভাবে আজাদ স্যার, অর্থাৎ পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ডঃ এ কে আজাদ চৌধুরী, আমাদের ফার্মেসি বিভাগের ক্লাশ নিতেন বিভাগের সামনের তমাল গাছটির নিচে। ছাত্র সংখ্যার তুলনায় আবাসিক হলের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল না। সদ্য স্বাধীন দেশটির অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেও যথাসম্ভব জরুরিভিত্তিতে অবকাঠামো সম্প্রসারণের জন্য শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের দাবিটি তাই অত্যন্ত জোরালো হয়েছিল।

এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার চাইতে অনেক পরিচ্ছন্ন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ভবনের দেয়াল ও করিডোরে কোনো দেয়াল লিখন বা শ্লোগান চোখে পড়ে না। এখন শ্লোগান লেখা হয় মূলত বাইরের দেয়ালে। কিন্তু সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, টিএসসি, আবাসিক হল ও রাস্তার পাশের দেয়ালগুলো ছিল দেয়াল লিখনে ও পোস্টারে কন্টকিত। এমনটি শ্রেণীকক্ষের ভেতরেও শ্লোগান লেখা বাদ ছিল না। সরকারি দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে সব ছাত্র সংগঠনই তাদের বক্তব্য প্রচারের জন্য সভা-মিছিলের পাশাপাশি দেয়াল লিখনের ওপর জোর দিত। এসব লেখা সবগুলোই যে খুব রুচিসম্মত ছিল তাও নয়। ফলে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ও দেয়ালগুলোর চেহারা ছিল কদর্য।

এটি যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং তা কিছুটা পরিপাটি থাকাই বাঞ্ছনীয় সে বোধটুকু অনেকের মধ্যেই ছিল অনুপস্থিত। শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন থেকে সব সংগঠনকে অনুরোধ করা হয়েছিলো সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষার্থে ভবনগুলোর দেয়ালে বা অভ্যন্তরে পোস্টার না লাগাতে বা দেয়াল লিখন না করতে। শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন প্রশাসনের কাছে দাবি করলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানে স্থানে বড় বড় বোর্ড নির্মাণের যাতে সবার শ্লোগান লেখা যায় বা পোস্টার লাগানো যায়। এতে সৌন্দর্য রক্ষার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরাও বোর্ডগুলো থেকেই কোন সংগঠনের কী বক্তব্য তা সহজেই জেনে নিতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তখন বড় না হলেও বেশ কয়েকটি পাকা বোর্ড বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, যার দুটি এখনো কার্জন হল এলাকায় রয়েছে। কলা ভবনের সামনের বটতলার ঐতিহাসিক মূল্যের কথা ভেবে এখানে প্রায়ই বিভিন্ন সংগঠনের সভা হতো। সভা চলাকালীন মাইকের আওয়াজে কলা ভবনে ক্লাশ করা ছিল খুবই অসুবিধাজনক। শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল ক্লাশ চলাকালীন সময়ে এখানে সভা না করে মল চত্ত্বরে সভা-সমাবেশ করার জন্য।

বলা হয়েছিল মল চত্ত্বরে থাকবে উন্মুক্ত মঞ্চ এবং এম্ফিথিয়েটারের মতো সিমেন্ট নির্মিত গোলাকার বসার ব্যবস্থা। এজন্য উপাচার্যের বাসভবনের বিপরীতে মল চত্ত্বরে স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল এবং ছাত্রলীগসহ কয়েকটি সংগঠন সেখানে বেশ কিছুদিন সভাও করেছিল। কিন্তু এরপর থেকে এসব অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে আবার বটতলাতে ফিরে আসতে থাকে। তখনো অপরাজেয় বাংলা নির্মিত হয়নি। শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন থেকে দাবি করা হয়েছিল মল চত্ত্বরের মাঝামাঝি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের। এখানেও থাকবে একটি মঞ্চ এবং এর চারপাশের বাগান শোভিত সবুজ প্রাঙ্গণে দর্শক-শ্রোতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। দাবির প্রেক্ষিতে প্রশাসন থেকে তার উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল।

তখনকার মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর স্থাপন করা সেই ভিত্তি প্রস্তরটি এখনো জরাগ্রস্ত অবস্থায় বাণিজ্য ভবনের পশ্চিমে মল চত্বরে কোনোমতে টিকে আছে। নামের সাথে মিল রেখে তখন মল চত্ত্বরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে সত্যি সত্যিই বাগান করা হয়েছিল। লাগানো হয়েছিল অনেক কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, কণকচাঁপা, কামিনী, শিউলি ও মহুয়ার গাছ। এর মাঝের রাস্তাগুলোর দু’ধারে লাগানো হয়েছিল সারিবদ্ধ ঝাউ গাছ। বাগান পরিচর্যার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল চারজন মালি। কিন্তু কালক্রমে বাগানটি টেকেনি।

শাহবাগের ফুলের দোকানীরা তোড়া বানাবার জন্য প্রতিদিন ভোরে এখানকার ঝাউ গাছগুলোর ডাল ভাঙতো নির্বিবাদে। এছাড়া আরেক উপদ্রব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারিদের গৃহপালিত অগুণতি গরু-ছাগলের এই বাগানে অবাধ বিচরণ। এখন মল চত্ত্বরে সেই সময়কার মাত্র কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, কণকচাঁপার গাছ টিকে আছে। আর আছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটিমাত্র মহুয়ার গাছ। মল চত্ত্বরে বক্তৃতা মঞ্চ, এম্ফিথিয়েটার ও ভাস্কর্য নির্মিত না হলেও পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অপরাজেয় বাংলা নির্মাণ করা হয়েছে, এম্ফিথিয়েটার নির্মিত হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের সামনে, নতুন নতুন অনেকগুলো ভবন ও হল তৈরি হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উন্নতি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের দেয়ালগুলো ছাড়া একাডেমিক ভবনগুলোতে বা ক্লাশ রুমে এখন আর কেউ শ্লোগান লেখে না। প্রক্টরিয়াল নিয়ন্ত্রণের কারণে যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর হারও এখন অনেক কম। সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সুবিধাবলী এখন অনেক উন্নত। এসব উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের মাননীয় উপাচার্যবৃন্দকে এজন্য অবশ্যই অভিনন্দন জানাই।

কিন্তু এখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সভা-সমাবেশ-সম্মেলনগুলো বটতলা ছেড়ে আরো এগিয়ে কলাভবনের লাগোয়া অপরাজেয় বাংলায় এসে ঠেকেছে। সবাই এখন এই ভাস্কর্যটিকেই মঞ্চ বানাচ্ছে। এর চারিদিকে মাইক লাগানোর পর এর দুঃসহ শব্দে কলাভবন বা এর আশেপাশে তখন ক্লাশ নেয়া দূরের কথা, হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক স্বাভাবিক শব্দে কথাও বলতে পারেন না, তখন কামালভাইয়ের কথা আর তাঁর নেয়া শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের কথা খুব মনে পড়ে।

কামাল ভাই সম্পর্কে আলোচনার সময় তার অনেক অবদানের কথা সঙ্গতভাবেই আলোচনায় আসে। কিন্তু তার নেতৃত্বে পরিচালিত শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের কথা উল্লেখ না করলে ব্যাপারটি অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলেই আমার বিশ্বাস। এই আন্দোলনের সাথে আমার চাইতেও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এমন অনেকেই দেশে-বিদেশে এখনো কর্মরত আছেন। অনুগ্রহ করে তারাও যদি এবিষয়ে স্মৃতি হাতড়ে আরো কিছু তথ্য সংযোগ করেন তাহলে কামালভাইয়ের এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাবে না।

লেখক: অধ্যাপক আ ব ম ফারুক, পরিচালক বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার (সাবেক চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, সাবেক চেয়ারম্যান, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, সাবেক ডীন, ফার্মেসি অনুষদ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আমারসংবাদ/কেএস