Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

‘সাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন’

এম. রনি ইসলাম

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১, ১২:৫০ পিএম


‘সাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন’

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে সমাজতন্ত্রকে একটি জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সমাজতন্ত্র অর্জিত হবে, তার কোনো তাত্ত্বিক কাঠামো শাসনতন্ত্রে নেই। সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে তা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে করতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যসমুহ এমন হতে হবে, যা দেশের সব মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য। 

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রের তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। যা-(ক)মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, (খ)দেশের সকল মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; ও (গ)অসাম্য হ্রাস করা। প্রথম দুটিতে বাংলাদেশ কিছুটা সফলতা অর্জন করলেও তৃতীয় লক্ষ্য অর্জনে এখনও উল্লেখযোগ্য কিছু লক্ষ্য করা যায়নি। ক্ষুধিত ও দরিদ্রের হার কমেছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবারও সম্প্রসারণ ঘটেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের তুলনায় এখনও পিছিয়ে রয়েছে। দরিদ্রের হার ৭০.২ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি আমাদের জন্য সুখবর হলেও বর্তমান বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে এ সংখ্যা অনেক বেশি। 

বাংলাদেশ এখনও পৃথিবীর দারিদ্র্যের একটি বড় গহ্বর। দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেলেও পুষ্টি পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত অসন্তোষজনক। বাংলাদেশে জলের আধিক্য সত্বেও সুপেয় পানীয়ের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের সমস্যা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় দরিদ্র মানুষেরা। পরিমাণগত দিক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে প্রশংসনীয় অর্জন ঘটলেও তার মান অত্যন্ত নিচু। এই মানোন্নয়নের জন্য সময় ও সম্পদের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান কিছুটা উন্নতি হলেও তা এখনও প্রকটাকারেই রয়েছে। বেকার সমস্যা বিবেচনায় বাংলাদেশকে মহামন্দার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। 

এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হারে ২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বেকার সমস্যার ফলে নবীন জনগোষ্ঠী সমাজব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তাতে বড় ধরনের সামাজিক অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন দ্রুত টেকসই উন্নয়ন। এ কাজটি জটিল হলেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে হবে। সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের বড় সমস্যা হলো অসাম্যের ব্যাপকতা বৃদ্ধি। অসাম্যের ব্যাপকতা বাড়লে একদিকে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয় অন্যদিকে এটা কমাতে গেলে অর্থনীতির উপর খারাপ প্রভাব  পড়তে পারে। 

অবশ্য এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা একমত নন। এ অসাম্যের ফলাফল নিয়ে তিন ধরনের মতবাদ রয়েছে। প্রথম ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা সান্ত্বনা দিয়ে বলে থাকেন যে, প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাড়লে অসাম্য বাড়তে থাকে। দেশ যখন অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে, তখন অসাম্যের ফলে সৃষ্ট সমস্যা হ্রাস করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক স্তর উত্তরণের পর অসাম্যতা কমতে থাকবে। এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েল কুজনেৎস। 

তার মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে অসাম্যতা বেড়ে যাওয়াতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। তাঁর এই সূত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের উল্টা ইউ(U)রেখা (Inverse U curve) নামে পরিচিত। ইংরেজি অক্ষর ‘ইউ’কে ওল্টালে যে রেখাচিত্র দেখা যাবে, তার তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশ বাম দিক থেকে ডানদিকে রেখাটি দ্রুত ওপরের দিকে উঠে যাবে। এর তাৎপর্য হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে অসাম্য দ্রুত বেড়ে যাবে। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে একটি সোজা অংশ, যেখানে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও অসাম্যতা স্থির থাকে। অর্থাৎ উন্নয়নের উচ্চস্তর পর্যায় অর্জিত হলে অসাম্য বন্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় অংশে রেখাটি বামদিক থেকে ডানদিকে নেমে আসে। এর তাৎপর্য হলো, উচ্চস্তরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে অসাম্য হ্রাস পেতে থাকে। 

কিন্তু সম্প্রতি এই সূত্রের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। কুজনেৎসের বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানীর মতো কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত। কিন্তু পরবর্তীকালে যেসব দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে, তাদের অসাম্য বাড়েনি, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে; যথা দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে অর্থনৈতিক অসাম্য লক্ষনীয়ভাবে না বাড়িয়েও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতাও এক্ষেত্রে আশাপ্রদ। কাজেই কুজনেৎসের উল্টো ইউ রেখা কতটুকু অবশ্যম্ভাবী, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সম্প্রতি ফরাসী অর্থনীতিবীদ টমাস পিকেটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কুজনেৎসের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। 

তার মতে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একদিকে মানুষের জ্ঞান ও নৈপুণ্য বৃদ্ধির ফলে আয়ের বৈষম্য কমছে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত পুঁজির ওপর ফিরতি হার জাতীয় প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে বেশি। এর ফলে পুঁজির মালিকদের হাতে অধিকতর সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে প্রবৃদ্ধির হার সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পেলেও  দীর্ঘ মেয়াদে উঁচু হারে প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই পুঁজির ওপর ফিরতির হার যে দেশে প্রবৃদ্ধির হার বেশি হবে,সেখানে সরকার পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সম্পদ ক্রমাগত পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে পুঞ্জীভূত হবে। 

পিকেটির মতে, এ ব্যবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো পুঁজির ফিরতি করের হার বৃদ্ধি। দ্বিতীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, প্রকৃত আর্থিক অসাম্যের চেয়ে সুযোগের অসমতার অপসারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক সাম্য সম্ভব নয়। প্রতিভাবান লোকেরা গড়পড়তা লোকের চেয়ে বেশি আয় করবেন, এটাই স্বাভাবিক; এটা মেনে নিতে সমস্যা নেই। কিন্তু সুযোগের সমতার অভাবে যদি কেউ প্রতিযোগিতা না করতে পারার জন্য দারিদ্র্যের গহ্বরে আটকে থাকে, তাহলে আপত্তি সেখানেই। বিশেষত বিশ্বায়িত ব্যবস্থায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজে সাধারণ মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েও অতি অল্প সময়ে জ্ঞানের ভিত্তিতে বড়লোক হওয়া সম্ভব। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বিল গেটস চার দশকের কম সময়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীদের মধ্যে স্থান লাভ করেছেন। 

বিশ্বব্যাংক তাই ২০০৬ সালে বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক সাম্যের পরিবর্তে সুযোগের সমতার ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করে। শুধু অর্থনৈতিক সাম্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, ক্ষমতার অসাম্য সমাজকে আরও বেশি পঙ্গু করে। ক্ষমতার অসাম্য থেকে যে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী লাভবান হয়, তারা এই অসাম্যকে চিরস্থায়ী করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলে। এভাবেই ভারতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জন্য বর্ণব্যবস্থা, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ও অনেক কৃষিপ্রধান দেশে সামন্তবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সব ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্যের ফাঁদ সৃষ্টি করা হয়। যেসব দুর্বল জনগোষ্ঠী এসব ফাঁদে আটকা পড়ে, তারা এই ফাঁদ থেকে আর বের হতে পারে না। দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা। 

ন্যায়নীতির স্বার্থে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা বিধানের প্রয়োজনঃ (ক)শিক্ষা, (খ)স্বাস্থ্য; (গ)সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ; (ঘ)লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য হ্রাস; (ঙ)বিচারব্যবস্থায় দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতকরণ; (চ)সবার জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি ব্যবহারের সুযোগ; (ছ)আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা। 
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক বৈষম্যে সীমাবদ্ধ। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও ঋণপ্রাপ্তির বৈষম্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকাণ্ডেও সরকারের উদ্যোগ কমে এসেছে। স্বাস্থ্য ও বিচার ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। তবে এ দুটি ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র সবার জন্যই সেবার মান অত্যন্ত অসন্তোষজনক। তৃতীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো, অর্থনৈতিক অসাম্য বিশ্বায়নের ফলে বাড়ছে। বর্তমানে এ পরিস্থিতি অসহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিগলিজ এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন ‘১ শতাংশের দ্বারা ১ শতাংশের জন্য ১ শতাংশ লোকের অর্থনীতি’। স্টিগলিজের মতে, অর্থনৈতিক অসাম্য তিনটি কারণে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। 

প্রথমত, অর্থনৈতিক অসাম্যের ফলে দরিদ্রদের জন্য সুযোগ হ্রাস পায়। এর ফলে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যথাযথভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। 

দ্বিতীয়ত, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য গড়ে ওঠে, সেখানে একচেটিয়া ব্যবসা ও ধনীদের জন্য সুবিধাজনক কর হার বেড়ে ওঠে। এর ফলে অর্থনৈতিক কার্যকারিতা হ্রাস পায়। তৃতীয়ত, যে সমাজে অসাম্য বেশি, সে সমাজে সবার উদ্যোগে গৃহীত ব্যবস্থা হ্রাস পায়। এর ফলে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ নেমে আসে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, যারা সমাজে ধনী, তারা রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনৈতিক অসাম্যের দীর্ঘমেয়াদী  প্রভাবের চেয়ে স্বল্পমেয়াদী সামাজিক প্রভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

মৌলিক চাহিদা পূরণ, বেকারত্ব, আর্থিক অসাম্য হ্রাস-সমাজতন্ত্রের এ তিনটি লক্ষ্য পূরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। এ লক্ষ্যসমূহ স্থির ও সুনির্দিষ্ট নয়। আর্থসামাজিক পরিবেশের বিবর্তনের ফলে এসব লক্ষ্যমাত্রা নিয়ত পরিবর্তনশীল। সমাজতন্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একটি বড় সত্য হলো এর শেষ কোথায়, তা জানা নেই। কবির ভাষায়, ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে’। 

বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রের তিনটি লক্ষ্যপূরণে অগ্রগতি হলেও তা যথেষ্ট নয়। সুখী সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক কাঠামো গঠন ও তা বাস্তবায়ন। তবেই বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

লেখক: এম. রনি ইসলাম
শিক্ষার্থী, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আমারসংবাদ/কেএস