Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

নাগরিক স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত হোক

রায়হান আহমেদ তপাদার

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০, ০৮:৪৪ পিএম


নাগরিক স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত হোক

সকল মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিত।

যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহ এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই হচ্ছে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি; যেহেতু মানব অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা এবং ঘৃণার ফলে মানুবের বিবেক লাঞ্ছিত বোধ করে এমন সব বর্বরোচিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং যেহেতু এমন একটি পৃথিবীর উদ্ভবকে সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ কাঙ্খা রূপে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সকল মানুষ ধর্ম এবং বাক স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং অভাব ও শংকামুক্ত জীবনযাপন করবে; যেহেতু মানুষ যাতে অত্যাচার ও উৎ?পীড়নের মুখে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিদ্রোহ করতে বাধ্য না হয় সে জন্য আইনের শাসন দ্বারা মানবাধিকার সংরক্ষণ করা অতি প্রয়োজনীয় যেহেতু জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

রাষ্ট্রীয় সরকারি আইনগত সহায়তাসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া কারো দয়া নয়! বরং দেশের মানুষের অধিকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণ সর্বোচ্চ সম্মান এবং মর্যাদা পাবে এটাই সংবিধানের মূলমন্ত্র। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধে চেতনা রক্ষা করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে যেহেতু দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ অধিকার বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি আইনের শাসন। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি বিভাগ এই ব্যবস্থায় সংবিধিবদ্ধ আইনের অধীনে ক্রিয়াশীল হওয়ার কথা। নিয়ম অনুযায়ী, সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবেন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বসভায় পরিচিতি লাভ করার কথা।

বাস্তবে একটি স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের মানুষের যেমন সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের কথা, সেটি এ দেশে উপেক্ষিত রাষ্ট্রে নাগরিকদের ন্যায়সঙ্গত সেবা নিশ্চিত করতে হলে সকল নাগরিকের প্রতি সুযোগের সমতা বিধান করা জরুরি। নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

তাই সর্বত্র নাগরিকদের মাঝে সুযোগের সমতা সৃষ্টি করা গেলেই কেবল নাগরিক সেবা নিশ্চিত হবে। সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্টা হবেন এবং মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা ও প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটাই স্বাভাবিক নাগরিক সেবা খাত বিশেষত পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সেবা নিয়ে গ্রাহকের অন্তহীন ভোগান্তি পুরোনো করোনাকালে ভুতুড়ে বিদ্যুৎবিল সেখানে কেবল নতুন মাত্রাই যোগ করেনি বরং নতুন আপদ হিসেবেও দেখা দিয়েছে।

প্রযুক্তির এ সময়ে অ্যানালগ সেবার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। গত বুধবার সমকালে প্রকাশিত ‘অ্যানালগ সেবা কত দিন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি সেবাগুলো প্রযুক্তিবান্ধব না হওয়ায় গ্রাহক কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

একই সঙ্গে তা সম্প্রসারিত করছে চুরিসহ নানা অনিয়মের পথ। আবেদন গ্রহণ, বিল ও অভিযোগ প্রদানের মতো কিছু বিষয়ে অনলাইন সেবা চালু হলেও গ্রাহকের অভিযোগ কমেনি। আমরা দেখেছি, বিদ্যুৎ গ্রাহকের মাত্র সাড়ে আট শতাংশ এবং গ্যাসের আবাসিক গ্রাহকের মাত্র সাত শতাংশ প্রিপেইড মিটারের আওতায় এসেছেন।

 প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে গ্রাহক তার প্রয়োজন অনুসারে রিচার্জ করে বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহার করতে পারেন বলে একদিকে অপচয় রোধ হয় অন্যদিকে মিটার দেখার জন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করারও দরকার হয় না। গ্যাস ও বিদ্যুতের গ্রাহকের কিছু অংশ প্রিপেইড মিটারের আওতায় এলেও পানির ব্যবহারে এখনো লাগেনি প্রযুক্তির ছোঁয়া।


অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতি বজায় রাখার স্বার্থে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনীহা ও কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের অভাবেই সেবা খাতকে প্রযুক্তিবান্ধব করার উদ্যোগে গতি মিলছে না।

এ সংশ্নিষ্ট প্রকল্প নেয়া হলেও যখন আমরা দেখি তা বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে, তখন অভিযোগের সত্যতা খণ্ডন করা কঠিন। ১০ বছর আগে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় প্রিপেইড মিটার চালুর উদ্যোগ চলতি বছর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত নামমাত্র কাজ হওয়া বিস্ময়কর বৈকি!

বছর দুয়েক আগে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের তোড়জোড় থেমে যাওয়ার রহস্য বোঝাও কঠিন নয়। এ ব্যাপারে সেবা সংস্থাগুলোকে জবাবদিহি করতেই হবে। মান্ধাতা আমলের ওয়াসা যেভাবে সেবা দিচ্ছে, মানসম্মত ও চাহিদা অনুসারে পানি না পেলেও গ্রাহককে যেভাবে অর্থ গুণতে হচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয় ওয়াসার বিরুদ্ধে পানির নিম্নমান, দূষণ, ব্যাকটেরিয়া, পানির সরবরাহ সংকট এমনকি তিন-চার গুণ বেশি বিল দেয়ার অভিযোগও খতিয়ে দেখা জরুরি।

গ্রাহক যেখানে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না সেখানে ১২ বছরে ১৩ বার পানির মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিও আমাদের দেখতে হয়েছে। আমরা মনে করি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস শতভাগ প্রিপেইড মিটারে এলে অনিয়ম ও সিস্টেম লস কমবে। এতে যেমন সেবার মান বৃদ্ধি পাবে, জনভোগান্তি কমবে, তেমনি বছর বছর মূল্যবৃদ্ধির বোঝাও গ্রাহকের ওপর চাপবে না।

আমরা দেখে আসছি, দীর্ঘদিন ধরে সেবা খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলে আসছে সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রিপেইড মিটার, স্মার্ট গ্রিড, পেপারলেস অফিসসহ সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে পুরোপুরি ডিজিটাইজেশন করার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা চাই, সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো কোনো রকম গড়িমসি ছাড়াই দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থায় যুক্ত স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তথা স্ক্যাডা সিস্টেম চালু করা দরকার।

আমরা জানি, সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়েরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিতরণের দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হওয়ায় গ্রাহকের ভোগান্তি বাড়ে। এদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করাসহ দীর্ঘমেয়াদে একটি সংস্থার মাধ্যমে সেবা দেয়া যায় কিনা তা ভাবা যেতে পারে। অর্থ ব্যয় করেও নাগরিকদের যথাযথ সেবা না পাওয়ার অভিযোগ দুঃখজনক।

এসব নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। জনবান্ধব সরকার প্রয়োজনীয় জনসেবা নিশ্চিত করবে, এটাই কাম্য। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয় বরং প্রয়োজন উদ্যোগ, তদারকি ও বাস্তবায়ন। উন্নত সমাজের মানুষ অতি লোভে অন্যের ক্ষতি করে না, উন্নত মন নিয়ে নিজের জীবনের মতোই অন্যের জীবনকেও ভালোবাসে, সময়কে কাজে লাগায়। অর্থের জন্য জীবন নয় বরং জীবনে জন্য অর্থ প্রয়োজন বলে মনে করে।

অর্থের অতিরিক্ত লোভে অনেক সময় বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়, প্রতারণা ও ধোকাবাজির আশ্রয় নেয়। স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শত্রুর সাথেও গলাগলি ধরে চলতে আপত্তি থাকে না। এমন বদ স্বভাবের চরিত্রহীন লম্পট মানুষ দিয়ে আর যাই হোক সমৃদ্ধ সমাজ হয় না। সমাজ সমৃদ্ধ হয় ব্যক্তির ত্যাগে, উদারতা ও মহত্তের গুণে।

অর্থ প্রেম অনেক মানুষকে মানবিকতা বিবর্জিত যান্ত্রিক মানুষে পরিণত করে। উন্নত সমাজ একটি যুক্তিসঙ্গত ও যাচাই-বাছাইকৃত মৌলিক বিশ্বাসের ওপর সংগঠিত এবং সমাজের প্রতিটি ধ্যান-ধারণাই এই মৌলিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে যুদ্ধ-কলহ উন্নত সমাজে থাকে না, সামষ্টিক তথা বৃহ?ৎ ও মহৎ স্বার্থের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকে।

তবে দুর্বল রুগ্ন দেহ আর অসুস্থ মানসিকতা নয় বরং আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের সংখ্যাধিক্যে সমাজের গুণগত পরিবর্তন সুনিশ্চিত হয়। সুন্দর হোক সমাজ, হূদয়গুলো হোক আলোকিত, মনের প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ুক কর্মবীরদের দেহে আর পরিবেশটা হোক ভারসাম্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী। সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের পরিশ্রমী-কর্মপ্রিয়-ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ বৃদ্ধি পাবে এমনটাই প্রত্যাশা করছি। আইনের চোখে সবাই সমান এবং ব্যক্তিনির্বিশেষে সকলেই আইনের আশ্রয় সমানভাবে ভোগ করবে।

এ ঘোষণা লঙ্ঘন করে এমন কোনো বৈষম্য বা বৈষম্য সৃষ্টির প্ররোচনার মুখে সমানভাবে আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎ?সা ও প্রয়োজনীয় সমাজ কল্যাণমূলক কার্যাদির সুযোগ এবং এ সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্যকারণে সংঘটিত অন্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকারসহ নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সকল স্তর থেকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তি, পরিবার তথা নাগরিকের কল্যাণে ভূমিকা পালন করতে হবে।

তাহলেই নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, নাগরিক সেবার মানবতা জনগণ উপযুক্ত বিষয়সমূহের আলোকে জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কল্যাণ সাধন সম্ভব হচ্ছে না বলেই নাগরিক সেবা দিন দিন উপেক্ষিত হচ্ছে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট