Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগার ভাবনা

ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২১, ০৬:৪৫ এএম


বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগার ভাবনা

৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস-২০২১’। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, ঘরে ঘরে গ্রন্থাগার’। এ বছর জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের প্রেক্ষাপট বিগত বছরগুলো থেকে আলাদা। এর দুটো কারণ রয়েছে। 

প্রথমটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও দ্বিতীয়টি বৈশ্বিক করোনাভাইরাস। একদিকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী নানান আয়োজন। এ উদ্যোগকে আরো ত্বরান্বিত করেছে ইউনেস্কো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনে ইউনেস্কোর আনুষ্ঠানিক এ উদ্যোগ বিশ্বময় সবাইকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে। 

অন্যদিকে করোনাভাইরাস অতিমারীর কারণে সরকার জনসমাগম এড়াতে অনেকটা কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নিষিদ্ধ করেছে সব রকমের জনসমাবেশ। স্বল্প পরিসর করা হয়েছে মুজিববর্ষ উদযাপন। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলাকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের বলিষ্ঠ উদ্যোগের কারণে করোনা মোকাবেলায় উন্নত বিশ্ব ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশ আজ এক রোল মডেল।

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তার একক নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বভাবতই দেশের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে তার চিন্তা ছিল সুগভীর। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় যতগুলো বিষয় অগ্রাধিকার পেয়েছে এর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। 

তিনি জানতেন সঠিকভাবে রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে জাতি-মানস গঠন। আর জাতি-মানস গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষা। তিনি মানতেন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃদপি- হচ্ছে গ্রন্থাগার। তাই তার কাছে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগার ভাবনা মূলতঃ তার শিক্ষা ভাবনার মধ্যেই অন্তর্নিহিত।

গ্রন্থাগার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃদপি-স্বরূপ। এ কথার তাৎপর্য অনুধাবন করতেন বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীপরিষদের সদস্য থাকাকালীন ৫ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম ঢাকায় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন গভর্নর। বঙ্গবন্ধু সেই কেবিনেটের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনে জোরালো ভূমিকা রাখেন। যা আজ ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে। 

২০১৮ সালে এই দিনটি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে গ্রন্থাগার-বান্ধব বঙ্গবন্ধুর ন্যায় তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের আত্মমর্যাদা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলেন। নিজেকে প্রমাণ করলেন গ্রন্থাগার-বান্ধব একজন জ্ঞানপিপাসু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

১৯৭০ সালের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “…সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতের পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। …কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বিশেষত স্কুল শিক্ষকদের বেতন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে। …দ্রুত মেডিকেল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয়সহ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।…”।

জাতির পিতার এ বক্তব্য ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের জনক রঙ্গনাথনের পঞ্চনীতির ঠিক পঞ্চমটির সাথে পুরোপুরি সামঞ্জ্যপূর্ণ। রঙ্গনাথন বলেছেন, ‘গ্রন্থাগার একটি ক্রম-বর্ধিষ্ণু উপাঙ্গ’। অর্থাৎ, এটি মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের ন্যায় ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। 

নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে ঠিক রঙ্গনাথনের সেই কথারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকদের বেতন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার কথা বলেছেন।

 তার একথা শিক্ষক মর্যাদার একজন স্কুল ও কলেজ গ্রন্থাগারিকের ক্ষেত্রেও সমান প্রণিধানযোগ্য। যেহেতু পদ-মর্যাদা, বেতনের দিক থেকে তারা এক ও অভিন্ন। যদিও এখনও অনেক স্কুল-কলেজে বিষয়টি নিয়ে ভূল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারিকগণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এটি কাম্য নয়।

১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন গঠিত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা পুরোটাই প্রতিফলিত হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগার ভাবনা কেমন ছিল? নিম্নে তা বর্ণনা করা হলো:

প্রাথমিক স্কুলের গ্রন্থাগার
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনায় গ্রন্থাগার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বঙ্গবন্ধু গঠিত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “….দেশের প্রত্যেকটি থানা সদরে একটি করে গণ গ্রন্থাগার স্থাপন করতে হবে। প্রাথমিক স্কুলে বই পরিবেশন এ গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হবে। থানা গ্রন্থাগার স্থাপনের ব্যয়ভার বহন করবে জাতীয় সরকার। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য হতে হবে দেশের প্রত্যেকটি প্রাথমিক স্কুলে গ্রন্থাগার স্থাপন”। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রন্থাগারের এ রূপকল্প যা বঙ্গবন্ধু সেদিন দিয়েছিলেন, আজও তা পূরণ হয়নি।

মাধ্যমিক স্কুলের গ্রন্থাগার
বঙ্গবন্ধু গঠিত শিক্ষা কমিশনে এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, “মাধ্যমিক স্কুলের গ্রন্থাগারগুলো নানা কারণে অচল হয়ে পড়েছে। এখানে বহু পুরাতন জরাজীর্ণ, কীটদৃষ্ট অকেজো বইয়ের গাদায় পড়ে নতুন বইগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। স্থান বা আলমারির অভাবে অকেজো বইগুলো আলাদা করা সম্ভব হয় না। তাই কমিশন মনে করে মাধ্যমিক স্কুলের গ্রন্থাগার মামুলি উন্নয়ন বা জোড়াতালির ব্যাপার নয়, একে সম্পূর্ণরূপে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে’।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার
বঙ্গবন্ধু গঠিত শিক্ষা কমিশনের মতে কলেজ গ্রন্থাগারগুলোর দৈন্য মূলত মাধ্যমিক স্কুল গ্রন্থাগারের দৈন্যের মতোই। এখানেও স্থানাভাব সর্বত্র প্রকট। কলেজ গ্রন্থাগারের উন্নয়নের ন্যুনতম মান সম্বন্ধে কমিশনের সুপারিশ ছিল, ‘কলেজ গ্রন্থাগারের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ অপরিহার্য। কলেজ গ্রন্থাগার সকাল ৮টা থেকে রাত্রি ৯টা পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে’।

শিক্ষা কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার নিয়েও তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কমিশন অভিমত ব্যক্ত করেছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গ্রন্থাগার উন্নয়নের ব্যাপারে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।’ 

কমিশন আরো বলেছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বই, সাময়িকীর বরাদ্দ বাড়াতে হবে, গবেষণাকর্মকে জোরদার করবার জন্য রেফারেন্স বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে এবং বিদেশী বই, ফিল্ম ইত্যাদি আমদানির জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা ও সরকারি আনুকূল্যের প্রয়োজন হবে।’ 

ভাল গ্রন্থাগার করতে হলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উন্নতমানের গ্রন্থাগারিক প্রয়োজন। চাহিদা পূরণের পক্ষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। কমিশনের সুপারিশ ছিল, ‘যোগ্যতাসম্পন্ন গ্রন্থাগারিকদেরকে পদমর্যাদা ও পারিশ্রমিকের ব্যাপারে শিক্ষকদের পর্যায়ভুক্ত করা উচিৎ’।

বঙ্গবন্ধু গঠিত ঐ শিক্ষা কমিশনে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শিক্ষাঙ্গনে লাইব্রেরির পাশাপাশি মিউজিয়াম স্থাপনের আবশ্যকতার কথা বলা হয়েছে। সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিবর্তনের রূপরেখা মিউজিয়ামে যথাসম্ভব বিবৃত হয়। 

তাই শিক্ষাঙ্গনে মিউজিয়ামের সাহায্যে শিক্ষাদান পর্ব অধিকতর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কমিশনের এমন পরামর্শ বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগার চিন্তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে গৃহীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রন্থাগারের উন্নয়নে দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন।

দুর্ভাগ্য এ জাতির। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে রূপ লাভ করার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনাকে পুনরায় কার্যকরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

দেশরত্ন শেখ হাসিনার ২০১০ সালের শিক্ষা নীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনার ব্যাপক প্রতিফলন ঘটেছে। তার সরকারের আমলেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিকের আশাতীত পদ সৃষ্টি হয়। 

তিনি গ্রন্থাগারিকের মর্যাদা ও বেতন বৃদ্ধি করেছেন। পেশার মর্যাদা বৃদ্ধিতে ৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ পালনের ঘোঘণা দিয়েছেন। এ সরকারের আমলেই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর মাধ্যমে এ পদের চাহিদা বর্তমানে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমস্যা হলো, এত অধিক সংখ্যক পদ পূরণে সাপ্লাই চেইন অত্যন্ত দুর্বল। দেশে ১৫০টির-ও অধিক সরকারি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও মাত্র ৩টি সরকারি ও ৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষষে স্মাতক সম্মান ও মাস্টার ডিগ্রি প্রদান করা হয়। 

দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মুহূর্তে ২৮,৫০০টি পদ সৃষ্টি হলেও মাত্র ২০০ গ্র্যাজুয়েট এ বিষয়ে ডিগ্রি সম্পন্ন করছে। ফলে এক শ্রেণির অসাধু শিক্ষা ব্যবসায়ীদের অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভূয়া সনদ বিক্রির মানসিকতা পরিলক্ষিত হয়। যা দুঃখজনক! অচিরেই সকল সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয়টি চালু করে এ সমস্যার সমাধান জরুরি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৪১ এবং সর্বশেষ ডেল্টা প্লান ২১০০ ঘোষণা করেছেন এবং প্রত্যেকটি ভিশন সফলভাবে বাস্তবায়নে শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

 পাশাপাশি সভ্যতার পরিক্রমায় মানুষের চর্চিত চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মনন-দর্শনের একমাত্র আধার ‘গ্রন্থাগার’ হচ্ছে জাতির সঠিক আলোর দিশারী। বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্য কন্যার এ গ্রন্থাগার ভাবনা আগামী দিনের পথ চলায় আলো ছড়াবে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে এ ভাবনা জাতিকে পথ দেখাবে।

লেখক: মো. নাসির উদ্দীন মিতুল (ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
 

আমারসংবাদ/এআই