Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

করোনাকালীন শিক্ষা ভাবনা

মোস্তফা মোরশেদ

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৬:২৫ এএম


করোনাকালীন শিক্ষা ভাবনা

কোভিড-১৯-এর ভয়াল থাবায় পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবহন খাত; ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শপিংমল, ইত্যাদি অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে অনেকখানি। 

তবে সবকিছুর মাঝেও বিভিন্ন সময়ে নেয়া যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলোর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। তারপরও বোধকরি, শিক্ষা খাতেই এ সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির মাত্রা ও পরিমাণ অনেক। প্রত্যক্ষভাবে, গত বছরের ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষিপ্ত লকডাউনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতির পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। 

পরোক্ষভাবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দুটি খাতে বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত. শিক্ষা উপকরণের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে লোকসানের মুখে পড়েছেন। দ্বিতীয়ত. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পরিবহন খাতে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে।

শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষভাবে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা আলোচনা করা যাক। ২০২০ সালে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই কিছু পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে এর কোনো ভালো বিকল্প ছিলো না।

তবে যে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, প্রাথমিক বা নিম্ন মাধ্যমিক (এমনকি মাধ্যমিক) পর্যায় পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর গ্রেড পরিবর্তনে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। 

চতুর্থ বা অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত কোনো শিক্ষার্থী কোনোরূপ পরীক্ষা ছাড়াই উপরের শ্রেণিতে উঠে গেলে বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশুনা করছেন তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। 

পরীক্ষা ছাড়া উপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও শিক্ষা-পরবর্তী জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংপড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থীর জন্য এ রকম কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, যে লেখাপড়ার সঙ্গে ব্যবহারিক বিষয় জড়িত সেসব ক্ষেত্রে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি বিবেচনা করতে হবে। 

করোনাকালে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের। এসব নিয়ে অনেক মজার ট্রল হচ্ছে। অনলাইনে ক্লাস করে মেডিকেলের একজন শিক্ষার্থী পরে ডাক্তার হয়ে ফটোশপে বুকের হাড় জোড়া দেয়া কিংবা প্রকৌশলের শিক্ষার্থী হয়ে কাচের দেয়াল দিয়ে শৌচাগার নির্মাণ করা ইত্যাদি নিয়ে ‘নেট-দুনিয়া’ অনেক হাস্যরসের জোগান দিচ্ছে। বাস্তবতা কিন্তু এরকমই। যদি সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে সঠিক পাঠদান না হয়, তবে আগামীর ভবিষ্যৎ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে, যদি এ অবস্থা চলতে থাকে কিংবা যদি নিকট ভবিষ্যতে আবারো এরকম কোনো অতিমারিতে আক্রান্ত হতে হয় তবে শিক্ষাদান নিয়ে আমাদের হাতে বিকল্প কী ব্যবস্থা রয়েছে—ভাবতে হবে। অনলাইনে পাঠদান নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তিনটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। 

এক. অনলাইনে পাঠদানের কার্যকারিতা হিসাব করলে দেখা যায় এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা সমান গুরুত্ব বহন করেন। দুই. অনলাইনে সকল আয়ের শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ না থাকায় বৈষম্য হতে পারে।

তিন. অনলাইনে শিক্ষাদান ও গ্রহণে অভ্যস্ততা না থাকায় কোনোরূপ ফলপ্রসূ শিক্ষাদান ছাড়াই এ কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে যা কার্যত কোনো ফল নিয়ে আসবে না।

বিষয়গুলো ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। অনলাইনে পাঠদানের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঠিকভাবে সংযোগ স্থাপন করা। ধরে নিলাম, সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হলো। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর কাছে সম্পূর্ণ নতুন কোনো বিষয় কীভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে? 

যেখানে ক্লাসের পরিবেশেই শিক্ষকদের পক্ষে সব শিক্ষার্থীর কাছে সমানভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয় না, সেখানে অনলাইনে কতটুকু সম্ভব? সমাধান কী? বাস্তবসম্মত সমাধান হচ্ছে, যে বিষয় পড়ানো হবে পূর্বেই তার একটি গাইডলাইন তৈরি করে শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো পৌঁছে দেয়া। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের নজরদারির বিষয়টি অধিক গুরুত্ব রাখে। 

ধরুন, জীববিজ্ঞানের সালোক সংশ্লেষণ বা বাংলা ব্যাকরণের সমাস নিয়ে আলোচনা হবে। একজন শিক্ষার্থী যদি এ বিষয়ে পূর্বপ্রস্তুতি রাখে তবে অনলাইন থেকে অনেক বেশি শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষকদের একটি সময়ভিত্তিক পরিপূর্ণ গাইডলাইন তৈরি করা এবং অভিভাবকদের তা কঠোরভাবে তদারকি করা। এরকম না হলে অনলাইনে পাঠদান ফলপ্রসূ হবে না।

অভিভাবকদের আয়-বৈষম্যের কারণে অনলাইন ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের শিক্ষার্থীর কাছে সমানভাবে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অনেকের তো অনলাইনে সংযোগ হওয়ার কোনো উপকরণই নেই। এক্ষেত্রে সরকারি অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে স্কুল কর্তৃপক্ষ শুধু নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে। বিষয়টি অনেকটা progressive আয়কর ব্যবস্থার মতো। 

তবে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, ফলপ্রসূ পাঠদানের জন্য সঠিক কৌশল নির্ধারণ করা। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ তা হলো ‘পরীক্ষাপদ্ধতি। গতানুগতিক প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে যাচাই করা হয়। বিগত চার-পাঁচ বছরের প্রশ্ন সমাধান করলে যেকোনো পরীক্ষায় উতরে যাওয়া সম্ভব। 

অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি, আমি ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অব এসেক্স থেকে ফলিত অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করি। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মডিউলের প্রশ্ন আপলোড করা ছিলো যাতে ‘পরীক্ষাপদ্ধতি ও প্রশ্ন নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। 

বিশ্বাস করুন, সেখানে কোনো একটি প্রশ্নেরও পুনরাবৃত্তি পাওয়া যায়নি। পরীক্ষায় এরকম প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করার বড় দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত সবার। আমি মনে করি, এর বড় দায় শিক্ষকদের। পরীক্ষার মানসম্মত ও যুগোপযোগী প্রশ্ন প্রণয়নে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে এবং এজন্য শিক্ষকসহ সম্পৃক্ত সবার জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। 

শুধু করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থায় নয় বরং মধ্যম আয়ের ফাঁদ অতিক্রম করে একটি উচ্চ আয়ের বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রশ্ন পদ্ধতি আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে যে ‘জনমিতিক মুনাফা’ রয়েছে তার সুফল ভোগ করতেও এর বিকল্প নেই।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশের পরিচালিত এক অনলাইন জরিপের বিষয়ে কিছু বলতে চাই। ১৯৬০ জনের অংশগ্রহণে এ জরিপে দেখা যায়, ৫৪.৭ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করছেন না; ৬৮ শতাংশ শিক্ষক স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ করছেন; ৬৭ শতাংশ অভিভাবক সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত ফি প্রদানে আগ্রহী নন; ৬৮.৮ শতাংশ শিক্ষক অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহনে সরকারি অনুদান দাবি করেন; ৫০.৭ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন তাদের সন্তানের স্কুল, স্বাস্থ্য-নির্দেশিকা মেনে চলতে সক্ষম না, যদিও ৬৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন তাদের স্কুলের স্বাস্থ্য-নির্দেশিকা নিশ্চিত করার সামর্থ্য রয়েছে।

এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারী অন্যদের মধ্যে ৬০.৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী স্কুল খোলা উচিত বলে মনে করেন, যদিও ৫২.২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ধারণা করেন এতে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, অর্ধেকের বেশি মানুষ বলছেন যে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করছেন না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সরকার যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। একজন অভিভাবক হিসেবে বলছি, এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আমার সন্তানদের কোনো অবস্থাতেই স্কুলে পাঠাতাম না। কারণ আমার সন্তানদের পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করা অসম্ভব। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ নিয়ে অনেকেই তীর্যক মন্তব্য করছেন। 

কেউ কেউ তো এভাবে বলছেন, শেষ বিচারের দিনে খাতা-কলম নিয়ে একেবারে পরীক্ষায় বসে যেতে! একটি বিষয় মাথায় নেয়া জরুরি। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয় আর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ে, ফলে শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হয় তবে এ দায়িত্ব কে নেবে? 

যদি খুলে দেয়ার পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা না যায় তবে এ দায়িত্বও কে নেবে? এসব প্রশ্নের পরিপূর্ণ কোনো উত্তর নেই বিধায় আমি মনে করি সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত যথার্থ ও সঠিক।

পরিশেষে বলতে চাই, করোনাকালীন এ অতিমারি থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় কী প্রকার পরিবর্তন আনা যায় তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। অনলাইনে হোক আর সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে হোক শিক্ষাব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আদলে ‘রূপকল্প-২০৪১’ নির্মাণ করা অসম্ভব হবে।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক

আমারসংবাদ/এআই