Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

উন্নয়নশীল প্রতিযোগিতায় সফল ভিয়েতনাম

রায়হান আহমেদ তপাদার

নভেম্বর ১, ২০২০, ০৭:০২ পিএম


উন্নয়নশীল প্রতিযোগিতায় সফল ভিয়েতনাম

অর্থনীতির দিক দিয়ে একদা অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা ভিয়েতনাম দেশটি বর্তমানে এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে। এই অসাধারণ উন্নতির পেছনে ইনফরমেশন টেকনোলজি এবং খনিজ তেলের উৎপাদন থেকে শুরু করে কাজুবাদাম, কফি, কালো মরিচ ও ধান রপ্তানিতে বিশ্বের বাজারে থাকা সন্তোষজনক স্থান। পৃথিবীতে ভিয়েতনাম কফি রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানে।

আপনারা ভিয়েতনামে যদি কখনো বেড়াতে যান বা ভিয়েতনামের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেন তাহলে হোচিমিন এবং গুয়েন শব্দটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ভিয়েতনাম বিশ্বের ১৪তম জনবহুল একটি দেশ। ভিয়েতনাম পৃথিবীতে এমন একটি দেশ যেখানে রান্নাঘরে দেবতা আছে, যার নাম ওং তাও।

ভিয়েতনামের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি মূলত সামাজিক ঐক্য এবং পারিবারিক রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে গঠিত। ভিয়েতনামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব যাকে টেট উৎসব বলে। ভিয়েতনামের মানুষ নতুন বছর উপলক্ষে তা পালন করেন।

এছাড়াও ভিয়েতনামে পাগোদা ধার্মিক প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। যাই হোক, বর্তমানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভিয়েতনাম হয়ে উঠেছে এক উন্নতশীল দেশ। ভিয়েতনাম একটি একক দল রাষ্ট্র, যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিশ্চিততা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও বিকাশের সমর্থনের জন্য উপস্থাপিত হয়।

তদুপরি, ভিয়েতনাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডাব্লুটিও), আসিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি (এইসি) ও ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি)-এর জন্য বিস্তৃত এবং প্রগতিশীল চুক্তি যা ভিয়েতনামকে যথাক্রমে স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

 এছাড়াও ভিয়েতনামের অন্যান্য দেশের সাথে বেশ কয়েকটি বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে; দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য (বিটিএ) এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ)। এই বাণিজ্য চুক্তিগুলো ছাড়াও ভিয়েতনাম কয়েকটি ডিটিএর সাথে প্রায় ৮০টি ডাবল ট্যাক্স এড়য়েডেন্স চুক্তি (ডিটিএ) স্বাক্ষর করেছে।

আরও আলোচনায় আছে, কানাডা, মেক্সিকো এবং পেরুর মতো বাজারে অ্যাক্সেস খুঁজছে এমন কিছু ব্যবসায়ের জন্য ভিয়েতনাম আপনার ব্যবসায়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে। চীনে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম ঘোষণাটি দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ভিয়েতনাম করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মরিয়া।

গণহারে খুদে বার্তা, টিভি বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড পোস্টার, মাইক ব্যবহার করে সরকার দেশটির ১০ কোটি মানুষকে ভাইরাসটির বাহক ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত (কন্টাক্ট ট্রেসিং) করতে উৎসাহ জোগায়।

এমনকি সংস্পর্শের পর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতেও নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। এরপর ভাইরাসবাহক ও পর্যায়ক্রমিক সংস্পর্শে আসা লোকদের দ্রুত আইসোলেশনে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে প্রকোপ আটকাতে পারায় ভিয়েতনাম এখন কোভিড-১৯ মৃত্যুহারে বিশ্বের চতুর্থ সর্বনিম্ন রাষ্ট্র।

বর্তমান মহামারি নিয়ন্ত্রণের সুযোগে ভিয়েতনাম দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করতে সক্ষম হয়। ফলে দেশটি এ বছরের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। মহামারির কারণে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি সংকোচনের শিকার হলেও ভিয়েতনাম ৩ শতাংশ বার্ষিক গতিতে উন্নতি করছে।

বিশ্ববাণিজ্যে ধস সত্ত্বেও রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দিয়েই প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে দেশটি। এই রক্ষণশীল যুগে উন্মুক্ত সীমান্তের কমিউনিস্ট চ্যাম্পিয়ন ভিয়েতনাম এখন বিশ্ববাণিজ্যে একটি নমনীয় দেশও। ভিয়েতনাম এখন এক ডজনের বেশি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ, যার সর্বশেষটি হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে।

প্রশ্ন হচ্ছে— স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের ভিয়েতনাম কি তার এই সাফল্য ধরে রাখতে পারবে? সম্ভবত পারবে। এখন পর্যন্ত দেশটির সরকার এমন ধরনের কোনো মারাত্মক নীতিগত ভুল করেনি, যা সাধারণত স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।

অন্যান্য উদীয়মান রাষ্ট্রগুলো যখন ভোটারদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টায় সমাজকল্যাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে, তখন ভিয়েতনাম রপ্তানি বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ আহরণে রাস্তাঘাট ও বন্দর উন্নয়ন এবং শ্রমিকদের শিক্ষিত করতে স্কুল নির্মাণে সম্পদ ব্যয় করছে।

সরকার প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ বিনিয়োগ করছে নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে এবং উন্নয়নের একই পর্যায়ে থাকা অন্যান্য জাতির তুলনায় তারা অবকাঠামোর গুণগত মানের জন্যও উচ্চতর মানও অর্জন করেছে।

বৈদেশিক অর্থও একই পথে পরিচালিত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগের বেশির ভাগই যাচ্ছে উৎপাদন কারখানা ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো খাতে এবং এর বেশির ভাগ আসছে সহযোগী এশীয় দেশ— দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন থেকে।

সস্তা মজুরি সন্ধানে চীনকে বাদ দিয়ে ভিয়েতনাম এখন রপ্তানিপণ্য উৎপাদকদের প্রিয় গন্তব্য। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকের তুলনায় দেশটির বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়ে প্রায় তিন হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

অথচ এখন দেশটিতে শ্রমের মূল্য চীনের অর্ধেক এবং তাদের জনশক্তিও অস্বাভাবিকভাবে সুশিক্ষিত। এই দক্ষ শ্রমিকরাই ভিয়েতনামকে উপরে তুলে দিচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান অত্যাধুনিক পণ্য উৎপাদনে সহায়তা করছে। প্রকৃত এশিয়ান মিরাকলগুলো যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিল, ভিয়েতনামকে একই পথ অনুসরণ করতে হচ্ছে একেবারে নতুন একটি যুগে এসে।

যে পরিস্থিতিতে প্রকৃত মিরাকল ঘটনা সম্ভব হয়েছিল, তা এখন নেই। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এখন ধীরগতিতে চলছে। ফলে আগের মিরাকল কৌশলগুলো এখন আর অগ্রাহ্য করছে না পরাশক্তিগুলো। তাইতো গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ এনেছে, ভিয়েতনাম কারেন্সি ম্যানিপুলেশন করছে এবং চীনের বিরুদ্ধে যে শুল্ক যুদ্ধের (ট্যারিফ ওয়ার) সূচনা ঘটিয়েছিল সেই একই ধরনের তদন্ত ভিয়েতনামের বিরুদ্ধেও শুরু করেছে। এ বৈশ্বিক হুমকি ছাড়াও দেশটির অব্যাহত প্রবৃদ্ধির জন্য আরও বড় হুমকি হচ্ছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলে আসা একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।

কারণ বিরোধিতা না থাকলে বাতিকগ্রস্ত শাসনব্যবস্থা বিভ্রান্তিকর অর্থনীতির উত্থাপন পতনচক্র তৈরি করে, যা উন্নয়নকে থামিয়ে দেয়। প্রকৃত এশিয়ান মিরাকল রাষ্ট্রগুলো তাদের উত্থানের বছরগুলোতে বার্ষিক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল।

২০১০-এর দশকে বিশ্ববাণিজ্য মন্দায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রতিবছর ১৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। ভিয়েতনাম তার বাজারের আকার, তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাজারের আকার জিডিপি এবং পণ্য ও পরিষেবাদি আমদানির দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়।

আইসিটি গ্রহণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং মোবাইল-সেলুলার টেলিফোন, মোবাইল ব্রডব্যান্ড, স্থির ইন্টারনেট এবং ফাইবার ইন্টারনেটের সাবস্ক্রিপশন দ্বারা পরিমাপ করা হয়। দক্ষতা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ের গতিবেগ ভিয়েতনাম সবচেয়ে খারাপ করেছে। দক্ষতাগুলো দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কর্মীশক্তির শিক্ষা এবং দক্ষতা সেট বিশ্লেষণ করে পরিমাপ করা হয়।

প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষা, স্বচ্ছতা, কর্পোরেট প্রশাসন এবং সরকারি খাত দ্বারা পরিমাপ করা হয়। ব্যবসায়ের গতিশীলতা দেখছে যে ব্যবসায়ের জন্য প্রশাসনিক প্রয়োজনীয়তাগুলো কীভাবে স্বচ্ছন্দ এবং কীভাবে দেশের উদ্যোক্তা সংস্কৃতি প্রসারিত।

এছাড়া ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসাবে ভিয়েতনামের উত্থান এখন সুপরিচিত। ভিয়েতনামের নিখরচায় বাণিজ্য চুক্তি এবং স্বল্প শ্রম ব্যয়ের কারণে বিনিয়োগকারীরা রপ্তানি উৎপাদনের গন্তব্য হিসাবে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করতে উৎসাহিত করেছে।

উল্লেখ্য যে, ব্যাংক অব আমেরিকা মেরিল লিঞ্চ স্টাডি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেড়েছে ৬শ মিলিয়ন মার্কিন উদ্বৃত্তের সাথে। কফি শপ, রেস্তোরাঁ, শপিংমল এবং বিমানবন্দরগুলোতে বিনামূল্যে ওয়াই-ফাই অ্যাক্সেসের সাথে দেশের ইন্টারনেট সংযোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

ভিয়েতনামের দ্রুত মোবাইল ডেটা বিশ্বের সস্তার মধ্যে অন্যতম। তদুপরি, ভিয়েতনাম একটি বৃহৎ সফ্টওয়্যার রপ্তানিকারী হিসাবে, এটি এখন ফিনটেক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো ক্ষেত্রে প্রসারিত হচ্ছে। এবং শ্রমের দক্ষতায় প্রতিযোগিতামূলক সূচক কমবেশি ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য হয়।

ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে ভিয়েতনাম উপকৃত হওয়ায় উচ্চ দক্ষ শ্রমিকরা প্রিমিয়াম। যদিও তাজা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা প্রচুর পরিমাণে, বেসিক প্রশিক্ষণে এখনো সময় প্রয়োজন।

তদুপরি, উচ্চ দক্ষ শ্রমিকরা আরও ভালো প্যাকেজের দাবি করতে পারেন এবং সংস্থাগুলো উচ্চতর টার্নওভারের হার দেখছে। পরিস্থিতি উন্নতির সাথে সাথে, উচ্চ দক্ষ শ্রমিকদের মন্থন করার জন্য আরও বেশি বৃত্তিমূলক বিদ্যালয় এবং কারিগরিকেন্দ্র স্থাপন করে সরকারকে এটিকে মোকাবিলা করতে হবে। সর্বোপরি ভিয়েতনাম হতে যাচ্ছে এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ।

বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাবকালে এই অর্জন এলেও দীর্ঘ সময় ধরেই এই পথে হাঁটছিল দেশটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান ছিলো প্রথম এশিয়ান মিরাকল (বিস্ময়)। তারপর তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং সমপ্রতি চীন। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে এবং নিজেদের উৎপাদন রপ্তানির পাওয়ার হাউসে পরিণত করে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসে এসব দেশ। এখন ভিয়েতনাম একই পথ অনুসরণ করছে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এসটিএম