Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা অপরিহার্য

প্রিন্ট সংস্করণ

অক্টোবর ২৭, ২০১৮, ০৫:৫৭ এএম


শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা অপরিহার্য

মিসেস স্বাতী রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিদ্যায় মাস্টার্স সম্পন্ন করে পুরোপুরি সংসারী হয়েছেন। লেখাপড়া শেষ করার পর বেশ কয়েকটি চাকরির অফারও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। স্বামী ডা. এসএম কবির স্ত্রীকে চাকরি করার কথা বললেও চাকরি করতে রাজী হননি তিনি। তিনি মনে করেন, স্বামীর আয়-রোজগারে সংসারে যেহেতু কোন অভাব নেই, তাহলে কেন তার আর চাকরি করা! তিনি তার আগামী প্রজন্মের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে চাইলেন। মিসেস রহমান তার সবটুকু সময় তিনি তার সন্তানের পিছনে ব্যয় করতে চাকরি নিতে চাইলেন না। তিনি নেপোলিয়ান বোনাপার্টের বিখ্যাত উক্তিকেই ধ্রুব সত্য বলে গ্রহণ করেছেন। বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।’ মিসেস রহমানের তিনটি মেয়ে। মায়ের একনিষ্ঠ পরিশ্রমে বড় মেয়ে মেডিকেল সাইন্সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। দ্বিতীয় মেয়ে বছরখানেক আগে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে রাজধানীর নামকরা একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। তৃতীয় মেয়েটিও অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। সে আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। মিসেস রহমান তার সন্তানদের আপত সাফল্যে খুবই খুশী। তিনি মনে করেন, তার সন্তানরা একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। তিনি মনে করেন, সুন্দর একটি দেশ ও জাতির জন্য মায়েদের অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে। একজন শিক্ষিত মা তার সন্তানদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারেন, এটা তিনি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মিসেস রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি একটু আলাদা। তবে তার এ দৃষ্টিভঙ্গি কোন ক্রমেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। সংসারের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকায় তাকে হয়তো চাকরি করতে হচ্ছে না। তবে যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নন, তারা ঘরে ও বাইরে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। নারী শিক্ষা ও নারী অগ্রগতির পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান মহিলা যিনি নারী স্বাধীনতা ও নারী শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি নারী শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষিত নারীরাই সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। বেগম রোকেয়ার মতো কবি বেগম সুফিয়া কামাল ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ অনেকেই নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন ও করছেন। এ জন্যে নারীরা এখন আর অবরোধবাসিনী নয়। বাংলাদেশের নারীরা ঘর ও বাইর দুটোই জয় করেছেন। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় মেয়ে সন্তানদের এখন আর খাটো করে দেখা হয় না। বিশেষ করে শহরের শিক্ষিত বাবা-মা তাদের সন্তানদের সমান দৃষ্টিতে দেখেন। তারা এখন আর মেয়ে সন্তানদের ভিন্ন চোখে দেখেন না। কারণ তারা জানেন, মেয়েরা এখন পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই শিক্ষার ভূমিকা অনেক বেশী। বিশেষ করে নারী শিক্ষার ফলে তারা বুঝতে পেরেছেন, তাদের মেয়ে সন্তানরা শিক্ষিত হলে তারা পুরুষের মতো সমান অধিকার নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।’ নারী-পুরুষ ভেদাভেদ না রেখে অনুচ্ছেদ ১৭-তে সকলের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার গ্রহণে সুযোগের কথা বলা হয়েছে। সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সরকার মহিলাদের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে। সরকারের এই সদিচ্ছার ফলে বাংলাদেশের নারীরা এখন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় সংসদে নারীরা এখন জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হচ্ছেন। রাজনীতি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত এমন কি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও নারীরা আজ পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে নারী শিক্ষার কারণে। তবে শহরের তুলনায় গ্রামে নারী শিক্ষার অগ্রগতি অনেক কম। এর মূল কারণ দারিদ্র। গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হবার পর শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ার হার শহরের তুলনায় অনেক বেশী। এই হার কন্যা শিশুর হার পুত্র শিশুর তুলনায় বেশী। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন থেকে ছিটকেপড়া কন্যা শিশুদের অবহেলা ও সামাজিক জীবনে নির্মমতার শিকার হতে হয়। অপরিণত বয়সে এদেরকে জোর করে বিয়ে দিয়ে বাবা-মা ‘আপদ’ বিদায় হয়েছে বলে মনে করেন। বাল্যবিবাহের পর অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত এসব কন্যা শিশু সংসারে শ্বশুর-শাশুড়ী ও স্বামীর সেবা করতে হয়। শিশুদের অশিক্ষিতের মায়েদের কারণে মা হয়ে এরাও তাদের শিশুদের নিজের পথে চলতে বাধ্য করে। নারীর ক্ষমতায়ন ও সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হলে নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সরকার এ লক্ষ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করলেও এর বড় অন্তরায় আর্থ-সামাজিক অবস্থা। আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ গ্রামের বাস করে। শহরের তুলনায় তাদের অধিকাংশের বাস দারিদ্র্যসীমার নীচে। দরিদ্র পরিবারের পিতা-মাতা মনে করেন লেখাপড়ার করার পরিবর্তে তাদের সন্তানরা আয়-রোজদার করলে তারা দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবেন। তাদের এ মানসিকতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলগামী শিশুদের অভিভাবকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে বেসরকারি সংগঠন ও গণমাধ্যমেরও এগিয়ে আসতে হবে। কন্যা শিশুরাও যে শিক্ষিত হয়ে পুরুষের সমান হতে পারে এ ধরনের প্রচারণা চালাতে হবে। সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে পারলে বাংলাদেশের নারী শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে সন্দেহ নেই। তাহলেই আমরা একটি শিক্ষিত জাতি আশা করতে পারি। (পিআইডি প্রবন্ধ)