Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

সংবিধানে ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা: দেশের বর্তমান পরিস্থিতি

মাহবুবুর রহমান, আইনজীবী 

অক্টোবর ১৮, ২০২১, ০২:২৫ পিএম


সংবিধানে ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা: দেশের বর্তমান পরিস্থিতি

বাংলাদেশের সংবিধানের ২(ক) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও রাষ্ট্র কর্তৃক অন্যান্য সকল ধর্ম পালনে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২(ক) তে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ সকল ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।'

এই অনুচ্ছেদেই সংবিধানের প্রস্তাবনায় এবং ৮নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গুলোর একটি তথা ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিশ্চিত করা হয়েছে বলেই আমি মনে করি।

কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যা বুঝায় তা অনুচ্ছেদ ২ক তে বিদ্যমান। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে রাষ্ট্র কোন নির্দিষ্ট ধর্মকে পরিপালন করবে না বা কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করবে না। সোজা বাংলায়, রাষ্ট্র কোন একটি ধর্মকে বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, যা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে পান না, প্রদান বা স্বীকৃতি দেবে না। 

অনেকে ২ক নং অনুচ্ছেদকে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পরিপন্থী মর্মে মনে করেন বা বলে থাকেন। কিন্তু, উপরোক্ত আলোচনা বিবেচনা করলে এটা স্পষ্ট ভাবে বুঝা যায় যে, অনুচ্ছেদ ২ক আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী না। 

আমার এই মতামতের পেছনে যুক্তি বা ব্যাখ্যা আমাদের সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদেই বিদ্যমান। ১২নং অনুচ্ছেদ ধর্মনিরপেক্ষতা কে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার কয়েকটি পন্থা আলোচনা করেছে। অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিষেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।

সুতরাং, উপরের চারটি বিষয়ের কোনটিই কিন্তু অনুচ্ছেদ ২ক দ্বারা বাস্তবায়ন করা হয়নি যার দরুন আমরা বলবো যে অনুচ্ছেদ ২ক ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি পরিপন্থী বা রাষ্ট্র এই অনুচ্ছেদে ইসলামের কথা বলে তার ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি থেকে সরে এসেছে।

কারণ, অনুচ্ছেদ ২ক তে কোন ইসলাম বা অন্য কোন ধর্মকেই রাজনৈতিক মর্যাদা দান করা হয়নি বা কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য কে বৈধতা দেওয়া হয়নি। বরং প্রত্যেক ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে বলে বলা হয়েছে। 

আবার, সংবিধানের ৩য় ভাগের ৪১নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। 

উপরোক্ত অনুচ্ছেদসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্র যদি কোন ধর্মের প্রতি বৈষম্য পোষণ করে থাকে, তবে তা হবে রাষ্ট্রের আত্ন-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পরিপন্থী কাজ। যেমন, রাষ্ট্র মনে করলো যেহেতু এদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বেশি, তাই তাদের প্রতি বেশি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, বা তাদেরকে বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলো। তবে তা হবে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পরিপন্থী এবং সংবিধানের ৪১নং অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।

আবার উল্টো টাও হতে পারে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র তার সামগ্রিক রাজনৈতিক সুবিধা বিবেচনায় বৃহৎ ধর্মের অনুসারীদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক মানুষের ধর্মাবলম্বীদের কে বেশি সুবিধা দিলে তাও হবে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পরিপন্থী। যদিও,  Positive Discrimination বলে আইনে একটি কথা আছে যা আমাদের সংবিধানের ২৮ এবং ২৯নং অনুচ্ছেদে স্বীকৃত। অর্থাৎ, রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের নারী বা শিশু অথবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রনয়ণ বা সুবিধা প্রদান করতে পারে। এখানে মানদণ্ড হলো নাগরিকদের কোন অংশ পিছিয়ে পড়া কি না, এই প্রশ্ন। ধর্ম Positive Discrimination এর কোন মানদণ্ড হতে পারে না। 

বিগত কয়েকদিন ধরে দেশে যে ধর্মীয় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তার পেছনে যেই জড়িত হোক না কেন, প্রমাণ সাপেক্ষে  তার দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হোক, এটাই আমাদের কাম্য। এই রাষ্ট্র সবার, হিন্দু- মুসলিম, বৌদ্ধ- খ্রীষ্টান যেই এদেশের নাগরিক, তারই অধিকার রয়েছে তার নিজ নিজ ধর্ম পালন, প্রচার করার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা। 

পূজার মণ্ডপে পবিত্র কুরআন যেই রাখুক না কেন সে ধর্মহীন কাজ করেছে। আবার এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে যারা অতি উৎসাহী হয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনার সময় বাধা প্রদান বা পূজার মণ্ডপে হামলা চালিয়েছে তারাও চরম  ধর্মহীন ও সংবিধান পরিপন্থী কাজ করেছে। আমাদের সংবিধানে যেমন করে প্রত্যেক ব্যক্তির  ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে,  যাকে আমরা আমাদের ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতা বলছি, ঠিক একইভাবে ইসলাম ধর্মেও প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলেছে। 

রাসুল (সঃ) এর একটি হাদীস পড়েছিলাম। তিনি বলেছেন, আখেরাতে এমন অনেক মুসলিম শাসককে আসামীর কাঠাগড়ায় দাঁড়াতে হবে যার শাসিত অঞ্চলে মুসলিমরা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের দ্বারা ঐ অঞ্চলের সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা  নির্যাতিত হয়েছিলো। 

সুতরাং, ধর্মের অবমাননা যে বা যারা করেছে, তাকে বা তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসাই হবে রাষ্ট্রের কাজ, তাতে সে বা তারা যে ধর্ম বা মতের অনুসারীই হোক না কেন। অন্যদিকে, ঘটনাটি মন্দিরে ঘটেছে বলে মন্দির ভাংচুর করা বা ধর্মীয় উগ্রতা ছড়ানো কখনোই ইসলাম অনুমতি দেয় না।

কারন, ইসলাম শুধু অপরাধীকেই শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছে। নিরপরাধ ব্যক্তি ধর্ম ও আমাদের আইন অনুযায়ী কোন শাস্তি পেতে পারেন না। আরো বলতে গেলে এদেশে যেন অন্যান্য ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্ম ভালোভাবে পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পাশাপাশি এদেশের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দায়িত্বও বটে। এটাই ইসলাম। 

ধর্মের সাথে ধর্মীয় উগ্রতার কোন সম্পর্ক নেই। এই ঘটনাকে পুজি করে দুই ধর্মের মানুষের মধ্য বিরোধের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। 

আমারসংবাদ/কেএস