Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

পরিবারতন্ত্র ভাঙার যাত্রায় আওয়ামী লীগ!

এম. কে দোলন বিশ্বাস

সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২০, ০৭:১০ পিএম


পরিবারতন্ত্র ভাঙার যাত্রায় আওয়ামী লীগ!

পরিবারতন্ত্রকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে থাকলেও এবার বুঝি তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের কৃতিত্ব অর্জন করলেও পরিবারতন্ত্রের গণ্ডি ভাঙার রেকর্ড দলটির অতীতে দেখা যায়নি। বরং দলটির সংসদীয় রাজনীতিতে সাধারণ পরিবারতান্ত্রিক ধারায় আবদ্ধ থাকতেই দেখা যায়।

দাদা, বাবা কিংবা উত্তরসূরিদের বদৌলতে মনোনয়নে এমপি পদ ভাগিয়ে নেয়ার আলামত দেখা যায় হালআমলে বিশেষ করে গণতন্ত্রের জন্য চেঁচামেচি করা আওয়ামী লীগ নামক দলটির আমলনামায়। শুধু পারিবারিক কারণে বর্তমান সংসদেও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন, এমন এমপির সংখ্যাও কম নয়।

রাজনীতিতে প্রবীণ এবং ত্যাগী হয়েও ওইসব আসনের এমপি পরিবারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সংসদে যেতে পারেন না অসংখ্য যোগ্য নেতা। পরিবারতন্ত্রের রাজনৈতিক আগ্রাসী ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে সম্ভবত আওয়ামী লীগের বোধোদয় হয়েছে। সে কারণেই হয়তো পরিবারতন্ত্র ভাঙার যাত্রা শুরু করেছে দলটি।

পরিবারতন্ত্র ভাঙার যাত্রায় আসন্ন পাঁচটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে ঘোষিত তিনটির দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন এবং সামপ্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচন বিশ্লেষণে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।

তবে দলটির শীর্ষ নেতাদের অভিমত, দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে কোনো উত্তরসূরি দেখা হয় না, যোগ্যতা বিবেচনা করেই নির্ধারণ করা হয় প্রার্থী। রাজধানীর অন্যতম প্রবেশদ্বার ডেমরা-যাত্রাবাড়ী নিয়ে গঠিত ঢাকা-৫ আসন থেকে চারবার এমপি হয়েছেন প্রয়াত হাবিবুর রহমান মোল্লা। পুরো নির্বাচনি এলাকাজুড়েই আধিক্য রয়েছে মোল্লা পরিবারের।

দীর্ঘ ওই সময়ে আসনটি থেকে এমপি হওয়ার সুযোগ পাননি অন্য কেউ। বাবার চেয়ারের উত্তরাধিকার আর প্রচলিত ধারায় আসনটি থেকে মনোনয়ন দাবিদার ছিলেন হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে জাহিদুল ইসলাম মোল্লা সজল।

কিন্তু পরিবারতন্ত্রের পুরনো ধারা ভেঙে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সময়ের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালনকারী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু। পাবনা-৪ আসনে পাঁচবার এমপি হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। অধিকর্তা হিসেবে আসনটির রাজনীতিতে তিনিই ছিলেন যেমন প্রথম, তেমনই শেষও।

ফলে ওই আসন থেকে অনেক ত্যাগী নেতা থাকলেও এমপি পদে আসীন হতে পারেননি অন্য কেউ। আসন্ন উপ-নির্বাচন ঘিরে একযোগে দলীয় মনোনয়নের দাবিদার ছিলেন শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, জামাতাসহ পরিবারের আট সদস্য। কিন্তু আসনটিতে ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাসকে মনোনয়ন দিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।

নওগাঁ-৬ আসনে একাধারে তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রয়াত ইসরাফিল আলম। তার স্ত্রী পারভীন সুলতানা বিউটি উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন-প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন পেয়েছেন রানীনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন হেলাল।

ঢাকা-১৮ আসনে দলীয় মনোনয়নে তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন।

আসনটিতে উপ-নির্বাচনে মাঠের এক রাজনীতিবিদকে দলীয় প্রার্থী করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সিরাজগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের পরিবার থেকেই।

এছাড়া সামপ্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচটি আসনের উপ-নির্বাচনে বগুড়া-১ ছাড়া বাকি চারটিতেই প্রয়াত এমপি পরিবারের কাউকে দেয়া হয়নি দলীয় মনোনয়ন। এর মধ্যে যশোর-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হয়েছেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার।

মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন প্রয়াত এমপি ইশমত আরা সাদেকের কন্যা নওরীন সাদেক। গাইবান্ধা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি। প্রয়াত এমপি ইউনুস আলী সরকারের ছেলে ড. ফয়সল ইউনুস মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন।

বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের উপ-নির্বাচনে এমপি হয়েছেন আমিরুল আলম মিলন। ওই আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন প্রয়াত সাংসদ ডা. মোজাম্মেল হোসেনের পুত্রবধূ ইসমত আরা শিরিন চৌধুরী।

ঢাকা-১০ আসনের এমপি ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে নির্বাচন করার কারণে পদত্যাগ করেছিলেন। আসনটিতে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ব্যবসায়ী নেতা শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের পরিসংখ্যান বড়ই দীর্ঘ।

বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা। মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতু ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। পুতুলের দাদা শ্বশুর খন্দকার নুরুল হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই।

খন্দকার মোশাররফের ছোট ভাই খন্দকার মোহতাশিম হোসেন হলেন ফরিদপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ননদের স্বামী হলেন সিরাজগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ডা. হাবিব মিল্লাত মুন্না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়ার বড় বোনের নাতনি হলেন আওয়ামী লীগ সরকারের হুইপ গাইবান্ধা-২ আসনের এমপি মাহবুব আরা গিনি।

বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয় প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। জিল্লুর রহমানের স্ত্রী প্রয়াত আইভী রহমান হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার খালা শাশুড়ি। জিল্লুর রহমান ও আইভী রহমান দম্পত্তির ছেলে ভৈরব-কুলিয়ারচর আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন।

 বঙ্গবন্ধুর বোন আছিয়া বেগমের দুই ছেলে হলেন শেখ ফজলুল হক মণি ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সম্পর্কে তারা শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো ভাই। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকদের হাতে শহীদ হন। তার ছেলে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস ঢাকা-১০ আসনের এমপি।

বঙ্গবন্ধুর ভাগনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম হলেন সাবেক মন্ত্রী ও গোপালগঞ্জ-২ আসনের এমপি। শেখ সেলিমের বোনের স্বামী হলেন বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা ও এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর। যিনি পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দেন। মঞ্জুর সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী।

বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের। তার ছেলে হলেন বাগেরহাট-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি। শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ মণি ও শেখ সেলিমের আরেক ছোট বোনের জামাই হলেন যুবলীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। শেখ সেলিমের ভায়রা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী জামালপুর-১ বকশীগঞ্জ-দেওয়ানগঞ্জ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদ।

বঙ্গবন্ধুর বড় বোনের জামাই হলেন আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুর রব সেরনিয়াবাত। সেরনিয়াবাতের ছেলে হলেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ বরিশাল-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ।

শেখ হাসিনা ও হাসানাত আবদুল্লাহ পরস্পরের মামাতো-ফুফাতো ভাই-বোন। আবার হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট বোনের দেবর হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। তিনি সম্পর্কে শেখ হাসিনার বেয়াই।

হাসানাত আবদুল্লাহর সম্পর্কে চাচাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হলেন মাদারীপুরের সাবেক এমপি প্রয়াত ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী।

ইলিয়াস চৌধুরীর বড় ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক হুইপ ও মাদারীপুর-১ আসনের এমপি। ইলিয়াস চৌধুরীর ছোট ছেলে মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি। সে হিসেবে লিটন ও নিক্সন চৌধুরী সম্পর্কে শেখ হাসিনার ভাতিজা।

শেখ হাসিনার সম্পর্কে আরেক ফুফাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাদারীপুর-৩ আসনের এমপি বাহাউদ্দিন নাছিম। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান এমপি গণমাধ্যমে জানান, আমরা কোনো কিছু থেকেই বেরিয়ে আসিনি। কোনো কিছুতে ঢুকিও না।

আওয়ামী লীগের এমপি মারা গেলে তার পরিবারে দেয়া হয়, এটা সত্য নয়। আমাদের মনোনয়ন দেয়া হয় প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয়তা, যোগ্যতা এবং সাধারণ মানুষের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায়। দল যে দায়িত্ব দেবে সে দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা আছে কী না।
একই সাথে প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আছে কী না। এসব বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই মনোনয়ন দেয়া হয়।

তিনি আরও জানান, অনেক সময় এমন হয়েছে, দেখা গেছে একজন এমপি মারা যাওয়ার পর ওই নির্বাচনি এলাকায় তার স্ত্রী বা সন্তান বেশি জনপ্রিয়। দলের নেতাকর্মীদের সাথে ভালো সম্পর্ক। তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে।

এমপি মারা গেছেন, তার আত্মীয় হিসেবে দেয়া হয়নি। আমরা দেখেছি কে যোগ্য, তাকে দেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, সত্যিকার্থেই যদি পরিবারতন্ত্র থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসে, তবে দলটির জন্য সুখবরই বটে।

কিন্তু কৌশলগত কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি পরিবারতন্ত্র ভাঙার যাত্রায় দলটি পা বাড়িয়ে থাকে, তবে এ ব্যাপারে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।

লেখক : সাবেক সহ-সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ

আমারসংবাদ/এআই