Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

মাইকেল মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

শফিকুজ্জামান

জানুয়ারি ২৪, ২০১৮, ০৮:২৭ পিএম


মাইকেল মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

“সতত, হে নদ তুমি/ পড় মোর মনে/ সতত তোমার কথা/ ভাবি এ বিরলে” দূর প্রবাসে বসে কবি শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ নিয়ে কবিতা লিখে কালজয়ী হয়েছেন। আজ ২৫ জানুয়ারি। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৪তম জন্মদিন। ১৮২৪ সালের এই দিনে তিনি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে কবির জন্মভিটা সাগরদাঁড়িতে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা-এর আয়োজনসহ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মহাকবি মধুসূদন দত্ত ইহলোক ত্যাগ করেন। ‘মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনন্য সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পুরাতন ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে নবজীবন দান করেছেন। তিনি আমাদের বিচিত্র কাব্য-সম্ভার উপহার দিয়েছেন।’ মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগী মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় মহাকাব্য রচনা এবং বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের পথিকৃৎ। বিশ্ব সাহিত্যের ভা-ারে প্রবেশ করে মণি-মুক্তা আহরণ করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। নাটক, প্রহসন, মহাকাব্য, পত্রকাব্য, সনেট, ট্রাজেডিসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অমর সৃষ্টি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে উন্নত মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে তার ভ্রম কাটে। মাইকেল নিজ মাতৃভাষায় প্রথমে নাট্যকার হিসেবেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তাঁর সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচরণের পূর্বে একটি ইতিহাস রয়েছে। বাংলা নাটকের ক্ষেত্রেও তা বাদ যায়নি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করতেœর ‘রতœাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এ জন্য তিনি নিজে নাটক লেখায় হাত দেন। রচনা করেন সাড়াজাগানো নাটক শর্মিষ্ঠা ও কৃষ্ণকুমারী। ১৮৬০ সালে সমাজে বহমান দুটি বিপরীতমুখী ধারা নিয়ে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামে দুটি প্রহসন রচনা করেন। প্রথমটিতে তিনি সদ্য ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এ দেশের হিন্দু সমাজের একাংশের অসামাজিক তৎপরতার ধারাবিবরণী লিখেছেন। আর দ্বিতীয় প্রহসনে ধর্মকে পুঁজি করে এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালানো সনাতনপন্থিদের নৈতিক অধঃপতনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন।
প্রহসন দুটি প্রকাশিত হওয়ার পর মধুসূদনের ওপর ওই দুই শ্রেণির প্রতিনিধিরা ক্ষিপ্ত হন। তাই কলকাতার বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনটি মঞ্চস্থ হওয়ার কথা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বাংলায় সাহিত্য রচনার বেশ আগে ১৮৪৩ সালে মধুসূদন পাশ্চাত্য প্রভাবে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তখন থেকে তাঁর নাম হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঘটনার পর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত মধুসূদনকে ‘ত্যাজ্যপুত্র’ ঘোষণা করেন। তবে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণার পরও মধুসূদনকে তাঁর বাবা চার বছর ধরে অর্থ জোগান দিয়েছেন। পরে তিনি টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলে চরম আর্থিক সংকটে পড়েন মধুসূদন। সেই নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই রচনা করেন ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ নামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে লেখা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মোহভঙ্গ হলে ১৮৫৬ সালে দেশে ফিরে মধুসূদন একাগ্রচিত্তে বাংলায় সাহিত্য রচনায় হাত দেন। ১৮৬১ সালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচনা করেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। যেখানে মূল রামায়ণে খলচরিত্র হিসেবে দেখানো রাবন ও তার পুত্র ইন্দ্রজিৎকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেন মধুসূদন। ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রামায়ণের ঠিক বিপরীতে ‘স্রোত বহমান’ করানো এ উদ্যোগ তৎকালীন ভারতবর্ষে সহজ কাজ ছিল না। তবে তিনি সেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে যান অন্যন্য উচ্চতায়। মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। বাবার মতো আইন ব্যবসায় তিনি সফল হননি। এ ছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের কারণে তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন ভারতের আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মারা যান। কলকাতার মল্লিকপুরে খ্রিস্টধর্মীয় মতে সমাহিত করা হয় তাকে। পরে সেখানে ভাস্কর্য নির্মাণ করে ভারত সরকার। কবির জন্মদিন স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি।