Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

মহাকালের জনসভায় জননেত্রী শেখ হাসিনা

মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০, ০৬:৫৮ পিএম


মহাকালের জনসভায় জননেত্রী শেখ হাসিনা

আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। এ সময় আমাদের স্কুলমাঠে এক জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। তখন তিনি সরকারে না, সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার চেয়ে বড় পরিচয় তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা।

যিনি ৭৫ এর ১৫ আগস্টে একমাত্র বোন ছাড়া পরিবারের আত্মীয়স্বজন সবাইকে হারিয়ে বুকভরা ব্যথা নিয়ে অসীম সাহসে গণমানুষের মুক্তির দূত হিসেবে শোকার্ত বাংলাদেশের ব্যথাতুর মানচিত্রের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গণসংযোগ করে বেড়াচ্ছিলেন। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বর শেখ হাসিনা।

কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি জনতার দুঃখের সাথী। তিনি কারো কাছে আপা, কারো কাছে শেখ সাহেবের বেটি, শিক্ষিতদের কাছে বঙ্গবন্ধু কন্যা, মা বোনদের কাছে হাসিনা, বক্তৃতায় জননেত্রীও বলা হয়ে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি প্রয়োজনে আবার অস্ত্র হাতে নেয়ার আবেগ। ছাত্র-জনতা তথা গণমানুষের কাছে তিনি দেশের কাজে সংগঠিত হওয়ার শক্তি।

এক সপ্তাহ আগে থেকেই শেখ হাসিনার জনসভাকে কেন্দ্র করে একটা সাজ সাজ রব রব ভাব জমে উঠেছিল আমাদের এলাকায়। মাঠে বিশাল একটা মঞ্চ করা হয়েছে। সবার কাছে বিস্ময়ের বিষয় এই মঞ্চে দাঁড়িয়েই শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখবেন। কি বলবেন শেখ সাহেবের বেটি বা কি কি বলা উচিত, এ নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেছে স্থানীয় সিভিল সোসাইটি। তাদের ভাবখানা এমন যে শেখ হাসিনা এসেই তাদের সঙ্গে আগে ভাগে একটা সংক্ষিপ্ত মিটিং করে তারপর জনসভা করবেন।

এছাড়াও অনেকের প্রস্তুতিই আমাদের নজর কাড়ে। যেমন আমাদের স্কুলের দপ্তরি রহমত দাদাও একটা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। হঠাৎ যদি শেখ হাসিনা তার কাছে পানি খেতে চায়। তাহলে কতটা উত্তম ও পরিশীলিতভাবে তা পরিবেশন করবেন এ নিয়ে তার অনুশীলনের অন্ত নেই।

তার মনে আরও একটা পরিকল্পনা আছে সুযোগ পেলেই সে শেখ হাসিনাকে আমাদের স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের আবদার করবেন এটা তিনি আমাদের বলে রেখেছেন। ছাত্রদের একটা প্রস্তুতি আছে— সেটা হলো আমাদের এলাকার সব আবেগ দিয়ে শেখ হাসিনাকে নতুন নতুন স্লোগান উপহার দেয়া।

এলাকার যুবকরা আছে ভলান্টিয়ারের দায়িত্বে। মুরুব্বিদের ভাবসাব এমন যে তারাই জনসভা মাঠটা ভরে ফেলবে। কারণ তারা বঙ্গবন্ধুর লোক। আবার তাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর সাথে হাত মিলিয়েছেন এমন গল্পও চালু আছে। এদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর অনেক মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন বা বঙ্গবন্ধুকে নিজের চোখে দেখেছেন।

ধরতে গেলে তারাও এক ধরনের জীবন্ত কিংবদন্তি। তাদের তো অগ্রাধিকার রয়েছেই। এখানে আরও একটি গ্রুপ আছে যারা জীবনে শুধু একবার একনজর শেখ হাসিনাকে দেখবেন। তাদেরও খুব শক্ত অবস্থান।

আবার অনেকে আছেন যাদের কথা হলো বঙ্গবন্ধুর মিটিংয়ে যাইতে পারি নাই, শেখ হাসিনাকে দেখবোই- তারাও হালকা অবস্থানে নেই। এর মধ্যেই আমাদের স্কুলের ফিজিক্যাল স্যার বয়েজ স্কাউটের সদস্যদের দিয়ে পুরো মাঠটা পরিষ্কার করিয়ে রাখলেন।

তার কথা জনগণের পাশাপাশি আমাদেরও একটা দায়িত্ব রয়েছে। আয়োজক নেতারা মোটরসাইকেলের ভটভট শব্দে আওয়াজ দিয়ে স্কুলমাঠে যাচ্ছেন আর আসছেন। কী ব্যস্ত ভাব! হওয়ারই কথা অতবড় নেত্রী আসবেন, তার প্রস্তুতি বলে কথা। অত শত দেখার সময় আমাদের নেই— আমাদের কথা হলো যত কাছে থেকে পারি শেখ হাসিনাকে দেখা চাই।

মাঠে জায়গা না পেলে গাছের মগডালে উঠব। ইতোমধ্যে আমরা নিজেরা ঠিক করে ফেলেছি স্কুলমাঠের ঠিক পূর্বকোণের আম গাছটার কে কোন ডালে উঠব। যথারীতি এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। না শীত, না গরমের কাল। আকাশ খুব পরিষ্কার। সকাল থেকে মিস্টি মিস্টি রোদ।

সেই সাথে খণ্ড খণ্ড মিছিলে ভরে গেল মাঠ। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে বাহারি স্লোগান। আমাদের মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা বোধ হয় সবগুলো স্লোগান পছন্দ করে ফেলেছেন। বোধহয় সময় পেলে আগামী বছর আবার আসবেন। শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে মনে হয় আমাদের এলাকার অনেক উন্নয়ন করবেন।

শেখ হাসিনার সাথে যারা এসেছেন তাদের প্রায় সকলেই সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা আর মুজিবকোট পরেছেন। দেখতেও ভালো লাগছে। প্রত্যেকের চেহারায় প্রতিরোধের ছাপ। কি সুন্দর শব্দশৈলী আর ছন্দের গাঁথুনি তার সাথে কী খাপের খাপ উপমা। এ যেন এক মহাকালের জনসভা।

পরবর্তীতে শেখ হাসিনার প্রায় সবগুলো জনসভাই আমার কাছে ঠিক একইরকম অনুভূতির মনে হয়েছে। নির্ধারিত সূচিতে যখন মাইকে ঘোষণা হলো বক্তব্য রাখবেন শেখ হাসিনা, তখন স্কুলমাঠের জনস্রোতে ঢেউ সারা বাংলাদেশকে আন্দোলিত করে দিলো। এদিকে আমার শরীরে খেলে যায় এক অপূর্ব অসাধারণ শিহরনের ঢেউ।

তিনি সোজা সাপ্টা বলে দিলেন, দেশের মানুষ ভালো নেই, উন্নয়ন নেই, অধিকার নেই, সুশাসন নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। তখন জনসভায় মুহুর্মুহু  স্লোগান শেখ  হাসিনা, হাসিনা। তিনি আবার বললেন, আমার দল ক্ষমতায় গেলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করবো। আমাদের ক্লাসরুম ভবনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, এই স্কুলের ভাঙা ভবন আর ভাঙা থাকবেনা, ভবনটি পাকা  হবে। আমরা তো মহাখুশি, আমাদের স্কুল ভবন পাকা হবে।

পরবর্তীতে সারের দাবিতে কৃষক নিহত হওয়ার ঘটনায় পরের বছরই তিনি আমাদের স্কুলমাঠে আবার জনসভা করেছিলেন এবং ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হয়েই আমাদের ক্লাসরুম ভবনটির পাকা দালান নির্মাণ করেছিলেন।

তারপর ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাস। আবার দেখা করার সৌভাগ্য হলো আপামর বাঙালির চির আপন নেত্রী, আমার ব্যক্তিগত কল্পনায় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শেখ হাসিনার সাথে। এবার একবারে সামনাসামনি দেখা। বুকটা গর্বে ধুকধুক করছে। জীবনে ভাবিনি  এমন সুযোগ আসবে।

 ভাবছি কী বলবো, মনে হচ্ছিল এখান থেকে পালিয়ে যাই। আমার মুখে বা মনে কথার যোগান পাচ্ছি না। উনি জিজ্ঞেস করলে নিজের নামটাও হয়তো ঠিকঠাক বলতে পারবো না। যা হোক সেবার তার প্রশ্নের উত্তরে ভালো আছি ছাড়া আমাকে আর কিছুই বলতে হয়নি।

শরীয়তপুর-২, নড়িয়া আসনের শহীদ সংসদ সদস্য নুরুল হক হাওলাদারের একমাত্র কন্যা, আমাদের বড়বোন অজন্তা আপা একাই বুকের মধ্যে এক সমুদ্র সাহস নিয়ে শেখ হাসিনার প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক আলোচনার সফল সমাপ্তি ঘটালেন। সুধাসদন থেকে বের হওয়ার পর আমার মনে বিরাট এক ফূর্তি ভাব বিরাজ করছে। কি করবো- হেঁটে বাসায় যাব না রিকশায় বাসায় যাবো- দিশা পাচ্ছিলাম না।

অনেকক্ষণ রাস্তায় হাঁটলাম। আবার পরক্ষণেই মনটা খারাপ হলো এই ভেবে যে, এত বড় একজন মানুষের সাথে সামনাসামনি সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েও কিছুই বলতে পারলাম না। অন্যকিছু না আমি যে তার জনসভায় গাছে উঠে তাকে দেখেছি এটা অন্তত বলতে পারতাম।

নিজের উপর নিজেরই রাগ বাড়তে লাগল। ২০০৩ এ আমাদের সংগঠনের স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে দেখা হলেও বাক্য বিনিময়ের অবকাশ ছিলনা। পরের ঘটনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় তাকে হত্যা উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হলো। অনেকেই হতাহত হলো।

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন মুক্তিকামী জনতার ভালোবাসার নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। প্রাণে বাঁচলেও কানে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। ২১ আগস্ট বিকেল থেকেই মন অস্থির করছে। কী ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, কী লেখা আছে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ভাগ্যলিপিতে।

২২ আগস্ট সারাদিন  হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছি। অনেক বড় বড় রাজনীবিদকে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে দেখেছি। এ যেন এক আহত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। অনেকেই শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে সমবেদনা জানাচ্ছেন, প্রতিবাদ করছেন এই ন্যাক্কারজনক গ্রেনেড হামলার।

২৩ আগস্ট দুপুরে জানতে পারলাম রাত আমাদের সংগঠন শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছে। প্রতিনিধি দলে আমিও আছি। মনের মধ্যে আবারো এক অজানা শিহরণ। এতবড় হামলার পরও নেত্রীকে আল্লাহ প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাকে আবার সামনাসামনি দেখতে পাবো বা সমবেদনা জানাতে পারবো এটা আমার কাছে বিরাট পাওয়া মনে হলো। ভাবতে লাগলাম এবার কী বলা যায়। ভাষা গাঁথুনির চেষ্টা করছি। অনেক কথা গুছিয়ে নিলাম। কাঙ্ক্ষিত সময়ে বলতে পারলে চলে।

 সুধাসদনে বসে আছি। সাড়ে ৯টার দিকে ডাক পড়ল। সবাই একে একে সাক্ষাৎ কক্ষে ঢুকলাম। সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে সবার পরে ঢুকতে হলো। কিন্তু ইতোমধ্যে বড়রা যার যার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে আসন গেড়েছেন। আমাকে বসতে হলো পরম শ্রদ্ধেয় নেত্রীর ঠিক মুখোমুখি একটি আসনে। কী একটা অবস্থা।

আবার ভালোও লাগছে। কারণ এবার প্রস্তুতি ভালো। শেখ হাসিনা রুমে ঢুকেই আমাকে  জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন আছো? বিশাল প্রস্তুতি সত্ত্বেও এপর্যায়ে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। সাতপাঁচ না ভেবেই এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম, আমরা ভালো আছি।

আপনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আমরা খুব দুঃখ পেয়েছি। আমরা এর বিচার চাই। আরও এলোমেলো অনেক কথা। কিছু সাবলীলভাবে বলতে পারছিলাম, কিছু কথায় বারবার আটকে যাচ্ছিলাম। তিনি সব কথা  মনোযোগ দিয়ে  শুনছিলেন।

আর আটকে যাওয়া বাক্যগুলোতে তিনি শব্দ যোগ করে দিয়েছিলেন বলেই  বাক্য পূর্ণ করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের বহু আন্দোলন-সংগ্রামের সফল নেতৃত্ব দিয়ে তিনি আজ বাংলাদেশের টানা তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার নেতৃত্বে সমৃদ্ধির অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ। প্রতিবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছি। শ্রদ্ধাভরে সালাম দিয়েছি সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপও হয়েছে। প্রথম দিন জনসভায় তাকে দেখার পর এবং যেদিন উনি আমার কুশল জিজ্ঞেস করেছিলেন তারপর মনের মধ্যে যে আদর্শিক শ্রদ্ধাবোধের জন্ম হয়েছিল আজও তা জাগ্রত। আমার অনুভূতিতে এটাই সদা বিরাজমান যে, বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু আমি একজন শেখ হাসিনাকে দেখছি। তার জন্মদিন, সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের শুভদিন। যেহেতু শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

লেখক : মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/এসটিএম