প্রিন্ট সংস্করণ॥ মো. ওসমান গনি
জানুয়ারি ২৩, ২০১৯, ১১:০৫ পিএম
সংবাদপত্রকে বলা হয় একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সেই সংবাদপত্র রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে? সংবাদপত্র একটি দেশের তৃণমূল হতে শুরু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের প্রতিটি মানুষ প্রতিনিয়তই জানতে চায় দেশের কোথায় কি হয়েছে। হোক সে শিক্ষিত বা মূর্খ। দেশের খবর জানার অধিকার রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি মানুষের রয়েছে। আর খবর জানার আগ্রহ মানুষের অন্যতম আদিম প্রবৃত্তি। হোক ভাল বা মন্দ খবর। জানতে কারও কোন বাধা নেই। দেশের মধ্যে এমন এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা দেশ-বিদেশের খবর না জানলে বা না শুনলে তাদের ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া হয় না। এমন কি তারা খবর জানার আগ্রহে তারা ঘুম-নিদ্রা পর্যন্ত তাদের ঠিকমতো হয় না। রাষ্ট্রের বা সমাজের চলমান সাধারণ যে কাজগুলো চলে তা জানার জন্য মানুষের এত বেশি আগ্রহ থাকে না। কিন্তু চলমান কাজের মধ্যে যখন কোন ঘটনা ঘটে যায় তখন তা জানার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি নাগরিক অস্থির হয়ে পড়ে। হোক তা সুখবর বা দু:খের খবর। সেই সুখ ও দু:খের খবর জানার মাধ্যম হলো সংবাদপত্র। যদিও বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলো তাৎক্ষণিক ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সাথে সাথে প্রচার করে থাকে। তার পরও মানুষের বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহ থাকে। আর সেই ঘটনার পুরোকাহিনী তিলে তিলে তুলে ধরে সংবাদপত্র। যা পাঠ করে রাষ্ট্র ও সমাজের লোকজন পুরোপুরি ঘটনা জানতে পারে। ঘটনা জানার পরই রাষ্ট্র বা সমাজ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে থাকে। এজন্যই রাষ্ট্র বা সমাজজীবনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব দিন দিন বাড়বে কিন্তু কমবে না। সেটা হতে পারে প্রিন্ট মিডিয়া (ছাপা কাগজ) বা অনলাইন সংবাদমাধ্যম। আধুনিক সংবাদপত্র ঘটিত বা সংঘটিত বিষয়ের বিবরণই শুধু পরিবেশন করে না, তার ভূমিকা বিশাল ও বিচিত্র। জীবন ও জগতের সবকিছুই তার উপজীব্য। আধুনিক জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু সংবাদপত্র। জীবনের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো গুরুতর বিষয়ের দার্শনিক ভিত্তি যদি শক্ত না হয় তাহলে তা দিয়ে মানুষের কল্যাণ হয় না। সংবাদপত্রের দর্শন রয়েছে এবং রয়েছে সাংবাদিকতার নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। পৃথিবীতে অনেক আগে যখন বিদ্যুৎ ছিল না। তখন বিদ্যুৎ কী জিনিস, তা মানুষ জানত না। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই বলে সে সময়ে রাষ্ট্র বা সমাজ জীবনের কোন কাজ থেমে থাকেনি। কিন্তু এখন যদি বিশ্বব্যাপী কোনো একটি দিন বিদ্যুৎ বন্ধ থাকে, তাহলে মানুষের যে ক্ষতি হবে, তা বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগের ১০০ বছরেও হয়নি। ছাপা সংবাদপত্রের বয়স চার শ বছর। তার আগে সংবাদপত্র ছিল না। তখনো পৃথিবী যথানিয়মে চলেছে। কিন্তু আজ যদি সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম মাত্র একটি দিন বন্ধ থাকে, তাহলে মানবসমাজের কী অবস্থা হবে, তা কল্পনা করাও অসম্ভব। সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি বড় অংশ বিদ্যমান অবস্থা মেনে নিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজের প্রগতিকামী অংশ অর্থাৎ অগ্রসর অংশ বিদ্যমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। আর্থসামাজিক অবস্থা যেমনটি আছে তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। সেই বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সংবাদপত্রের ভূমিকা বিরাট। শুধু সংবাদ পরিবেশন সংবাদপত্রের এখন আংশিক কাজ। তার বাইরেই তার কাজের বিস্তৃতি বেশি। নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণই বেশি। সমাজের কায়েমি স্বার্থকে আঘাত করা সংবাদপত্রের এখন একটি বড় দায়িত্ব। কায়েমি স্বার্থ সংঘবদ্ধ, কিন্তু সংবাদপত্র ও সাংবাদিককে লড়তে হয় একা। তাঁর নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গী না থাকলেও তাঁর সমর্থক অগণিত। সেটাই সংবাদপত্রের শক্তি। যে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের নৈতিক অবস্থান বা দার্শনিক ভিত্তি শক্ত, জনকল্যাণে সেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক সময়ে সংবাদপত্রকে লড়তে হয়েছে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য বা রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। সামন্তবাদী সমাজে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সমাজে তাহলে কি সংবাদপত্রের কাজ কমে গেছে? তা নয়; বরং বেড়েছে। একটি রাষ্ট্র বা সমাজ গঠনে সংবাদপত্রকে এখন বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করতে হয়। রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তির মানবিক অধিকার এখন কিছুমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একদিকে সর্বশক্তির অধিকারী রাষ্ট্র, আরেক দিকে একজন সহায়সম্বলহীন দুর্বল মানুষ। সেই দুর্বলের অধিকার যখন রাষ্ট্র হরণ করে, তাঁর পাশে দাঁড়ায় সংবাদপত্র। সংবাদপত্রকে লড়াই করতে হয় সবচেয়ে শক্তিধরের সঙ্গে। সাংবাদিকের কী সেই অস্ত্র আছে, যার দ্বারা তিনি প্রবল পরাক্রান্ত শক্তিকে মোকাবিলা করেন? তা তাঁর নৈতিক অবস্থান। যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীন সংবাদপত্র রয়েছে, সেখানে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায় কম। যেখানে গণতন্ত্র নেই এবং স্বাধীন সংবাদপত্র নেই, সেখানে অনাহারে মানুষের মৃত্যুর হার বেশি। তার কারন হলো দেশের কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সংবাদপত্র সে খবর ফলাও করে সংবাদ লিখে থাকে। সে সংবাদ রাষ্ট্র পরিচালকের দৃষ্টিগোচর হলে সেখানে ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা করে দেন। তখন সেখানে আর দুর্ভিক্ষ থাকে না। আর যদি স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকে তাহলে দুর্ভিক্ষের খবর রাষ্ট্র জানতে পারবে না। ফলে সেখানে মানুষের সমস্যার সমাধানও হবে না। যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই, স্বাধীন সংবাদপত্র নেই অথবা থাকলেও তা সরকারেরই মুখপত্র, জনগণের মুখপত্র নয়, সেসব দেশের মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মিয়ানমার এবং তার দেশের নাগরিক রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে যখন রামুর বৌদ্ধপল্লিতে আক্রমণ হলো, ভস্মীভূত করা হলো তাদের ঘরবাড়ি, বিহার, তখনকার সেখানকার বাস্তব অবস্থা সংবাদপত্র বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিবেশন করে। তার ফলে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সেখানে দুর্গত মানুষের পাশে ছুটে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যান। তিনি গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাড়িঘর সেনাবাহিনীকে দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে নির্মাণ করিয়ে দেন। কয়েক মাস পরে বোঝা যায়নি যে সেখানে কোনো ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। সে জন্য সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল খুব বড়। সব সমাজেই বিবেকসম্পন্ন নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন মানুষ রয়েছেন। মিয়ানমারের বার্মিজদের মধ্যেও নিশ্চয়ই আছেন। সামরিক স্বৈরাচার ও সু চির অপকর্ম তাঁরা সমর্থন করবেন না। মিয়ানমারে সে রকম কোনো সংবাদপত্র থাকলে, তাতে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর সরকারি পাশবিকতার ঘটনা যদি প্রকাশিত হতো তাহলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি ঘটত না। মিয়ানমারে সামান্য কিছু সংবাদপত্র যা আছে তার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। সেগুলো সরকারের মিথ্যাচার প্রচারের যন্ত্রমাত্র। সেগুলো সংবাদপত্র পদবাচ্য নয়। সাংবাদিকের নৈতিক আদর্শ না থাকলে এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে শঠতা ও প্রবঞ্চনার প্রবণতা থাকলে সাংবাদিকতার নামে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে অপতৎপরতা হতে পারে। সংবাদপত্রকে থাকতে হয় সত্যের পক্ষে, সেটাই তার দার্শনিক ভিত্তি। সংবাদপত্র এককভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রকে বদলাতে পারে না। তা যদি পারত তাহলে সরকার ও সংস্কারকদের প্রয়োজন হতো না। যার যা কাজ, সে তা-ই করবে। সরকারের কাজ সরকার করবে। সমাজের অগ্রগতির লক্ষ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান যাঁরা, তাঁরা তাঁদের কাজ করবেন। তাঁদের সহযোগী শক্তি হিসেবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে কাজ করে সংবাদপত্র। বাংলাদেশে এখন অনেকগুলো উন্নতমানের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যেগুলো রাষ্ট্র বা সমাজের অসহায় মানুষের কল্যাণের জন্য বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকতার কারণে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চালু হওয়ার কারণে সংবাদপত্রের সামনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। কোনো কারণে মূলধারার সংবাদপত্র কোনো সংবাদ আড়াল করতে চাইলেও এখন আর তা সম্ভব নয়। পত্রিকার এখন প্রধান কাজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে অবিচল থাকা। মানুষের চেতনার মান উন্নত ও শাণিত করাও সংবাদপত্রের অন্যতম দায়িত্ব।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।