Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

পাক-ভারত উত্তেজনা ও চীন

অক্টোবর ৫, ২০১৬, ০৫:৫৮ এএম


পাক-ভারত উত্তেজনা ও চীন

সেই ১৯৭১ সালের মতো মহাচীন সগর্জনে সমর্থন দিয়েছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের পুরনো স্বভাব ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হানা দেয়া। সারা বিশ্বব্রহ্মান্ডে পাকিস্তানের অপযশ আর কুখ্যাতির সীমা নেই। তালেবানের জন্মদাতা-দেশ পাকিস্তান। যে তালেবানরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রকেই ধ্বংস করেছে। তালেবানের মহাগুরু লাদেন কোনো ধার্মিক নন, একজন সন্ত্রাসী কম্পিউটার। মিস গাইডেড ডিনিয়াস। তিনি ৯/১১তে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করলেন। এর চেয়ে মহা অপকর্ম আর কী হতে পারে? ওটার নাম ছিলোতো বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র। ওখানে পৃথিবীর সব মানুষের সম্পর্ক ছিলো।

লাদেন যাদের হত্যা করেছিলেন, তারা ছিলেন নির্দোষ মানুষ। তাদের হত্যা কেন? টুইন টাওয়ার সব মানুষের ব্যবসার তীর্থভূমি। তাজমহল সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করলেও তা হয়ে উঠে বিশ্বের সকল মানুষের সম্পদ হিসেবে। সাম্রাজ্যবাদের নীতিকে ঘৃণা না করে, তার আগ্রাসনকে ঘৃণা না করে মার্কিন সভ্যতার ওপর, নাগরিকদের ওপর হামলা করেছিলো লাদেন। এই লাদেন ও তার তালেবান পাকিস্তানের মাটিতে বর্ধিত হয়েছে। লাদেন ধরাও পড়েছে পাকিস্তানে। এমন একটি মধ্যযুগীয় মোল্লা রাষ্ট্রকে বজ্রকন্ঠে সমর্থন দিয়েছে চীন। বলেছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঠূনকো সম্পর্ক নয়, হরিহরাত্মার সম্পর্ক।

১৯৭১ সালে চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো। তার না হয় একটা মার্কসবাদী ব্যাখ্যা থাকতে পারে; তাই বলে আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভূট্টো ও টিক্কা খানের মতো নরপশুদের সমর্থন! তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিলো নিরস্ত্র বাঙালি জনসাধারণকে হত্যা করার জন্য। তখনো বেঁচে ছিলেন চেয়ারম্যান মাওসেতুং এবং চৌ-এন লাই। জনপ্রিয় কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একটি বই লিখেছেন। নাম ‘বাংলাদেশঃ বামপন্থি রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা’। সেখানে দেখিয়েছেন তিনি, ১৯৭১ সালে চীন বাঙালিদের বিরুদ্ধে কী হৃদয় বিদারক ভূমিকা নিয়েছিলো। তিনি বলেছেন, “অন্য একটি গ্রুপ চীন থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের সাহায্য যোগানোর জন্য পাঠানো বিশেষ ধরনের গ্রাম্য অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের-বিশেষ করে মুক্তিফৌজের কিশোর তরুণ গেরিলাদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে তখনকার অধিকৃত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

এদের বর্বরতায় কমপক্ষে ৫ হাজার কিশোর ও তরুণ বাঙালি গেরিলা নিহত হয়েছে বলে তখন হিসাব করা হয়েছিলো।” ষাটের দশক থেকেই চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করতে থাকে। আইয়ুব খানের মতো নরদানব কে চীন কমরেড উপাধী দেয়া বাকি রেখেছিলো; আর সব সমর্থনই দিয়েছিলো। সাবেক কূটনীতিক ও বিশিষ্ট কলাম লেখক ফারুক চৌধুরী ‘দেশ দেশান্তর’ বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের মতো নিম্নমানের এক মদ্যপ প্রেসিডেন্টকে চীন কী সোল্লাসে সমর্থন দিয়েছিলো! পাকিস্তানের মতো একটি মোল্লা রাষ্ট্র মধ্যস্থতা করেছিলো চীন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সম্পর্কের সেতু নির্মাণের জন্য। ফারুক চৌধুরী বলেছেন, “দীর্ঘ কয়েক বছরের ব্যবধানে আজ যখন ১৯৭০ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পিকিং সফরের কথা ভাবি, তখন রোমের রাজা নিরোর বাঁশি বাঁজানোর কথা মনে পড়ে যায়। ...১৯৭০- এর পাকিস্তান ছিলো এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের মুখোমুখি। ডিসেম্বরে নির্বাচন।

......১২ নভেম্বর রাতে প্রলয়ঙ্করী ঝড় আর ঘুর্ণিবার্তা এলো পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে। হাজারো দেশবাসী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন। তার উচিত ছিলো ঝড়ের খবর পাওয়ামাত্র ঘরে ফেরা। তিনি ইচ্ছে করলে ১৩ নভেম্বর দুপুরেই ফিরতে পারতেন। আমাদের প্লেন তখন প্রস্তুত ছিলো। তা না করে পূর্বনির্ধারিত ১৪ নভেম্বর রাতে ইয়াহিয়া ফিরলেন পিকিং থেকে ঢাকা। সেই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতায় শুধু পূর্ব পাকিস্তান কেন, বিশ্ববাসী ছিলো স্তম্ভিত। সবাই তাই ভেবেছিলো ঢাকায় থেকে রাষ্ট্রপতি নিজেই ত্রাণকার্য তদারক করবেন। তা না করে পরদিনই তিনি চলে গেলেন ইসলামাবাদে। গিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে বার্তা পাঠালেন যে- সফল হয়েছে তার চীন সফর। জানালেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নততর করার মানসে চীন স্বাগত জানাবে ওয়াশিংটন থেকে একজন বিশেষ দূতকে। নিরোই বটে।” স্বয়ং চেয়ারম্যান মাওসেতুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই এই ‘নিরো’কে কী সমাদর করলেন, ২০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিলেন; এর সুন্দর বর্ণনা আছে ফারুক চৌধুরীর লেখায়। বিপুল অস্ত্রশস্ত্রও পেয়েছিলেন নিরো। সেই ডলার ও অস্ত্র ইয়াহিয়া বা নিরো ১৯৭১ সালে প্রয়োগ করেছিলেন বাঙালিদের ওপর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভেরও বিরোধিতা করেছিলো চীন।

ভেবেছিলাম, অর্ধ শতাব্দীর পরিক্রমায় গ্লোবাল রাজনীতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, হয়তো চীনেরও কট্টর অবস্তানের বদল ঘটেছে। পার্টি কমান্ডিং নীতি অক্ষ্ণু রাখলেও মুক্তবাজার অর্থনীতির জোর হাওয়া চীনেও প্রবেশ করেছে। বেচারি গর্বাচেভকে দোষ দিয়ে লাভ কী? খোলা মন, খোলা জানালা এখন চীনেও প্রভাব বিস্তার করেছে। মনের মধ্যে আশা জন্মেছিলো যে, চীন আগের মতো তার ভারতের প্রতি অন্ধ বিরোধিতা আর পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ সমর্থনের অবস্থানে নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যে সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান, তার প্রেক্ষিতেও মনে হয়েছিলো চীনের অন্ধত্ব ঘুচেছে। কিন্তু না, ভারত বিদ্বেষ থেকে আর পাকিস্তান প্রীতি থেকে চীন মোটেও সরে আসেনি। বরং হুংকার দিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তান আক্রান্ত হলে চীন বসে থাকবে না। অতি সম্প্রতি দুই মার্কিন পার্লামেন্টারিয়ান পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূতও একই কথা বলেছেন। পাকিস্তানের আচরণ বরাবর উস্কানিমূলক। পাকিস্তান ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে একইরকম উস্কানিমূলক আচরণ করে যাচ্ছে।

ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি পাঠিয়ে পাকিস্তান ভারতের পরিবেশকে রক্তাক্ত করে আসছে। মুম্বাই হোটেলে অতর্কিতে হামলা, পাঠানকোটে ৭ সেনা হত্যা তারপর উরিতে ১৮ জন সেনা হত্যা জঘন্য উস্কানির দৃষ্টান্ত। ভারতের ঘুম হারাম করার জন্য পাকিস্তান জম্মু কাশ্মিরে উস্কানি অব্যাহত রেখেছে। জাতি সংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশনের বক্তৃতায় পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানিকে ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়েছেন। এই উস্কানিমূলক ভাষণের বিরোধিতা করে টেক্সাসের সিনেটর টেডপো বলেছেন,‘এক জঙ্গিগোষ্ঠী, যারা নিজেদের দাবি পূরণের জন্য প্রতিহিংসার আশ্রয় নেয়, তাদের প্রশংসা করার জন্য পাক প্রধানমন্ত্রী জাতি সংঘের মঞ্চকে বেছে নিয়েছেন, এটা খুবই হতাশাজনক। অথচ বুরহান ওয়ানি নিজেই অস্ত্র সমেত ছবি ও ভিডিও এবং প্রতিহিংসামূলক বার্তা আপলোড করেছিলেন।

এছাড়াও মার্ক ওর্য়ানার ও জন করনিন নামে অন্য দুই মার্কিন সিনেটর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে বলেছেন, উরির হামলাকারীরা পাকিস্তানি এবং পাকিস্তানের মাটি থেকেই এ হামলা হয়েছে- এ খবর যথেষ্ট চিন্তার উদ্রেক করে। এ হামলায় পাকিস্তানের সম্ভাব্য যোগসাজশ এবং আফগানিস্তান ও ভারতের ক্ষেত্রে পাক বিদেশ নীতিতে যে ভাবে সন্ত্রাস গুরুত্ব পেয়েছে, তা ভীষণ উদ্বেগের বিষয়। লস্করই তৈয়বা, জৈইশ-ই-মহম্মাদের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী শুধু ভারতের জন্য নয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও ক্ষুণ্ন করছে।
এমন একটি জঙ্গি রাষ্ট্রকে পুনরায় জোর গলায় সমর্থন করলো চীন।