Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

নদীর নাম মধুমতি (শেষ পর্ব)

অ্যাডভোকেট রোকনুজ্জামান খান

অক্টোবর ২০, ২০২০, ০৭:১৭ পিএম


নদীর নাম মধুমতি (শেষ পর্ব)

শত বছর পর কুমিরের প্রতিশোধ নিলো গ্রামবাসী: এই জগতে কত কাকতালীয় ঘটনা ঘটে তার কি কোনো  ইয়ত্তা আছে? তেমনই এক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় মধুমতি নদীর ইতিহাসে। মধুমতি নদীতে আগে কুমিরের খুব উৎপাত ছিলো। নদীতে গোসলের সময় কুমির থাবা দিয়ে মানুষ নিয়ে যেত।

ফলে বাশের খাচা দিয়ে ঘিরে মানুষ গোসল করতো। ১৯১৭ সালের কথা। প্রতিদিন কার  মতো দুপুর বেলায় নদীতে গোসল করতে যান শিরগ্রামের  কাছেদ মোল্লা। গোসল করতে নদীতে নামার সাথে সাথেই একটি কুমির এসে ঘাড় মটকে দেয় কাছেদ মোল্লার। জীবন বাঁচাতে প্রাণপনে যুদ্ধ করেন কাছেদ।

নদী তীরে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসীরা দ্রুত ছুটে যান কুমিরের কবল থেকে কাছেদ কে উদ্ধার করতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। গ্রামের লোকদেরকে কাছেদ চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, হে গ্রামবাসী তোমরা এর প্রতিশোধ নিও। ঠিক এর শত বছর পর শিরগ্রামের কাছেদের পোতাছেলে সাহাদুল, রুবেল খান, শামিম খান ও হিয়া খানের নেতৃত্বে একটি কুমিরকে তারা মধুমতি নদী থেকে আটক করে।

গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি কুমির ধরা পড়ায় উত্তম প্রতিশোধ হিসেবে উল্লেখ করে আনন্দ প্রকাশ করেন। অনেকে ঠাট্টার ছলে বলেন ১৯১৭ সালে কাছেদকে ধরা সেই কুমিরের দৌহিত্র পোতা কুমির এটি। কুমির ধরার ছবিটি অত্রসাথ প্রোথিত করা হলো।   

মধুমতি নদী পাড়েই ছিলো রাজা সীতারামের রাজধানী : সীতারাম রাজা সপ্তদশ  শতাব্দীর শেষের দিকে ডাকাত, বর্গীদমনকারী, মগ ফিরিঙ্গি ও মধুমতি নদীতে জল দস্যুদের দমনকারী এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার কারণে দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তার  বাবা মুঘলদের তহশিলদার  ছিলেল। তিনি হরিহর নগরে বসতি স্থাপন করেন। সীতারাম রায় লাঠিখেলা ও অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।

তিনি একই সাথে আরবি ফারসি এবং বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। করিম খান সাতৈর পরগণায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালালে সুবাদার শায়েস্তা খান সীতারামকে, করিম খাকে প্রতিহত করার জন্য নির্দেশ দেন। করিম খা  ভূষণার যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে সুবাদার শায়েস্তা খান সীতারামকে নলদী পরগণা উপহার দেন। জায়গিরদারপ্রাপ্ত হয়ে সীতারাম একটা নিজস্ব সৈন্যবাহিনী তৈরি করেন।

জলদস্যু, বর্গী এবং  পাঠান দমনে তার অপরিসীম সাফল্য দেখে মহামতি মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। ইংরেজি ১৬৮৭ সালে তিনি রাজত্বপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমেই যশোহর প্রদেশের রাজধানী স্থাপনের চিন্তা করেন।

তিনি রানী কমলার সাথে একান্তে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ভূষণা নয়, হরিহরনগর নয়, মধুমতি নদী তীরে সূর্যকুণ্ডগ্রামের বাগজানি মৌজার নারায়ণপুর গ্রামে রাজধানী স্থাপন করার সংকল্প করেন। পরে তিনি সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। নতুন রাজ্যের রাজধানীর নাম দিলেন মহম্মদপুর।

কথিত আছে,  মহম্মদশাহ নামক একজন মুসলিম সুফি দরবেশের নামানুসারে তিনি নতুন রাজ্যের রাজধানীর নামকরণ  করেন মহম্মদপুর। যশোর খুলনার ইতিহাসের লেখক শতীস চন্দ্র মিত্রের মতে, ওই সময়  মহম্মদপুরে মহম্মদ শাহ নামে একজন সুফি দরবেশ আস্তানা গেড়েছিলেন।

রাজা সীতারাম তাকে ওই স্থান ত্যাগ করতে বললে তিনি তার নামানুসারে রাজধানীর নামকরণ না করলে তিনি  স্থান ত্যাগ  করবেন না মর্মে জেদ ধরেন। ফলে রাজা সীতারাম বাধ্য হয়েই তিনি রাজধানীর নাম মহম্মদপুর হিসেবে ঘোষণা করেন।

সেই সুফিসাধক মহম্মদপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তিনি মধুমতি নদীর পাড়ে নতুন রাজধানী নির্মাণ করে  আরাকান  জলদস্যু, ডাকাত ও বর্গীদের অত্যাচার, লুণ্ঠন খুন খারাবি বন্ধ করে মধুমতি নদীকে স্বাভাবিক মানুষের চলাচলের  সুবিধা করে দেন। প্রজাদের মধ্যে শান্তি ফিরে এলে রাজা সীতারাম প্রজাবৎসল রাজা হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত  থাকে।

বাদশাহ আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর আজিমুশ্বান বঙ্গেশ্বর হয়ে আসেন এবং তার একজন আত্মীয়কে ভূষণার ফৌজদার নিযুক্ত করেন। রাজা সীতারাম মুঘলদেরকে কর খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেন। তিনি মহম্মদপুর রাজের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

এসব বিষয় নিয়ে মুঘলদের সাথে তার দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে। তিনি মুঘলদের নিযুক্ত ভূষণার ফৌজদার তোরাপ আলী খার সাথে  যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ১৭১৩ সালে তোরাপ আলী খা মুর্শিদকুলী খার নিকট সৈন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন।

 ভূষণা থেকে মুঘলদের নিক্ষেপিত কামানের গোলা মহম্মদপুর রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছাতো না। তা মহম্মদপুর থেকে আট মাইল উত্তরে পাল্লা গ্রাম পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম ছিলো। ফলে  কামানের গোলা পাল্লা পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম হওয়ায়  গ্রামের নামকরণ হয় পাল্লা।

এর পরের বছর অনিবার্য কারণে তোরাপ আলী খার সাথে বারাসিয়া নামক জায়গায় রাজা সীতারমের সৈন্যদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এতে তোরাপ আলী নিহত হন। রাজা সীতারাম ভূষণা দখল করে নেন।

ফলে মুঘলরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠেন। রাজা সীতারাম মহম্মদপুর দুর্গ রক্ষার জন্য মধুমতি তীরে সৈন্যসমাবেশ করেন। তিনি মধুমতি নদীর চারিদিকে কামান স্থাপন করেন।

এদিকে মুর্শিদকুলি খান বক্স আলী খানকে ভূষণা স্টেটের ফৌজদার নিযুক্ত করে পার্শ্ববর্তী সকল জমিদারদেরকে সীতারামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলেন।

বঙ্কিম চন্দ্র উপন্যাসে উল্লেখ আছে যে, বক্স আলী খার সেকেন্ড সেনাধ্যক্ষ দয়াময় রায়ের সৈন্যরা যখন মহম্মদপুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তখন রাজা সীতারাম চিত্ত-বিশ্রাম গ্রামের বালাখানায় নারী নিয়ে মদ্যপান করে ফুর্তি করছিলেন।

এদিকে মহম্মদপুর দুর্গের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন সেনাপতি রামরুপ বা মেনাহাতি। সন্মুখযুদ্ধে জয় করা অসম্ভব বুঝতে পেরে মঘুল সেনাপতি দয়ারাম ঘৃণ্য গুপ্তঘাতক নীতি অবলম্বন করেন। একদিন কুজটিকার দিনে মেনাহাতি সকালে শৌচাগারে দিক গমন করলে পেছন দিক থেকে তাকে ছুরিকাহত করা হয়। অতঃপর তার মুণ্ডু কেটে মুঘল দরবারে দিল্লি পাঠানো হয়।

কিন্তু দিল্লিশ্বর ফররুখসিওর বীর সেনানীর এই ছিন্ন মস্তক দেখে  মুর্শিদকুলী খাকে বীর সেনানীকে বন্দি  না করে এইরূপ মুণ্ডু কর্তনের জন্য তিরস্কার করেন। পরে সেই ছিন্ন মস্তক মহম্মদপুরে প্রেরিত হলে রাজা সীতারাম ভূষণা থেকে নদী পার হয়ে মহম্মদপুর ফিরে আসেন এবং মেনাহাতির মৃত দেহের সৎকার করেন। প্রধান সেনাপতির মৃত্যুতে সীতারাম ভেঙে পড়েন। তারপর ও মহম্মদপুর দুর্গ রক্ষার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি।

মুঘল ছত্রছায়ায় সেনাপতি দয়াময় ঘোষ মধুমতি নদীর ওপাড়ে এলাংখালী ঘাটে এবং বক্স আলী খা হরিহর নগর ঘাটে  কামান স্থাপন করেন। প্রায় দুই দিন অবধি কামান যুদ্ধ চলা কালে কামানের কারিগর কর্মকাররা বারুদ সরবরাজ বন্ধ করে পালিয়ে গেলে রসদ সংকটে পরে যান রাজা সীতারাম। বক্স আলী খা ও দয়াময় ঘোষের নেতৃত্বে মুঘল সৈন্যরা নদী পাড় হয়ে মহম্মদপুর সদরে ঢুকে পরেন। এরপর দুর্গের প্রধান ফটকে আরো দুই দিন যুদ্ধ চলার পর

মহম্মদপুর রাজের পতন ঘটে। মুঘল সৈন্য রা মহম্মদপুর ঢুকে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। অধিকাংশ ব্যবসায়ী মহম্মদপুর ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যান। রাজা সীতারাম সপরিবারে বন্দি হন এবং তিনি মুর্শিদাবাদে নীত হন। সীতারামের মৃত্যু নিয়ে তিনটি মতবাদ চালু আছে।

প্রথমত, (১) তিনি নবাব কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে মুর্শিদাবাদের কারাগারে  মারা যান।

দ্বিতীয়ত, তিনি  বন্দিশালায় বিষুঙ্গরি চুষে আত্মহত্যা করেন। তৃতীয়ত, মুর্শিদাবাদ নেয়ার পথে তিনি মুঘল সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ হারান মর্মে যদুনাথ সরকার তাহার বইতে উল্লেখ করেন। ইংরেজ লেখক স্টুয়েট এবং বংকিম সীতারাম রাজার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেছেন। তিনি নাকি কোনো রাজা ছিলেন না।

তিনি শুধু সাতৈর এবং নলদী পরগণার জমিদার ছিলেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, মুঘল বাদশাহদের রাষ্ট্রীয় ফরমান ছাড়া কেউ রাজা উপাধি পেতে পারেন না। ওই সময় মহামতি মুঘলদের বাদশা ছিলেন আওরঙ্গজেব। তিনি এই তিন বছর রাষ্ট্রের কোনো কাজ করতেন না এমন কি রাজদরবারেও বসতেন না।

তিনি সীতারামকে রাজাধিরাজ উপাধির কোনো ফরমান  দেননি। রাজা সীতারাম ছিলো স্বঘোষিত রাজা। তাকে চরিত্রহীন  লম্পট, মদ্যপ, দস্যু, ডাকাত ও শত নারীর শয্যা সঙ্গিনী  হিসেবে বিধৃত করেছেন। তাদের মতে সীতারামের চারজন স্ত্রীসহ শতাধিক উপ-পত্নী ছিলো।

তিনি রাজধানীর পাশেই চিত্ত- বিশ্রাম গ্রামে রঙ্গশালা খুলেছিলেন। নতুন নতুন নারীদেরকে নিয়ে তার ওই রঙ্গশালায় ভোগ বিলাসে মত্ত থাকতেন রাজা সীতারাম। জনশ্রুতি ও নিন্দুকেরা এও বলে তার অপবাদ রটনা করেন যে, তিনি কৌতুহলবশত গর্ভবতী নারীদের পেট চিরে দেখতেন যে সন্তান কিভাবে থাকে।

এছাড়া প্রাতঃস্নান করার সময় পুকুরের দু’ধার দিয়ে যুবতী নারীদেরকে দাঁড় করিয়ে রাখতেন এবং তিনি তাদের স্তনযুগল স্পর্শ করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেন।

ইংরেজ লেখক স্টুয়ার্ট, বঙ্কিম এবং  জনশ্রুতির অনুরূপ অপবাদ যদুনাথ সরকার এবং শতীসচন্দ্র মিত্র ঘৃণাভরে উহা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমি নিজেও মহম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান করে তার উপর আনয়ন করা ওই রূপ অভিযোগের কোনো সত্যতা পাননি। বরং রাজা সীতারাম ছিলেন বাঙালির শৌর্যবীর্যের প্রতীক।

তিনি স্বাধীনচেতা একজন বীর বাঙালি রাজা ছিলেন।  কেবল মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেননি বলে তার ভাগ্যাকাশে এই দুর্যোগের ঘনঘটা। একজন প্রজাবৎসল ও  স্বাধীন রাজা হিসেবে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের হূদয়ের মণিকোঠায়।

তার অনেক কীর্তি আজও কালের সাক্ষী হিসেবে মহম্মদপুরে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছারি ঘর, দোলমঞ্চ, রামসাগর, দুধ সাগর, কল্পিত যমুনা নদী, দীঘি,পূজা অর্চনার জন্য নির্মিত মন্দির ঘর এবং ভঙ্গুর রাজপ্রাসাদ আজও এককালের যশোহর প্রদেশের রাজধানী হিসেবে স্বমহিমায় দণ্ডায়মান।   

নদীতে অবগাহন করা কৃতী সন্তানদের অন্বেষণ :  মধুমতি নদীর দু ’কুল পাড়ে শুধুই  গ্রাম আর গ্রাম। গ্রামের পাড়ে হাজার বছরের জনবসতি বিভিন্ন বর্ণ-গোত্রের। মূলত, কৃষিই তাদের মূল পেশা।এই কৃষক পরিবার  থেকেই জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক কৃতীসন্তান। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আ. রউফ জন্মগ্রহণ করেছেন সেলামতপুর গ্রামে।

পাকহানাদার বাহিনীর সাথে সন্মুখযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন নড়াইলের লোহাগড়ার ইতনা চরভাটপাড়ার ৩৯ বীর মুক্তিযোদ্ধা, কাশিপুর গ্রামের শহীদ আবির হোসেন, পাল্লা গ্রামের আপন দু’ভাই শহীদ আহমদ-মহম্মদ, ’৭১ সালে আরো প্রাণ দিয়ে ছিলেন গোপাল নগর গ্রামের রহমান, ছলেমান, ফার্সিচর গ্রামের করিম মোল্লা, কোমরপুর গ্রামের আ’ রাজ্জাক, লংকারচর গ্রামের অবনীকান্ত, নওপাড়া গ্রামের মালেক কলুসহ প্রায় শাতধিক নিরীহ মানুষ।

নদী পাড়ের এই উর্বর : ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক কবি সাহিত্যিক।  মাঝাইল মান্দারতলা গ্রামের মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমেদ, সিন্দাইন গ্রামের বিশিষ্ট সাহিত্যিক সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যুক্তফ্রন্টের মিনিষ্টার রামপুর গ্রামের  আ. খালেক,  বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী তপন সরকার  বসুর ধুলজুরি  গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

তিনি এই নদীর পাড়ের ধুলজুরি স্কুলে অষ্টম শ্রেণ পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৯৭৭ সালে কলকাতায় চলে যান।এই মধুমতির জলে অবগাহন করে   জজ ব্যারিস্টার হয়েছেন অনেকেই। এ গাঙেই ছিলো তাদের নিত্যস্নান, সাঁতার কাটা, বালুচরে পাখির ডিম ভাঙ্গা, ভেলা কিংবা নৌকা নিয়ে সারাদিন রাত মাতামাতি। তাদের মধ্যে কাশিয়ানী থানার লাটগ্রামের জেলা ও দায়রাজজ

শেখ মফিজুর রহমান, লোহাগড়া থানার  ইতনা গ্রামের জেলা  ও দায়রা জজ  মো.  কামরুল ইসলাম, কাশিয়ানী থানার সাহাপুর গ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট মো. পারভেজ মহম্মদপুর থানার গোপাল নগর গ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইমদাদ হোসেন, একই থানার মাধবপুর গ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট  আল আমিন কামারখালির মসনন্দপুর গ্রামের যুগ্ম জেলাও দায়রা জজ মি. শিমুল বিশ্বাস এবং তার সহধর্মিণী  সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শম্পা বসু। বিচার জগতের এই সব কৃতী সন্তানরা মধুমতি নদীর গৌরব উজ্জ্বল করেছেন।

গত ২০১৭ সালের এক বেসরকারি জরিপে সার্ক রাষ্ট্রভুক্ত আাাটটি দেশের  এক হাজার ২৭৭টি জেলার মধ্যে লিগ্যাল এইড  কার্যক্রম ও বিচার বিভাগীয় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে  শ্রেষ্ঠ জেলা জজ হিসাবে বিবেচিত  হন সাৎক্ষীরার বর্তমান জেলা ও দায়রা জজ  শেখ মফিজুর রহমান। তার বাড়ি কাশিয়ানির লাটগ্রামে।

অপরদিকে মধুমতি পাড়ে জন্মগ্রহণ করা মেধাবী জজ বিচার জগতের উজ্জল জৌতিস্ক মাগুরার বর্তমান জেলা ও দায়রা জজ মো. কামরুল ইসলাম। তার বাড়ি লোহাগড়ার ইতনা গ্রামে। কিন্তু মধুমতি নদীর  মনে অপার দুঃখ যে, এই নদীতে হেসে খেলে বড় হওয়া এই সব বিচারক রা  মধুমতি নদীকে নদীশাসনের নামা করে মানুষেরা যে অত্যাচার করেছে   মধুমতি নদী  এই বিচারক দের  কাছ থেকে তার বিচার পায় নাই।

তবু ও নদী নিরবধি  তার দুই পাড় দিয়ে প্রতিনিয়ত কৃতি সন্তান সৃষ্টি  করে  যাচ্ছে।এটাই  মধুমতির  বড় মাহাত্ম। যেভাবে সৃষ্টি হলো মধুমতি নদীর ইতিহাস জানার কৌকূহল পেশাগত দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাগুরা শহরে আমার বাস। মূলত আমার বাড়ি গ্রামে। গ্রামটি মধুমতি নদীর পাড়ে।গ্রামের নাম শিরগ্রাম।  মাগুরা শহরে প্রত্যাহ প্রাতঃভ্রমণ করি মাগুরার বন্ধুদের সাথে।

প্রফেসর  ড. রইচউদ্দিন, প্রফেসর আবজাল হোসেন, জেলা প্রশাসনের ইঞ্জিনিয়ার হাসান সাহেব,  ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা বাবর আলী, পেশকার শফিকুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, বিশিষ্ট রাজনীতি বিদ আ. মান্নান ব্যাবসায়ী মাসুদ রানা তপন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আকিদুল ইসলাম আমার সতীর্থ।

প্রাতঃকালে  হাঁটার সময় আমাকে খোটা দেয়। কারণ এই যে, নদীর তীরে আমার বাড়ি অথচ আমি তাদেরকে নদী দেখাই নাই। তাদের এই অভিযোগের পরি সমাপ্তি ঘুচাতে একদিন সিদ্ধান্ত হয় নদীভ্রমণের। ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি সময়। দিনক্ষণ পরে গেলো। ট্রলার, বাবুর্চি, খাবার মেনু, যাত্রাপথ সবই ঠিকঠাক।

মাগুরা শহর থেকে ২৭ কি.মি. দূরেই প্রাণের মধুমতি নদী। মাইক্রো চেপে রওয়ানা দিলাম। সকাল ৮টা অবধি পৌঁছে গেলাম মহম্মদপুরের শেখ হাসিনা সেতুর পশ্চিম পাশে। গন্তব্য হবে  উজানে ৩০ কি.মি. পর্যন্ত লাঙ্গল বাধ বন্দর।

ভরা ভাদরে মধুমতির রূপ- যৌবন  যে দেখে নাই তার জীবন যেন অসমাপিকা ক্রিয়া। গাংচিলের  পাখামেলা, মাছ রাঙ্গার মাছ ধরার  সুনিপুণ কৌশল, জেলেদের রূালী ইলিশ জালে আটকানো দৃশ্য, পাল তোলা সারিবদ্ধবাহারী নৌকার ছলাৎছল চলার দৃশ্য , কলসী কাংখে গাঙ্গের ঘাটে।

বধুয়ার জলকে চল, কিশোর কিশোরী দের জলকেলি খেলা, পুবালি বাতাসে টলমল ট্রলার,  ঢেউয়ের আড়িতে ভেসে যাওয়া ট্রলারের পাটাতন, ভয় আর রোমাঞ্চ নিয়ে কখন যে বেলা বয়ে গেছে তা ঠাহর করতে পারি নাই। ভর দুপুরে চণ্ডিবিলা গ্রামের এক গেরস্ত বউকে ছাগল প্রজনন কাজে দূর কোনো গ্রামে যেতে দেখা গেল। লজ্জায় হিম হয়ে যাওয়া ওই ঝি বউকে আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করা সাজে নাই।

দাতিয়াদহ গ্রামের নদীর ঘাটে পাট ধৌতকরণ কাজ করছিলেন এক দম্পতি। ধোয়া পাট পরে যাওয়ায়, এই মাগীর মেয়ে সাবধানে নিতে  পারস নে। বলে খিস্তিখেউড় করছিলেন মহিলার স্বামী। কোমরপুর গ্রামের আরেক ঘাটে গরুতে মাস কলাই খাওয়ায় দুই গেরস্তের মারামারি দেখলাম। দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রণসজ্জায় সজ্জিত। আমরা তাদের থামালাম।

মাঝে মাঝে কোনো কোনো কপালপোড়া গেরস্তের উঠানের ভগ্নাবশেষ নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার দৃশ্য চোখে পরে। সবই নদীর খেলা। নদীর পাড়ে বসবাসরত  এই সব ভাগ্য বিড়ম্বিত লোকদের সাথে কথা হলো। তাদের হূদয়ের কান্না থামাবে কে? জুমার নামাজ শেষে কোমরপুর গ্রামের কিছু সুধীজনের কাছে এই নদীর নামকরণ, নদীপাড়ে মানুষের জীবন বৈচিত্র্য নিয়ে কথা হয়।

নদীর বাঁকে বাঁকে ট্রলার থামিয়ে নদী নিয়ে নানান তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করি। দুপুরের আহারে পর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আ. রউফের বাড়ি সেলামতপুর গ্রামে গিয়ে তার স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ ঘুরে দেখি। আবার ট্রলার চলে উজান গাঙ্গে। কামারখালী ব্রিজ পার হয়ে সব ঘাটে ঘাটে  চলে  নদীর আদ্যোপান্ত অন্বেষণের কাজ।

যেন হাজার বছরের নদী পাড়ের অজানা গৌরবের  ইতিহাস,  সূঁচ দিয়ে  খড়ের গাদা থেকে একটি সূঁচ খোজার অদম্য প্রাণান্ত প্রচেষ্ঠা। বেলাশেষে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি। যখন ডুমাইন বাঁক থেকে  আমাদের ট্রলার ভাটির দিকে ফিরতেছিল তখন দূরের কোনো গাঁও গেরাম থেকে ভেসে আসছিল সাউন্ড বক্সে বাজতে থাকা হেমন্ত বাবুর কণ্ঠ, সাগরে মিশিলে নদীর মরণ নাহি হয়, সেই সাগর থেকেই হয়রে ভাই মেঘেরই উদয়। মনরে তুই মূর্খবড়।

লেখক : কলামিস্ট, বিশ্লেষক, আইনজীবী মাগুরা বার।             

আমারসংবাদ/এআই