Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪,

ইসরায়েল এবং আমিরাত ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

অক্টোবর ২১, ২০২০, ০৭:৪০ পিএম


ইসরায়েল এবং আমিরাত ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

ইউনাইটেড আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যকার সামপ্রতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি আঞ্চলিক মেরুকরণের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইহুদি ইসরায়েল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানের শেষ সুযোগ ধ্বংস করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

তিনি বলেছেন, তেল আবিব আমেরিকার তৈরি ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে যা ইসরায়েলকে পশ্চিম তীরের প্রায় গোটা অংশকে গ্রাস করার সুযোগ করে দিয়েছে। মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে দেয়া ভাষণে এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ইসরায়েল সহজেই ফিলিস্তিনিদের আরো ৩৩ শতাংশ ভূমি জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করে নিতে পারবে যা এর আগের শান্তি পরিকল্পনাগুলোর মারাত্মক লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।

প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ফিলিস্তিনি জাতি আত্মসমর্পণ করবে না বরং তারা তাদের ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবে এবং একদিন অবশ্যই বিজয়ী হবে।

তিনি আগামী বছরের গোড়ার দিকে একটি ‘প্রকৃত শান্তি প্রক্রিয়া’ শুরু করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের প্রতি আহ্বান জানান। মাহমুদ আব্বাস বলেন, হত্যা ও দখলদারিত্ব টিকে থাকা পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কিংবা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব নয়।

আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া কার্যত মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার সমীকরণে বিরাজমান উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সামরিক শক্তিতে বলীয়ান ইসরায়েলের জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি বড় ধরনের সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমিরাতের পথ ধরে আরো কয়েকটি আরব কিংবা মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

 এমনটি বাস্তব হলে আরব অঞ্চলে অনেকটাই একঘরে ইসরায়েল নিজের রাজনৈতিক অভিপ্রায় পূরণে আরো সক্ষমতা অর্জন করবে। আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের স্বাভাবিকতা কার্যত ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির সূচনা করতে পারে।

একইসঙ্গে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রস্বপ্নকে চুরমার করে আঞ্চলিক পর্যায়ে তেল আবিবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য লড়াইয়ে আরব দেশগুলোর কৌশলগত সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে ইসরায়েল। এই পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন আসন্ন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।

যদিও ঘটনাটি এমন সময় ঘটছে, যখন সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতিই মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশেষত, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে পশ্চিমাপন্থিদের পরাজয়, আঞ্চলিক পর্যায়ে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিম এশিয়া জুড়ে মার্কিন আধিপত্য পড়েছে ঝুঁকির মুখে। বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে একক মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল অক্ষটি রীতিমতো শক্তিশালী হয়েছে।

মূলত সিরিয়ায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপজনিত গৃহযুদ্ধের নিষ্পত্তি আঞ্চলিক শক্তিব্যবস্থায় আমেরিকা ইসরায়েলবিরোধী অক্ষের জন্য কৌশলগত বিজয় হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক প্রতিরোধ অক্ষের সক্ষমতা বেড়ে গেছে বহু গুণ।

একই সঙ্গে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সিরিয়া-রাশিয়া-ইরানের সামরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে তেহরানের নেতৃত্বে নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে প্রতিরোধশক্তি। মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতার এই ভিন্নতাই আমেরিকা ইসরাইয়েলের জন্য মাথাব্যথার কারণ। যে কারণে আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দীর্ঘ প্রচেষ্টাই এই মুহূর্তে আমেরিকার জন্য তুরুপের তাস।

যে প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক শক্তিব্যবস্থার হঠাৎ ভারসাম্যহীন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের মার্কিন প্রচেষ্টা হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। সঙ্গত কারণেই আঞ্চলিক পরিস্থিতির যে পরিবর্তন অত্যাসন্ন বলে দৃশ্যমান হচ্ছে তার বাস্তবিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে।

অন্যদিকে বর্তমান সমীকরণে অনেকটাই চাপমুক্ত ইরান সিরিয়া লেবাননসহ তাদের অনুগত প্রতিরোধ ফ্রন্ট এই ভিন্ন পরিস্থিতিতে কী কৌশল গ্রহণ করবে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে প্রায় ১৩টি দেশে আমেরিকার সরাসরি সামরিক ঘাঁটি আছে।

অন্যদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহরের হেড কোয়ার্টার্স হচ্ছে বাহরাইনে। বলা চলে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মার্কিন সেনারা। এই অঞ্চলে উপস্থিত মার্কিন সেনাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইসরায়েলের নিরাপত্তাভীতি দূর করা এবং অন্যান্য মার্কিন স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা।

আর এই প্রধান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে ইরানকে সব দিক থেকে কোণঠাসা করে রাখা অত্যন্ত জরুরি। বিপরীতে এই মুহূর্তে মার্কিন সেনারাই কিছুটা চাপে আছে। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়— মাত্র কয়েক দিন আগে সিরিয়ার অভ্যন্তরে একটি মার্কিন সেনাবহরের টহল আটকে দিয়েছে সিরিয়ান সেনারা। উপরিউক্ত বাস্তবতাই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ইতিহাসের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে বলে সবাই ধারণা করছেন।

ফলে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ইরানি দাবিই যেনো প্রবল হয়ে উঠছে। ইরানের দাবি যে শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। এর একটি মাত্র উদাহরণ হতে পারে ইরান কর্তৃক মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।

উল্লেখ্য, গত জানুয়ারিতে মার্কিন গুপ্ত হামলায় এলিট ফোর্স আইআরজিসির কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি নিহত হলে মাত্র ছয় দিনের মাথায় ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইরানের সেনাবাহিনী।

গত ১০০ বছরের মধ্যে সরাসরি মার্কিন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে প্রথম কোনো দেশ হিসেবে ইরানের ওই ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ ছিলো একটি বিরল ঘটনা। আমেরিকা কর্তৃক এর প্রতি আক্রমণ না হওয়াটাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

এটি স্পষ্টত সামরিক সমীকরণের প্রভাব। যে কারণে দীর্ঘ দিনের শত্রু ইরানের আক্রমণের মুখেও নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হয় আমেরিকা। এটি শুধু পশ্চিম এশিয়া বিষয়ে পেন্টাগনের কৌশলে পরিবর্তন নয়, একটি ভিন্ন বাস্তবতাকে সঠিকভাবে পর্যালোচনা করার বিচক্ষণতা।

এ কথা খুব পরিষ্কার যে দীর্ঘ সময় থেকে আঞ্চলিক পরিসরে একক মার্কিন আধিপত্য এখন বহুমেরু ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এখন এটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে সমগ্র দুনিয়াই এখন বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর যুগে বিশ্বব্যাপী বলদর্পী মার্কিন নীতির প্রতিক্রিয়ায় যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোর সমাধান প্রয়োজন।

এই বৈশ্বিক উপলব্ধির প্রাণকেন্দ্রে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। যেখানে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব একটি স্থায়ী সংকট। গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আরব ইসরায়েল সংকট এই আলোকেই ঘনীভূত হয়।

কিন্তু ইতিহাসের দুর্ভাগ্য হলো এই যে আজ আরব জাতিয়তাবাদী দেশগুলোই ইসরাইলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাল্টে দিচ্ছে চাকা। যে কারণে স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পতে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন। তাই ১৯৪৭ সালের বিভক্তি পরিকল্পনা মোতাবেক ইসরায়েল নামক যে রাষ্ট্রটির জন্ম, তারাই আজ সমস্ত ফিলিস্তিনি ভূমির মালিক।

আর বাস্তবতার মধ্যে পশ্চিম এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইউনাটেড আরব আমিরাত কর্তৃক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্তটি আঞ্চলিক পরিসরে বিরাজমান স্থিতাবস্থার অবসান করবে। ফলে সিরীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট ইরান, সিরিয়া, লেবাননভিত্তিক প্রতিরোধ অক্ষের সম্মিলিত শক্তি সক্ষমতা নতুন করে চাপে পড়বে। বিশেষ করে ইরান।

পারস্য উপসাগরীয় উপকূলের দুই দেশ ইরান ও আরব আমিরাতের মধ্যকার সার্বভৌম বিরোধ আগে থেকেই লেগে ছিলো। এর মধ্যে শত্রু দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ইরান-আমিরাত দ্বন্দ্ব শিগিগরই উত্তেজনার দিকে মোর নিতে যাচ্ছে।  

আরব বিশ্বের মধ্যে আমিরাতের সামরিক সক্ষমতা এবং সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা অন্য যে কারো চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ইয়েমেনে এর ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ, লিবিয়ায় ছায়া যুদ্ধ, তিউনিসিয়া, তুরস্ক এবং কাতারের প্রতি তার অস্থিতিশীল নীতি এবং সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ ও মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির মতো আঞ্চলিক স্বৈরশাসকের পক্ষে সমর্থন প্রমাণ করে আরব আমিরাত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ‘নব্য ইসরায়েল’।

মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন ভূরাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে এটি অনুধাবন করা যাবে না। পশ্চিম তীরে ইসরায়েল যে অবৈধ বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে, সেটা নিয়ে নীরব লড়াই তো চলছেই। ইসরায়েলকে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিতে।

গাজার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিতে হবে। পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের চলাফেরার ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে। অন্যথায়, এই ধরনের চুক্তি ফিলিস্তিনির জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনো ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় না।

 এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি রাষ্ট্রের অধীনে ইহুদি ও ফিলিস্তিনিরা সমান অধিকার নিয়ে থাকবে, যেখানে দুটি জাতির স্বায়ত্তশাসন থাকবে। বিখ্যাত কলামিস্ট ও অধ্যাপক পিটার বেইনার্ট সমপ্রতি ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে মন্তব্য করেন।

বাস্তব অবস্থার সাপেক্ষে ‘টু স্টেট সল্যুশন’ সঠিকভাবে কার্যকর করা আর সম্ভব না দাবি করে তিনি বলেন, ‘এখন প্রয়োজন দুই জাতির জন্য সমান সুবিধাসম্পন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রচলন করা।’

আমারসংবাদ/এসটিএম