Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশা আজও পূরণ হয়নি

রায়হান আহমেদ তপাদার

সেপ্টেম্বর ৯, ২০২০, ০৬:১০ পিএম


যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশা আজও পূরণ হয়নি

অতীত ইতিহাসকে পাশে ঠেলে দিয়ে, ভবিষ্যতের সিঁড়ি রচনা করা যায় না। তাই ঘুরেফিরে জার্মান জাতির সেই নির্মোহ সত্য ইতিহাসকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেই কারণেই স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, ৮১ বছর আগের সেই মানবতাবিরোধী বিশ্বযুদ্ধ কোনো সামান্য যুদ্ধ ছিল না।

এই যুদ্ধ অ্যাডলফ হিটলার ও তার গুটিকয় সমর্থক যুদ্ধবাজ জার্মানের কাজ ছিল না। এর পেছনে ছিল অ্যাডলফ হিটলারের বিশাল ফ্যাসিবাদী সমর্থকগোষ্ঠী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকেই ৮ মে জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশে মুক্তি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

এ বছর নাৎসি স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার ৮১ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে করার কথা থাকলেও, বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের কারণে তা বাতিল হয়েছে।

সেই অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বা বিতর্ক নয়, বিতর্ক হচ্ছে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং পতন আর তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ।

১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির লজ্জাজনক পরাজয় ও পরিণতি এবং ভার্সাই চুক্তির মধ্যদিয়ে বেদখল হয়ে যাওয়া জার্মানির কথিত ভূখণ্ড পুনরুদ্বার করার অজুহাতে কোনোরূপ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ১৯৩৯ সালের এক সেপ্টেম্বর ভোর ৪.৪৫টায় জার্মানি পোল্যান্ডের ওপর সামরিক হামলা ও অভিযান শুরুর মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিলো।

তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। পহেলা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ৮১ বছর পূর্ণ হলো। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৯ সালের এক সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো। এই যুদ্ধটি মানব সভ্যতার জন্য বেদনাদায়ক ও কলঙ্কময় কালো ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

এই দীর্ঘ সময়কালে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ, খণ্ডযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আর এর জন্য বলিদান হচ্ছেন নিরীহ মানুষ। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের বেদনাময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ক্ষণটি তাই মানব সভ্যতার জন্য অভিশপ্ত হয়ে আছে এবং থাকবে।

কম বেশি সবারই জানা সেই যুদ্ধে ১.৫ মিলিয়ন জার্মান নাজি বাহিনী একযোগে একই সময়ে পোল্যান্ডের ১৭৫০ মাইলব্যাপী সীমান্তে সকল ধরনের মারণাস্ত্র নিয়ে সর্বাত্মক হামলা পরিচালনা করে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলো।

লেখক, কলামিস্ট এবং ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার কেলিন জার্মান বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণ সম্পর্কে বলেন, তারা উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে স্থল, নৌ ও আকাশ পথে একযোগে হামলা করেছিলো। পোল্যান্ডের ওপর জার্মান নাজি বাহিনীর অতর্কিত হামলা সহজে গ্রহণ করতে পারেনি পোল্যান্ডের দুই মিত্র দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স।

দেশ দুটি ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়ে অবিলম্বে পোল্যান্ড থেকে জার্মান বাহিনীর প্রত্যাহার ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জার্মান সরকারকে আল্টিমেটাম প্রদান করে। এই আল্টিমেটাম জার্মান কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রত্যাখ্যানই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হয়ে উঠেছিলো।

জার্মান কর্তৃক যুদ্ধ বন্ধের এবং পোল্যান্ড থেকে নাজি বাহিনী প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স একযোগে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

পোল্যান্ডের ওপর নাজি বাহিনীর অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণের মধ্যদিয়ে বিশ্ব সভ্যতা ও মানব সমাজের জন্য যে দুঃখময় ও বেদনাদায়ক পরিণতির সূচনা ঘটেছিলো তার সমাপ্তি হয়েছিলো  ৬ বছর পর ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর। এই বিশ্বযুদ্ধে ৩০টি রাষ্ট্রের প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি জড়িত ছিলেন।

এই বিশ্বযুদ্ধে কতসংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছিলেন তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও প্রায় ৯০ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কয়েক মিলিয়ন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং পঙ্গুত্ববরণ করেছিলেন।

এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সশস্ত্র বাহিনীর ১২ মিলিয়ন সদস্য ও ১৭ মিলিয়ন বেসামরিক নাগরিকসহ ২৯ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছিলেন, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ।

পোল্যান্ড তার মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ বা ৫.৮ মিলিয়ন সামরিক-বেসামরিক লোক হারিয়েছিলো। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্য দেশের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক মিলে আমেরিকার চার লাখ ১৩ হাজার লোক নিহত হয়েছিলো।

যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্য দেশেরও অসংখ্য সামরিক-বেসামরিক লোক নিহত-আহত হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় হয়েছিলো বলে মনে করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই যুদ্ধে দুটি পক্ষ জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি এবং এর প্রতিপক্ষ মিত্রবাহিনী অংশ নিয়েছিলো।

অক্ষশক্তির মূল রাষ্ট্রগুলো ছিলো, এডলফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানি, বেনিতো মুসোলিনির ইতালি ও জাপান। মিত্রশক্তির প্রধান রাষ্ট্রগুলো ছিলো, ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।

এই উভয়পক্ষের প্রায় ৩০ মিলিয়ন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন পাঁচ শতাংশ এবং সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলেন ৯৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন ৬৭ শতাংশ এবং সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলেন ৩৩ শতাংশ।

পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের জন্য নিরীহ বেসামরিক মানুষই আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। মানব সভ্যতার উদ্ভবের পর থেকেই দেখা যায়, প্রতিটি সংঘটিত যুদ্ধেই নিরীহ বেসামরিক মানুষ বলিদানের শিকার হয়েছিলেন, এটিই হলো যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান ঘটনা হলো— আমেরিকার পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার এবং মিত্রশক্তির পক্ষে অক্ষশক্তির জাপানের ওপর আমেরিকার পারমাণবিক বোমার ব্যবহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যায়ে এসে আমেরিকা অক্ষশক্তির জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিলো।

পারমাণবিক বোমার ব্যবহার যুদ্ধের মোড় যেমন ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, জাপানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করেছিলো, তেমনি পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার জন্য ভয়ংকর পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিয়েছিলো।

এই যুদ্ধ শেষে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নাজি জার্মানির পরাজয়ের পর পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ, অর্থাৎ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রশক্তি গঠন করে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো এবং যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নেরই ক্ষতি হয়েছিলো সবচেয়ে বেশি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের পরে বিশ্ব ব্যবস্থায় আদর্শভিত্তিক বিভক্তি এসেছিলো এবং দুটি বিশ্বশক্তির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিলো। এর একদিকে ছিলো আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং অন্যদিকে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব।

আদর্শগত এই বিভক্তির মধ্যদিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থায় শুরু হয়েছিলো নতুন এক যুদ্ধ, যা শীতলযুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ যুদ্ধজয়ী বিশ্ব নেতারা অঙ্গীকার করেছিলেন। বিশ্বকে মানুষের জন্য নিরাপদ আবাসনের উপযোগী করে তোলার জন্য এবং যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু করণীয় তার সবকিছু করা হবে।

পৃথিবীর মানুষ আর কখনো যুদ্ধ দেখবে না, যুদ্ধের বলি হবে না, এমনটাই বলেছিলেন বিশ্ব নেতারা। বিশ্বনেতাদের এই আশাবাদের প্রেক্ষিতে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ সালে গঠন করেছিলেন, জাতিসংঘ। তবে এই বিশ্ব সংস্থাটির সফলতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

বিশেষ করে, যুদ্ধমুক্ত নিরাপদ পৃথিবী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সফল হতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এই দীর্ঘ ৮১ বছরে বিশ্ব ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে সত্য, কিন্ত যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৮১ বছর কেটে গেছে। আজ পুনঃএকত্রিত জার্মানি বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম।

একদিকে গণতন্ত্র, অন্যদিকে সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। আবার একই সঙ্গে বিপুল অর্থনৈতিক সাফল্য। সামাজিক মডেল হিসেবে গোটা বিশ্বে যা আকর্ষণীয়।

 জার্মানি এটাও বুঝতে শিখেছে, যে এক দশক ধরে সবাই তাদের ওপর লক্ষ রাখছে; তার গুরুত্ব বাড়ছে; ইউরোপে তার নেতৃত্বের ভূমিকা ও গোটা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের প্রত্যাশাও বাড়ছে।

তবে সামরিক ক্ষেত্রে ততটা নয়, যদিও তারও গুরুত্ব রয়েছে। মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই জার্মানির বিশেষ অবস্থান আশা করা হচ্ছে। জার্মানি মোটেই পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে না।

তবে দেশ হিসেবে জার্মানির আত্ম সচেতনতা বাড়ছে এবং তার জন্য যে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে, তা ঐকমত্যে অভ্যস্ত জার্মানদের জন্য বেশ কষ্টকর অভিজ্ঞতা।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এআই