Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য দরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ

রায়হান আহমেদ তপাদার

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০, ০৮:১৩ পিএম


শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য দরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ

সুশাসনের জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য। সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং আইনের সমপ্রয়োগের মাধ্যমেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। উন্নত ও সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রে আইন ও ন্যায়বিচার তাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দুটো অঙ্গ। সমাজে ন্যায়বিচারের অভাব ঘটলে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-হানাহানির জন্ম হয়; অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো— সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

নাগরিকের কর্তব্য আইনকে শ্রদ্ধা এবং তা মান্য করা। আইনকে অমান্য করার অর্থ, অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন  করা। প্রতিদিন অনেকেই নিজের অজান্তে আইন অমান্য করে প্রতিনিয়ত সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন ঘটিয়ে যাচ্ছে। জনগণের স্বার্থে দ্রুত এর পরিবর্তন প্রয়োজন।

উন্নয়নের চলমানতায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে স্বচ্ছ গণতন্ত্রের ঘাটতি যেখানে অপরাধ প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সেখানে সকল নিয়মনীতিকে হটিয়ে রাজনীতির নিষ্ঠুর ও পাষাণ খেলায় সমাজ ও মানুষকে জাপটে ধরে। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ অপরাধের পেছনে কিংবা অপরাধের বিচার না হওয়া কিংবা অপরাধীদের আইন-কানুনকে তোয়াক্কা না করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই জোরালো ভূমিকা রাখে।

গণতান্ত্রিক ভাবধারায় রাজনীতির ব্যবহার মানুষের আচরণে আইনের স্পষ্ট উপস্থিতি তৈরি করে। কারণ শান্তি ও শৃঙ্খলার অব্যাহত জয়যাত্রা প্রস্তুত করাই রাজনীতির কাম্য লক্ষ্য; কিন্তু রাজনৈতিক শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে রাজনীতির মদদপুষ্ট কতিপয় ব্যক্তিরা সমাজকে অতিষ্ঠ করে ফেলছে।

এমনকি রাজনীতি যেখানে প্রতিরোধ করবে সেখানে লাগাম খুলে দেয়। খুলে দেয় সামাজিক অমান্যতার দুয়ার। যে কারণে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অপরাধ বাড়ছে; বাড়ছে বিচারহীনতায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির অতি বাড়াবাড়ি।

এতে সমাজের শৃঙ্খলার কাঠামোতে আবদ্ধ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। তৈরি হয় পারস্পরিক অবিশ্বাসের প্রশস্ত রাস্তা। যেখানে যার যা কিছু মনে হয় তাই করে। দেশে আইন না মানার সংস্কৃতি আছে। ইচ্ছাকৃত আইন না মানার রেওয়াজ আছে প্রভাবশালীদের।

তেমনি নিরীহদের ওপর আইন অপপ্রয়োগ হয় দেশে। উন্নয়নের সুবিধা কারা বেশি পাচ্ছে? ডিজিটাল দেশের বেশি একসেস বা সুবিধা পাচ্ছে উচ্চ শ্রেণি। সাধারণ নাগরিক কম সুবিধাই পাচ্ছেন। সুবিধা পেতে তাদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। বলা যায় চারিদিকে দুটো শ্রেণি। চরম সুবিধাবাদী, না হয় চরম সুবিধাবঞ্চিত। মাঝামাঝিদের চরম দুর্ভোগ, তাদের ভোগান্তি পথেঘাটে। আইন তার নিজের গতিতে চলছে কম। চালাতে হয়। রসদ দিতে হয়।

আইনের প্রয়োগ যথার্থ হয় খুব কমই। আইনে সুযোগ পেতে মিডলম্যান ধরতে হয়। আদালতে উকিল অন্যক্ষেত্রে ক্ষমতাবান। দু’দিকেই আর্থিক রসদ লাগে। আইন যদি তার নিজের গতিতে চলে তাহলে সুশাসন আসতে বাধ্য।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝা যায়, অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির মাত্রা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। কেন মানুষ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে? শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যেই এটি দেখা যায়। আইন অমান্য করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে একদিনে গড়ে উঠেনি বরং দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

এর জন্য অনেকটাই দায়ী নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অপরাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও দুর্নীতির প্রতি আসক্তির ফলে মানুষ পরিণত হয়ে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধহীন যান্ত্রিক মানুষে। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।

কোনো ব্যক্তি একবার যদি অপরাধ করে তার শাস্তি থেকে কোনোমতে পার পেয়ে যায় তবে পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি পুনরায় অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। আবার পরিবারের কেউ যদি অপরাধের সাথে জড়িত থাকে জিনগতভাবে তার পরবর্তী প্রজন্মের ওপর তার প্রভাব পড়তে পারে।

উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের সকলেরই উচিত দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং আইন মেনে চলা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আইন-আদালত থাকলেও আইনের শাসন মানার সংস্কৃতি পুরোপুরি গড়ে উঠেনি। আইন না মানার কারণে বাড়ছে সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা।

সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। কেউ যদি আইন মেনে না চলেন বা আইন ভঙ্গ করেন কিংবা আইন ভঙ্গের হুকুম দেন তখন সমাজের, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

আর সে আইন যদি দেশের কোনো জনপ্রতিনিধি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো ব্যক্তি ভঙ্গ করেন বা আইন ভঙ্গের হুকুম দেন তাহলে তা জনগণের মাঝে আরো নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।

এছাড়া, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের অভাবের কারণে মামলার চার্জশিটে প্রকৃত ঘটনা প্রতিফলিত হয় না। এ কারণে মামলার বিচার পর্যায়ে ফাঁকফোকর গলে আসামি পার পেয়ে যায়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃত অপরাধের ক্ষেত্রে মামলার এজাহার গ্রহণ ও তদন্তপূর্বক চার্জশিট প্রদানে থানা পুলিশের দক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে।

আবার, মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রদানে অনীহা ভিকটিমের ন্যায়বিচার লাভে অন্যতম অন্তরায় এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাবে অপরাধী খালাস পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে, বিচারক ও আইনজীবীর কিছুই করার থাকে না। কেননা, তাদেরকে নির্ভর করতে হয় সাক্ষ্য-প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর।

যারা আইন মানতে চান না, নিজের সুখ-সুবিধাকে বড় করে দেখেন, প্রয়োজনে অন্যকে মেরে-ধরে নিজের ইচ্ছাকে পূরণ করতে চান, তাদের জন্যই আইন-আদালত বা বিচারব্যবস্থা। বিচারব্যবস্থা হচ্ছে সভ্যতার অবদান। আইন অমান্য করা করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে সকলেরই বেরিয়ে আসতে হবে। আইন দেশের শৃঙ্খলা রক্ষা করা ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ়করণের চালিকাশক্তি।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারহীনতা যেমন অগ্রহণযোগ্য, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতাও অনুরূপভাবে অগ্রহণযোগ্য। কোনো অপরাধীকে অপরাধ সংঘটনের দায়ে গ্রেপ্তার ও বিচারে সাজাপ্রাপ্ত হতে দেখলে অনুরূপ ব্যক্তিরা সতর্কতা অবলম্বন করে অপরাধ করা ও তজ্জন্য সাজা ভোগ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে সচেষ্ট থাকবে। প্রতিটি নাগরিকের মনে বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির মনে এমন ভীতি জন্মাতে হয় যে, অপরাধ করে কোনোভাবেই ছাড় পাওয়া যাবে না, বিচারের আওতায় আসতেই হবে।

এমনকি সমাজে কে কোথায় কোনো অপরাধ মূলক কাজের গোপন পরিকল্পনা ও তৎপরতায় লিপ্ত গোয়েন্দা বাহিনীকে তা উদঘাটনে সচেষ্ট থাকতে হবে অপরাধকে সমাজ থেকে নির্মূল করতে হলে আইন সহায়তাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। পুলিশ কথাটির অর্থ সাহায্যকারী।

সমাজে নিরীহ জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের হাতে ন্যাস্ত। পুলিশ তৎপর হলে অপরাধী সতর্কতা অবলম্বন করে সাবধান হয়। কিন্তু পুলিশ যদি অবহেলার সাথে দায়িত্ব পালন করে কিংবা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তবে অপরাধ দমন তো দূরের কথা, তা আরও বিস্তার লাভ করে। তদন্তে বের করে আনতে হবে অপরাধ সংঘটনের পেছনের কারণ, অপরাধের পরিকল্পনা এবং কে ও কারা এর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের বর্তমান অবস্থান।

অপরাধ ঘটার পর সংক্ষিপ্ততম সময়ে সফল তদন্ত কার্যক্রম সমাপ্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া তদন্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। অপরাধের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে নির্বাচন করতে হবে যাতে তারা অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেয়।

অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। অপরাধ প্রবণতা রোধে রাষ্ট্রকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করেই সেটা করতে হবে। তাহলে অন্যরাও অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে।

তাছাড়া, সর্বত্র আইন মানার সংস্কৃতিও গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতার পর রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে নতুন সমাজ নির্মাণে দিকনির্দেশনা এবং নতুন জাতি গঠনের বাস্তব নকশা প্রদান করা হয়েছে।

অথচ সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিককে সমান হিসেবে বিবেচনাসহ সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার উল্লেখ থাকলেও সব ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না বরং অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানে বর্ণিত অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত। আইনব্যবস্থা যেকোনো রাষ্ট্রের সমাজ-জীবনের সামগ্রিক চিত্র নির্দেশক। আইন এমন একটি সমাজবিজ্ঞান, যা গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায়।

এ ক্ষেত্রে ভাষার সাথে আইনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়েই ভাষার উন্নতি ঘটে থাকে। আইন সমাজের মঙ্গলের জন্য; শক্তি দ্বারা বলবৎ করার বিষয় নয়। সৃষ্টিকাল থেকেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য বিদ্যমান।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা আন্তরিকও। এখন আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সরকারের সাথে একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আশা পূরণ করা যাবে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এসটিএম