Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

সাদা কালো টিভিতে রঙিন শৈশব

এপ্রিল ২৫, ২০২১, ০১:০৫ পিএম


সাদা কালো টিভিতে রঙিন শৈশব

আজ থেকে ১০/১২ বছর আগের কথা। কৈশোরের বেশির ভাগ সময় আমার কেটেছে মামা বাড়ি। মেঘনা নদীর এপাড় ঘেঁষে আমাদের বাড়ি ওপাড় ঘেঁষে মামা বাড়ি। শৈশব, কৈশোরের অধিকাংশ সময় আমি মামা বাড়িতে বড় হয়েছি। বড় হয়েছি, মামাদের সাথেই। স্কুলে বৃহস্পতিবার দিন সব সময় হাফ ক্লাস হতো। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরেই চলে যেতাম মামা বাড়ি। নৌকোতে যেতে হয়, তখন ভাড়া ছিল মাত্র ৫টাকা ছোট ছিলাম বলে ফ্রিতেই নিয়ে যেতো আঃ খালেক মাঝি। 

নানা তখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি পরপারে। নানা-নানী জানতেন প্রতি বৃহস্পতিবার আমি আসবো। যদি কখনো কোন দিন যেতে না পারতাম নানা ঠিক চলে আসতেন নৌকো নিয়ে। 

মামাদের সাথে লাঠিম, ক্রিকেট, বর্ষা কালে ধইঞ্চা গাছ দিয়ে ডাং গুটি খেলা, দুপুরবেলা এক সাথে নদীতে ঝাঁপাঝাপি করা,রাতের বেলা প্রচন্ড গরম থাকা সত্যেও সাত আট জন এক সাথে এক খাটে ঘুমিয়ে থাকার সময় ছিল সবচেয়ে সুখকর। সেই থেকে সমবয়সী ও ইমেডিয়েট সিনিয়র মামাদের সাথে গড়ে উঠে আমার সখ্যতা, সম্পর্কটা মামার বদলে রুপ নেয় বন্ধুত্বে।

১২বছর আগে যখন মামাদের গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। হারিকেন, মোমের আলোর প্রতি নির্ভরশীল ছিল মামাদের গ্রামের সকল মানুষ। প্রায় সময় সবাই বাড়ির উঠুনে মাদুর বিছিয়ে খোলা আকাশের নিচে চাঁদের দিকে তাকিয়ে নানা রকম গল্প, ভূতের গল্প, রাজা-রানির গল্প, রুপকথার গল্প শুনে শুনে ঘুমানো হতো।

গল্প শুনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। রাতে তখন প্রতিটি ঘরের দরজা খোলা থাকতো। আজকালের মতে এত চোর ডাকাত ছিল না তখন। প্রয়োজনীয় অনেক কিছু অবলীলায় বাহিরে রেখে দিত মানুষ।

গ্রামে তখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার শুরু হয়। আমার নানার ঘরে তখন সাদকালো টিভি ছিল। বাড়ির সবাই মিলে প্রতি মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার,শুক্রবার টিভির সামনে দল বেঁধে বসে যেতাম। 

'হানিফ সংকেতের ইত্যাদি, আলিফ-লায়লা, হাতিম, সিসিমপুর' অনুষ্ঠানই ছিল সবার প্রথম আকর্ষণ। যে যেখানে জায়গা পেতো মাটির মেঝেতে কিংবা বাহিরে বসে যেত। যেভাবেই হোক পছন্দের অনুষ্ঠানটি দেখতে হবে। মাঝে মাঝেই টিভির লাইন চলে যেতো, বারবার ঠিক করা লাগতো এন্টেনার। সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ ছিল বুঝি এটাই। 

তখন আমাদের সাদাকালো টিভিতে ছিল রঙিন শৈশব। তখন নায়ক- নায়িকাদের মধ্যে সবার নজর ছিল, আলমগীর, সাবানা, মান্না, পূর্নিমা, রিয়াজ। কমেডি চরিত্র করতো তখন প্রয়াত দিলদার। 

তখন সাদা পর্দার সাথে কিছু ছবি উপস্থিত সবার চোখে এনে দিতো জল, আবার কিছু ছবি এনে দিতো এক রাশ অট্টহাসি। কেউ যদি কোন দিন কোন ছবি মিস করতো পরের দিন ছবির পুরোটা চিত্রই তার চোখের সামনে তোলে ধরতো কেউ কেউ। যেন পুরো ছবিটাই তার মনে গেঁথে আছে। 

তখন মামা বাড়িতে টিভি দেখতে দেখতে খেয়াল থাকতো না রাত কয়টা বাজে। ঘর থেকে দূরে একটা টর্চ লাইটের আলো দেখা যেতো। টর্চের আলো দেখার সাথে সাথেই ঘরে টিভি দেখা জন কুড়ি মানুষ কে কোন দিক দিয়ে পালিয়েছে ঠিক নেই। মূহুর্তের মধ্যে ঘর খালি হয়ে যতো যত স্বাদের অনুষ্ঠানই হোক। বুঝতে খানিকক্ষণও দেড়ি হতো না যে আমার নানা আসছে ঘরের দিকে।

বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নানা মামাদের গ্রামের চায়ের দোকানে বসে বসে পঞ্চায়েত কমিটির সাথে গ্রামের বিচার আচার শেষ করে ঘরে ফিরতো। দেখতাম বাড়ির সবাই নানাকে ভীষণ ভয় পেতো। 

নানা যদি বলতেন উঠো সবাই উঠে যেতেন, যদি বলতেন বসো সবাই বসে যেতেন। সবাই খুব সম্মানও করতো। আর আজ নানা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ৮ বছর হয়ে গেলো। আচ্ছা মামা বাড়ির সেই মানুষ গুলো কি নানাকে এখন মিস করেন? নানান শূন্যতা অনুভব করেন?

এভাবেই সময় কেটে যায়, পালাবদল হতে থাকে ঋতুর। আমি আমরাও বড় হতে থাকি। বড় হতে হতে আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের শৈশব কৈশোর। হারিয়ে ফেলি সেই রাতের বেলা উঠুনে সুয়ে সুয়ে কালো আকাশে শুভ্র চাঁদ, তারা দেখার দিন গুলো। 

হারিয়ে ফেলি মেঝেতে বসে সাদা কালো টিভিতে প্রিয় অনুষ্ঠান দেখার সময়টা। হারিয়ে ফেলি প্রিয় মানুষ গুলো। বড় হতে হতে অনুভব করি শৈশবটা সুন্দর ছিল। শৈশবের বায়না গুলো ছোট্ট ছিল তবে শান্তি ছিল বেশ। হারিয়ে ফেলা প্রিয় শৈশব হয়ে রয় স্মৃতিরোমন্থন।

লেখা: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী

আমারসংবাদ/এআই