Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

করোনাকালের বিশ্বায়ন বাস্তবতা

রায়হান আহমেদ তপাদার

মার্চ ২, ২০২১, ০৯:২০ এএম


করোনাকালের বিশ্বায়ন বাস্তবতা

করোনা ভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। এমনকি প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের প্রভাবে স্তম্ভিত হয়ে গেছে পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়, বরং প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে করোনার প্রকোপ। শুধু ভয়াবহতা ও সংকট নয়, করোনা শিখিয়েও দিয়েছে অনেক কিছু এবং ফুটিয়ে তুলেছে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের শক্তি-সামর্থ্য। 

ভাইরাসটি আমাদের আরও একটি বড় আকারের শিক্ষা দিয়ে গেলো, তা হচ্ছে জনসচেতনতা। আমাদের এখানে কোয়ারেন্টাইন, সেলফ কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন— এ ধরনের বিষয়ে জনসাধারণের বিপুল অংশের মধ্যে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। 

সামাজিক এ বিষয়গুলো সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই পৌরনীতির মতো শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাছাড়া সাইকোলজিক্যাল সেশন এবং বিভিন্ন প্রকার সচেতনতা প্রোগ্রাম করার মাধ্যমে এ ধরনের শিক্ষা দেয়া খুবই জরুরি। 

এ ব্যাপারে মহামারির পরবর্তী সময়ে সরকারকে ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে মানুষের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার শিক্ষা পাওয়াও প্রয়োজন বলে করোনা ভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে। ২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশে একটি নতুন করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্ত করা হয়েছিল। যা আগে কখনো মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি। 

করোনা ভাইরাস সমগোত্রীয় ভাইরাসের একটি বড় পরিবার, যেগুলো সাধারণ সর্দিজ্বর থেকে শুরু করে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (মার্স) ও সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোমের (সার্স) মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। 

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু চীনের হুবে প্রদেশের উহানে আবির্ভূত হয়ে হাজার হাজার মানুষকে নিউমোনিয়ার ন্যায় অসুখে আক্রান্ত করেছিল এবং কয়েক হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে, সেই জীবাণু যে বছরাধিককাল ধরে সারা বিশ্বে তাণ্ডবনৃত্য চালিয়ে যাবে তা অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানীও কল্পনা করতে পারেননি। 

বিংশ শতাব্দীতেই মানুষ চন্দ্র জয় করেছে, মঙ্গলগ্রহ জয় করেছে, এখন লোকসংখ্যার ভারে ন্যূব্জ পৃথিবীকে ভারমুক্ত করতে মঙ্গলে কীভাবে উপনিবেশ স্থাপন করা যায় এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে অথচ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অণুজীব করোনা ভাইরাসের রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানীরা আজ হিমশিম খাচ্ছেন। 

দেশে দেশে কয়েক হাজারবার এ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেও বিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন, এ অণুজীবের অনেক কিছুই তাদের অজানা। বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধক এবং কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং অনেকটা সফলও হয়েছেন।

তবে এটা ঠিক, এখনো এর শতভাগ কার্যকর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ হলো— এ অণুজীবের গতিধারা, রহস্য ও চরিত্র সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাচ্ছে না। বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলও সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন এবং ইতোমধ্যে বেশকিছু টিকা দেশে দেশে মানবদেহে প্রয়োগ করা হচ্ছে। অত্যন্ত অল্প সময়ে এ টিকাগুলো আবিষ্কার করে বিজ্ঞানীরা মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে, অতীতে বিশ্বে যত টিকা এসেছে তার কোনোটিই এত স্বল্প সময়ে উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি।

কোভিড-১৯-এর প্রত্যক্ষ আঘাত এসে পড়েছে বিশ্বের অর্থনীতি ও শিক্ষা খাতে। তবে এ আঘাত উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশগুলো যত সহজে সামলাতে পারবে, উন্নয়নশীল ও পিছিয়ে পড়া দেশগুলো তত সহজে সামাল দিতে পারবে না। শিক্ষা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং এর অভিঘাতে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমও বিঘ্নিত হবে। আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ২০% বৃদ্ধি পেয়ে এখন চল্লিশ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। 

সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্য বিমোচনে যে গতি লাভ করেছিল, করোনার প্রভাবে তা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। আইএমএফ আশঙ্কা করছে, এ বছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ৯ কোটি লোক চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে। ২০২০ সালে বিশ্বের অনেক দেশের এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। 

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ধারণা করে, ২০২১ সালে প্রায় সব দেশই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে, তবে প্রাক কোভিড পর্যায়ে ফিরতে বেশ সময় লেগে যাবে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথন বলেছেন, ‘দুঃখের দিন দীর্ঘ হবে। উত্তরণের পথ থাকবে নানা খানাখন্দকে ভরা, অনিশ্চয়তা থাকবে তুঙ্গে।’ 

আমাদের দেশে করোনাকালে যে বিশ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের দারিদ্র্যমুক্ত করাও সময় সাপেক্ষ হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকেই জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর শেষের দশকে যে হারে দারিদ্র্যবিমোচন হয়েছে, একবিংশ শতাব্দীতে সে হার ক্রমশ শ্লথ হয়ে এসেছে।

অথচ আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়েছে। কোভিডের মহাদুর্যোগকালে দেশে প্রায় দশ হাজার কোটিপতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সুফল ভোগ করছে উপরতলার কিছু মানুষ, নিচতলায় তা ছিটেফোঁটাও পৌঁছছে না।

এটা আজ প্রমাণিত সত্য যে, অতি ধনী বৃদ্ধিতে বিশ্বের মধ্যে আমরা প্রথম স্থান অধিকার করেছি। স্বল্প আয়ের এই দেশে যেভাবে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে, মানুষে মানুষে আয় বৈষম্য এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। 

এসব বিষয় যথাযথভাবে মোকাবিলা না করলে যত প্রবৃদ্ধিই হোক দারিদ্র্যবিমোচনে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাবে না। বিশ্বের ২২১টি দেশ ও অঞ্চল করোনার কবলে পড়েছে। সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা সাড়ে দশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ২৩ লাখ মানুষের। শনাক্তের প্রেক্ষিতে মৃত্যুর হার ২.১৭%।

কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে সবার উপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। সেদেশে ৪ ফেব্রুয়ারি একদিনেই পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। দেশের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা করোনার ছোবলে আজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সংক্রমণের নিরিখে ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে হলেও মৃত্যুর হার বেশ স্বস্তিদায়ক। 

ভারতে শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১.৪২%। আক্রান্ত কম হলেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মৃতের হার পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি এবং এটি দুই শতাংশের উপরে। সংক্রমিত ও মৃত্যুর হারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। আক্রান্ত ও দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনা করলে বর্তমানে বাংলাদেশ বেশ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে থাকলেও করোনা নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলা এখনো সম্ভব নয়। 

যেহেতু কোভিড-১৯ বারবার রূপ বদলাচ্ছে তাই এ ভাইরাসটি কখন কিরূপে আঘাত হানবে তা পূর্বানুমান করা দুঃসাধ্য। আমাদের দেশে মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কম হলেও বয়সের নিরিখে মৃত্যের সংখ্যা দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। 

দেখা যায়, করোনার ছোবলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের প্রায় ৪০% শতাংশের বয়স ৬০ বছরের নিচে। ৬০ বছর বা এর নিচে যাদের বয়স তারা দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। করোনার আঘাতে এ বয়সসীমার মানুষের মৃত্যু পরিবার ও দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষত সৃষ্টি করবে। ২০ সালে আপাত অদৃশ্য এ অণুজীবের ভয়ে সারা বিশ্ব ছিলো জড়সড়ো। 

তবে ২০২১ সালে এসে মানুষের সে ভয় অনেকটা কেটে গেছে। মানুষের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু অতিমারির ভয়াবহতা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এখনো সারা বিশ্বে দৈনিক পাঁচ লাখের অধিক মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রায় ষোলো হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। বলা যায়, পরাক্রমশালী এ ভাইরাসটি প্রবল প্রতাপেই তার মারণযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মনোবল বৃদ্ধির কারণ হলো, একে প্রতিহত করার বেশকিছু হাতিয়ার মানুষের হাতে এসে পৌঁছেছে। 

বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনায় এ জীবাণুটিকে প্রতিরোধ করার কয়েকটি অস্ত্র আমরা পেয়ে গেছি এবং এগুলোর ব্যবহারও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ভাইরাসটি যেমন বারবার রূপ বদল করে শক্তি সঞ্চয় করছে, বিজ্ঞানীরাও নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে তাদের হাতিয়ারগুলো আরও শাণিত করে তুলছেন। প্রত্যাশা করা যায়, সহসাই একে শতভাগ ঘায়েল করার অস্ত্র মানুষ পেয়ে যাবে। 

তবে দুঃখের বিষয় যে, বিজ্ঞানীরা মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়ে যেভাবে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, বিশ্বমোড়লরা এবং ব্যবসায়ীরা সেরূপ আচরণ করছেন না। ব্যবসায়ীরা এই প্রতিষেধকগুলো বাজারজাত করে আশাতীত মুনাফার স্বপ্ন দেখছে। 

ইতোমধ্যে ২২১টি দেশ ও অঞ্চল কোভিডের গ্রাসে পতিত হলেও উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের ৭৫% কুক্ষিগত করে নিচ্ছে ধনী দশটি দেশ। তবে এটা মনে রাখতে হবে, মহাসংক্রামক এ ভইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে হলে একযোগে বিশ্বব্যাপী প্রতিষেধক টিকাগুলো প্রয়োগ শুরু করা অপরিহার্য। 

আজকের বিশ্ববাস্তবতা বোঝাতে এ একটি শব্দের অতিরিক্ত আর কিছুই দরকার হয় না। এক অতিক্ষুদ্র জীবাণুকণা আমাদের কর্মমুখর পৃথিবীকে এক ঝটকায় ঘরবন্দি করে ফেলেছে। কাজ নেই দুনিয়াজুড়ে কোনো মানুষের, লকডাউন। অর্থনীতি স্থবির, নিশ্চিত মহামন্দা ধেয়ে আসছে মহামারি শেষে, সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ, ব্যর্থ দুনিয়ার সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্বচালকগণ। 

সবশেষে বলবো, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, সভ্যতার বিভিন্ন সময় করোনা ভাইরাস সদৃশ অনেক ভাইরাস আমাদের এ পৃথিবীতে এসেছে, আবার সেটি একসময় চলেও গেছে। করোনা ভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যক্তিগত সতর্কতা, সুস্থতা, হাইজিন জীবন-যাপন, যার যার ধর্ম অনুসারে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ— এ বিষয়গুলো এখন বাস্তবতা। 

বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে ঢুকে গেছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস। এ সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আমরা কতটুকু নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি এবং নিজেদের উন্নতি করছি এটাই এখন মুখ্য বিষয়। আশা করি আমরা এ চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করতে পারবো।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এআই