Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

ইন্টারনেটের অপব্যবহার : হুমকির মুখে শিশু-কিশোর

প্রিন্ট সংস্করণ॥রায়হান আহমেদ তপাদার

সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৮, ০৬:২১ পিএম


ইন্টারনেটের অপব্যবহার : হুমকির মুখে শিশু-কিশোর

অতিমাত্রা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। খেলাধুলা বিমুখ হয়ে ইন্টারনেটের দিকে বেশি মনোযোগী হচ্ছে তারা। ইটারনেট ব্যবহারে ভবিষ্যতে শারিরীক ও মানসিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার আশংকা করছেন শিশু ও কিশোর বিশেষজ্ঞরা।বিশেষজ্ঞরা জানান, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম অঞ্চলেও ছোঁয়া লেগেছে তথ্য প্রযুক্তির। গত কয়েক বছর আগেও মানুষ বিদেশে কথা বলার জন্য দোকানে গিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কিন্তু বর্তমানে শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত সকলের হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে। তার সাথে যুক্ত রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ। দেশের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ছে। মানুষ টাকা খরচ করে লিমিটেড ভাবেই ব্যবহার করতে হয় ইন্টারনেট। কিন্তু ব্রড ব্যান্ড সংযোগ চালু হওয়ায় এটি আরও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি শিশু প্রথমবারের মতো অনলাইন ব্যবহার করছে। প্রতি আধা সেকেন্ডে একটি শিশু অনলাইন দুনিয়ায় প্রবেশ করছে এবং এতে দেশের ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির শিকার হচ্ছে। একাধিকবার হয়রানির শিকার হচ্ছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। হয়রানির কারণে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে বলে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা (ইউনিসেফ) এর গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সারাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটা বড় অংশ ১৮ বছরের নিচে বা শিশু-কিশোর। তারা একদিকে যেমন ডিজিটাল জগতে প্রবেশের সুবিধা পাচ্ছে এবং শিশুদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরি করছে, ঠিক তেমনি ঝুঁকিও বাড়ছে।অন্ধকারে আলোকিত পৃথিবী দেখা এবং ঘুম ঘুম চোখে রঙিন দুনিয়ায় প্রবেশ ইত্যাদি তারুণ্যকে ক্রমেই ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট আসক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলেন যে, মাদকের পরিবর্তিত সংস্করণ হচ্ছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বা ইন্টারনেটে অকারণে অতিমাত্রায় আসক্তি। মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বলছেন যে, একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি যারা শেয়ার করেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুদের সমবেদনা জানিয়ে থাকেন, এ ব্যাপারে উভয়ই অতিমাত্রায় ফেসবুক বা যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি। বলা হচ্ছে, সপ্তাহে ৩৮ ঘণ্টার বা এর বেশি যারা সামাজিকমাধ্যমে ডুবে থাকেন তারা আসক্ত। মাদক ছাড়া যেমন অনেকে থাকতে পারেন না তেমনি ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া থাকতে পারেন না! নেট সমস্যা বা কিছু সময়ের জন্য এসব মাধ্যম বন্ধ থাকলে হতাশায় রিঅ্যাকশ্যান দিয়ে পোস্ট দেন তাদেরকে মোটাদাগে আসক্ত বলা যায়! যেসব ফেসবুক ব্যবহারকারী একাকীত্বে ভোগেন, তারাই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বেশি স্ট্যাটাস দেন। প্রেম বা অন্যক্ষেত্রে ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বা যারা অযথা ফেবুতে তর্কে লিপ্ত হন বা প্রশ্ন ছুড়ে উত্তর আশা করেন তারাও ফেবু অতিমাত্রায় আসক্ত। দেখা যায় খেলা বা অন্যকিছুকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত চরিত্র হননে লিপ্ত থাকেন, পারস্পারিক মতামতে অসহিষ্ণু বা অযথা ইস্যু তৈরি করে পার¯পারিক বা অন্যের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে (যেখানে নিজের লাভ লোকসান নেই) গালিগালাজ বা চরিত্রহরণের চেষ্টা করে থাকেন অনেকে। ফেসবুকে অতিমাত্রায় আসক্তি হলে ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ অবস্থা সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে অতিমাত্রায় হচ্ছে এবং ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। এ অবস্থা কিন্তু উন্নত বিশ্বে (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কান্ট্রিতে) বেশি নেই। কুরুচিপূর্ণ এ অবস্থা বাংলাদেশ এবং ভারতে বেশি। এটা ইন্টারনেটের অপব্যবহার বলা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে আমরা পারস্পরিক একটা অসহিষ্ণু স্টুডেন্ট কমিউনিটি তৈরি করছি। একটা সময় ছিল যখন শিশু-কিশোরদের দেখা যেত মাঠে খেলা করতে। বিকেল, সকাল ও দুপুর। যখন খেলতে যেত কিশোররা, তাদের কলকাকলীতে মাঠগুলোকে ফুরফুরে সতেজ মনে হতো। ফুটবল, কাবাডি, কানামছি, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার একটা স্বাভাবিক এবং বাধ্য দৃশ্য যেন ছিল এই বাংলার। কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রকৃতিতে গ্রহণ লাগে। কেন যেন কুনজর লেগে বসে আমাদের কিশোরদের খেলাতে। আমরা হারাই কিশোরদের সেই মাঠ থেকে। মাঠও হারায় কিশোরদের। একটা হাহাকার যেন! কিশোরদের কচি পা-এর অভাবে সেই মাঠগুলোয় ইটের ভবন গড়ে ওঠে। কিশোররা আটকে যায় সেই ইটের বন্দি ঘরে। ওদের ভেতর গুমরে ওঠা কান্নাগুলো এক এক করে যখন বড্ড একাকিত্ব দানাবাঁধে, ছোট্ট কচিপ্রাণে তখন আসে এক মামদো ভূত কম্পিউটার। ওদের সব মনোযোগ, খেলাধুলার ইচ্ছাকে আঁকড়ে নেয় এই যন্ত্রের ভুবনে। ধীরে ধীরে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব নামক যন্ত্রগুলা ওদের বেশি আলোড়িত করে ফেলে। শিশু-কিশোররা বেশি অনুকরণপ্রিয় হয়, ওরা চায় নিজেদের প্রকাশ করতে, নতুন নতুন চাওয়া জিজ্ঞাসা ওদের মননজুড়ে। ওরা নিত্য জানার খোঁজে সর্বত্র চষে বেড়ায়। নয়া সব মোবাইলের কেরামতি স্মার্টফোন, আইফোন ওদের আগ্রহকে দ্বিগুণ করে নেয়। একটা সময়ে ফাইনালি বড়দের ব্যবহৃত জিনিসগুলো চলে আসে শিশু-কিশোরদের হাতে। শিশু-কিশোর নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ইন্টারনেট সময়ের সেরা অ্যাপসগুলোয়। অনলাইন, অপলাইনে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো স্কুলপড়-য়া ছেলেমেয়ে এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা জানে না নেট, গুগল, সফটওয়্যার সম্পর্কিত বিষয়গুলো। শহরের, গ্রামের কিশোর বয়সীরা মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি বিষয়ে জানা এক-একটা সময়ের যেন তারকা এক্সপার্ট। আশ্চর্য হলেও সত্য, ড্রইং, কবিতা, আবৃত্তি, গান, নাচ, অভিনয় শিখতে কোনো প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। কিন্তু কম্পিউটারের অফিস প্রোগ্রামটি একবার কিশোরদের হাতে পড়লেই বাকিগুলো আর শিখতে বেগ পেতে হয় না, শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না। বরং অনেকেই এগুলো এমনিতে দূর থেকে দেখেও শিখে নিতে পারে। আমার জানা মতে, কয়েকজন শিশু-কিশোরকে দেখেছি বাবা-ভাই, মামা, চাচাদের হাতে মোবাইল একটু পাশ থেকে টেপাটেপি দেখে সে বুঝতে পারে কী করছে। মোবাইল পাসওয়ার্ডটি কীভাবে দিয়েছে; দূর থেকে দেখে বুঝে যায়। বুঝে কীভাবে বিভিন্ন অপশনে ঢোকা যায়। একবার কোনোভাবে লুকিয়ে হোক বা কান্নাকাটি করে হোক সে মোবাইল ফোনটি হস্তগত করতে পারলে আর যায় কোথায়। এক বছর পার হলেই একটা শিশু এখন মোবাইল কী জিনিস বুঝতে পারে। তিন থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চা ডাউনলোড করে খেলা করে সারাক্ষণ মোবাইলে। বড়রা অবাক হতো একসময়। অবশ্য এখন অবাকটা আর কারো মধ্যে নেই। এটা স্বাভাবিক এখন সবার কাছে। যতই বড় হয় সময়ের স্রোতে তাদের এসবের প্রতি আগ্রহের মাত্রাও বাড়তে থাকে।কিশোররা আজ যে স্মার্টফোনে বেশি আসক্ত, সে আসক্ততা ওদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে কেড়ে নিয়েছে। করে ফেলেছে ওদের পঙ্গু। এটা এক ধরনের চোখ দিয়ে ডিজিটাল মাদক গ্রহণের মতো। ইন্টারনেট চোখের জন্যই এক ক্ষতিকারক রোগ। অনেক ছেলেমেয়ে এখন চোখের সমস্যায় ভোগে। স্কুলপড়-য়া প্রায় সবার চোখেই চশমা। মাদকের মতো এ এক নেশা যেন, যা প্রতিদিনের ঘুম ছাড়া প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টাই থাকে ওরা ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইডে, মোবাইল হাতে। পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা খেলনা দিয়ে ওরা ওদের জন্য নির্ধারিত খেলা খেলতে চায় না। ওসব কবেই ভুলে গেছে! লুডু পর্যন্ত এখন মোবাইলে খেলা যাচ্ছে। কার্টুনের সঙ্গে কথা বলছে, গেম খেলছে। কমিউনিটি গ্রুপ করে চ্যাট করাও শিখছে বিদেশি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। মশগুল ফেসবুক ও টুইটারে। একদমই পড়ালেখা করতে চায় না তারা। গল্পের বই পড়তে চায় না। ঘরে, ঘরে একটা যুদ্ধ, অশান্তি। কিশোর আচার-আচরণে চলে এসেছে বিধ্বংসিতা। পাড়ার ছেলেদের হাতে, ক্লাসে সহপাঠীর কাছে দামি মোবাইল দেখেছে, তারও একটা দামি মোবাইল চাই। মোবাইল পর্বটি কিনে চাওয়ার সাধ পূরণের আখের ঘুচিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত কিশোর ছেলেটির বাবা যখন একটু নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তখন শুরু হয় নতুন আরেক যন্ত্রণা। কিশোর ছেলেটির বাবারা ছোটে দ্বারে দ্বারে সন্তানকে বাঁচাতে। সন্তানকে কোনো একদিন পাড়ার এলাকার কিছু বখাটে ধরে নিয়ে গেছে বিভিন্ন মিথ্যা কথায় ফেলে। কোনো দিন হয়তো তাদের কথা শোনেনি, তাদের টাকা দেয়নি, তার হাত থেকে মোবাইল ফোনটি তাই কেড়ে নেয়। অনেক কষ্ট করে বাবারা সন্তানকে বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা করে।আবার দেখা যায় অসৎ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে কিশোর ছেলেরা মাদকে নিমজ্জিত। স্কুলের ছাত্র মাদকের নেশায় কাটে তার দিন। মা-বাবা বুঝতে পারেন সন্তানের ভেতর পরিবর্তন। চলাফেরা, আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তনের লক্ষণ! রাত জাগা, মিথ্যা বলা, স্কুল-কলেজ না যাওয়া, প্রাইভেটের নামে অন্যত্র যাওয়া, টাকা চাওয়া বিভিন্ন অজুহাতে।
শিশু-কিশোরদের ফেসবুকের আসক্তি কমাতে অভিভাবকেরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সন্তানকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। সন্তান কখন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে চলছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান। শিশুকে গুণগত সময় দিন। মা-বাবা নিজেরাও যতি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে সবার আগে নিজের আসক্তি দূর করুন। ফেসবুকের আসক্তি কমাতে স্কুলে স্কুলে সচেতনতা মূলক প্রচার শুরু করলে এখনকার তরুণ প্রজন্মকে ওই কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করা যাবে। স্কুলগুলোতে কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। কর্মশালায় ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার কুফল নিয়ে আলোচনা, পাঠচক্র করা যেতে পারে। ইন্টারনেটের কুফল থেকে সন্তানদের বাঁচাতে বিকল্প হিসেবে খেলাধুলা বা পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদিন বিকেলে পড়া শেষে তাকে খেলাধুলার সময় দিতে হবে। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক গড়ে তুলুন। সব কিছু খোলামেলা আলোচনা করুন। তাহলে অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে। শিশুদের জন্মদিন কিংবা বিশেষ দিনে শিশুদের বই উপহার দিন। তাকে আস্তে আস্তে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বই পড়লে এক তো জ্ঞান বাড়বে অন্যদিকে ফেসবুকের আসক্তি কমবে। সম্ভব হলে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন মোবাইল। শিশুদের হাতে মোবাইল না দেওয়া গেলেই ভালো। ১৮ বছরের নিচের সন্তানের ইন্টারনেটের যাবতীয় পাসওয়ার্ড জানুন। তবে লুকিয়ে নয়, তাকে জানিয়েই তার নিরাপত্তার জন্য পাসওয়ার্ডটি আপনার জানা দরকার; এটি বুঝিয়ে বলুন। বাসার ডেস্কটপ কম্পিউটারটি প্রকাশ্য স্থানে (কমন এরিয়া) রাখুন। শিশু যাতে আপনার সামনে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করে, সেদিকে গুরুত্ব দিন।

- লেখক ও কলামিস্ট