Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান

মো.ওসমান গনি

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮, ০৭:৫০ পিএম


মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান

বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা যেভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সত্যিই তা প্রশংসার দাবিদার।আমাদের দেশের নারীরা দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যে সাহসী ভূমিকা রেখে ছিল তা জাতি আজও স্মরন করে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ছিল বীরত্বপূর্ণ অবদান।

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও সক্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। নানা কৌশল ও গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে খাবারের ব্যবস্থা, গোপন তথ্য আদান প্রদানে নারীরা ছিল এগিয়ে। নানা নির্যাতন, যন্ত্রণা সহ্য করেও তারা পিছ পা হননি। গুলিবিদ্ধ হয়েও বহু নারী মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়েছেন।

তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আঘাত আনা হয়েছিল। এই সহায়তা করতে গিয়ে অনেকেই নির্যাতিত হয়ে শহীদ হয়েছে। কেউ কেউ বীরাঙ্গনা হয়ে এখনো বেঁচে আছেন। আবার কেউ কেউ গুলি ও বোমার আঘাতে অঙ্গ হারিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার এসব নারী মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। সরকার ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাব দিয়েছেন।

তার মধ্যে ২ জন নারী বীর প্রতীকও রয়েছেন। তারা হলেন, মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি ও ক্যাপ্টেন সিতারা।যুদ্ধকালীন নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যুদ্ধকালে সাধারণভাবে দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের কৌশল হিসেবে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ করা হয়ে থাকে। এটি আঘাত হানে নারীর সম্মানের উপর।

মুক্তিযুদ্ধে টানা ৯ মাস সারাদেশে ২ লাখ নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর, রাজাকারের হাতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বাঙালি মেয়েদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঘরের বাইরে গিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও আন্দোলন সংগ্রামে অংশ দীর্ঘদিন আগের। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল। মহান ভাষা আন্দোলনে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় সভায় যোগদান করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করে ছাত্রীরা বেরিয়ে আসেন।

ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের অনেক ছাত্রী রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগান দিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের নানা ভাবে ভূমিকা রাখতে গিয়ে পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেই থেকে শুরু করে বাংলার স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা স্মরণীয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নারীরা নানা কৌশল নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বন্দুক চালানো, গ্রেনেড নিক্ষেপ, ব্যারিকেড তৈরি, আত্মরক্ষাতে মরিচের গুঁড়া শত্রুর গায়ে নিক্ষেপ ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দেয়া হতো নারীদের। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাহাড় ঘেরা নির্জন জায়গায় ও কোন বাড়িতে এসব প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ নারীরা এসব প্রশিক্ষণ দিতেন।

এর মধ্যে ১৯৭১ সালে মার্চে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে ছিল তাতে ছেলেদের পাশাপাশি তরুণী, সচেতন ছাত্রীদের অংশ গ্রহণও ছিল উল্লেখযোগ্য। কাঠের বন্দুক হাতে নিয়ে বহু ছাত্রী অস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিয়ে প্রথম সশস্ত্র ব্রিগেড তৈরি করেন একজন নারী কমান্ডার। সেখানে ছাত্রীদের রাইফেল চালানো, শরীর চর্চা, ব্যারিকেড তৈরি ও প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষা দেয়া হয়। ঢাকার কলাবাগান, রাজারবাগ, ধানমন্ডি, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বিভিন্ন স্থানে প্রথমে নারী ব্রিগেড তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

ওই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেত্রী সশস্ত্র ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছেন।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ভারতে গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করেন। কলকাতায় একমাত্র মহিলা মুক্তিযুদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়।

ওই ট্রেনিং ক্যাম্পটি গোবরা ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী ওই ক্যাম্পটি পরিচালনা করতেন। ওই ক্যাম্পে মোট ৪০০ নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ওই ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের আগে নারীদের সাহসিকতা, রাজনৈতিক চেতনা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হতো। তারপর তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হতো। ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার তাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতেন।

সেখানে ১৬ জন করে তিনটি গ্রুপে ৪৮ জন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা গেরিলা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সময়ের রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ শাখার নেত্রী ফোরকান বেগমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ছাত্রীরা ছিলেন। তারা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় যান। সেখানে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের ক্যাম্পে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের কাছে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন।

সেখানে মহিলা গেরিলা স্কোয়াডের নেতৃত্বে ছিলেন ফোরকান বেগম।শুধু যুদ্ধই নয়, নারীরা নাটক, সঙ্গীত, মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ প্রেরণাকারী বিভিন্ন ধরনের নাটক ও সঙ্গীত পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দিয়েছেন। আবার কেউ রণাঙ্গনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেছে।স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জাতি যখন গভীর সংকটের মোকাবেলা করেন, নারীরা তখন দুর্ভোগের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী সমাজেরও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর যন্ত্রণা সইতে হয়েছে।

এই সংকট আর দুর্ভোগ কেটে দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দালালদের বিচারের দাবিতে নারীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশে দালাল আইন প্রণীত হয়েছিল। তখন অনেক দালালের বিচার শুরু হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আইনটি বাতিল করার মাধ্যমে অকার্যকর হয়ে যায়।

এরপর বর্তমান আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে নারী মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সম্মান ও খেতাব দেয়াসহ তাদের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ২০টির বেশি সম্মুখযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরজাহান বেগম ওরফে কাঁকন বিবি। তিনি খাসিয়া মুক্তি বেটি নামেও পরিচিত। তিনি ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র যোগান দেয়া থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আরেক বীর মহিলা যোদ্ধা তারামন বিবি। তার জন্ম কুড়িগ্রামে। মহান স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য তাকে বীর প্রতীক খেতাব দেন। তিনি একাধিকবার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শত্রুদের পরাস্ত করেন। অনেকবার তাদের ক্যাম্প পাক বাহিনী আক্রমণ করলেও তিনি কৌশলে বেঁচে যান।মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশব্যাপী যে গণজোয়ার শুরু হয়েছিল সেই গণজোয়ারে নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না।

শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নারীরা স্বাধীনতার পক্ষে জেগে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাড়া মহল্লায় গ্রাম গঞ্জ, শহর বন্দর থেকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় মা-বোনেরা টাকা পয়সা সোনা দানা দিয়ে সহায়তা করেছিল। বিভিন্ন স্থানে গেরিলাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা হাজির হলে নারীরা তাদের খাওয়া দাওয়া দেয়া ও বিশ্রামসহ আহতদের সেবা দিয়ে সাহায্য করত।

এভাবে নারীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বহু নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের কাছে নানা ভাবে নির্যাতিত হয়েছে। শুধু তাই না নারীরা ঝুঁকির মধ্যেও নিজের সন্তানকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধাদের কখনো অস্ত্র নিজের কাছে লুকিয়ে রাখেন,আবার কখনো মুক্তিযুদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিল।

বৃদ্ধ মহিলারা ভিক্ষুক সেজে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। আর ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসার দলে সেবিকার কাজ করতেন। অনেক নারী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা, অস্ত্র চালানো ও গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিল। আবার কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্নার দায়িত্ব পালন করছেন।

আরও পড়ুন:  
পুরুষ নির্যাতন রীতিমত এক ভয়ানক বাস্তবতা