Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রাচুর্যময় ঐতিহ্যের বাংলাদেশ

ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান

অক্টোবর ২০, ২০২১, ১০:৪৫ এএম


সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রাচুর্যময় ঐতিহ্যের বাংলাদেশ

মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তার মনুষ্যত্বে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের প্রাচুর্যময় ঐতিহ্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার কোন সুযোগ নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, একটি উস্কানিমূলক কর্মকান্ড যে কোন সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে পারে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেই রয়েছে। আমরা এমন অনেকবার দেখেছি, কিছু ধর্মীয় উগ্রবাদী ও স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় জনগণকে উত্তেজিত করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি পতাকা, একটি স্বাধীন দেশ। সেই রক্তে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ভেদাভেদ ছিল না, স্বাধীনতার ইতিহাসে ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না, সবার সম্মিলিত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য।

ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে কুমিল্লার দুর্গাপূজায় পূজামণ্ডপে সুপরিকল্পিতভাবে যেই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে তা ক্ষমার অযোগ্য। পবিত্র কোরআনের প্রতি এই অবমাননায় প্রতিটি মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। নগ্ন সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা এহেন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যার রেশ এখনও বহমান। তবে যদি এই নগ্ন ষড়যন্ত্রের ফলে শুরু হওয়া এই রক্তের খেলা যথাযথ ভাবে দমন না করা যায়, তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ঐতিহ্য অস্তমিত হতে সময় নেবে না। বিশ্বের দুয়ারে আমাদের দেশ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দুর্গোৎসবের মধ্যে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মকে ব্যবহার করে যারা সহিংসতা সৃষ্টি করছে তাদের খুঁজে বের করা হবে, যে ধর্মেরই হোক না কেন বিচার করা হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার তদন্ত চলমান অবস্থায় আছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে কাউকে আইন হাতে তুলে না নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। 

১৩ অক্টোবর, ২০২১ সকালে কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীরপাড় পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন অবমাননার অভিযোগে স্থানীয় জনগণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরআন অবমাননার কিছু ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র দেশে সাম্প্রদায়িক দাবানল ছড়িয়ে পড়ে মুহুর্তেই। উত্তেজিত স্থানীয় জনগণ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শহরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায়, দেশের বিভিন্ন জেলাতেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, অন্যান্য জেলাতেও বেশ কিছু মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর হয়। বান্দরবানের লামা উপজেলায় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করার সময় দু'পক্ষের সংঘর্ষে ১২-১৩ জন আহত হন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে একজন এসআইসহ তিন পুলিশ সদস্যও আহত হন। এছাড়াও চাঁদপুরে সংঘর্ষে প্রাণহানিও ঘটায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি হয় এবং কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ১৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ প্রশাসন।

এরমধ্যে অতি উৎসাহী কিছু তরুণ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর গুজব ছড়ানো শুরু করে পরিস্থিতি আরও বেসামাল করে ফেলে, যদিও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ে মা-বোন ও দশ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ এবং শিশু মৃত্যুর ব্যাপারে একটি মিথ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে। মূলত হাজীগঞ্জ উপজেলায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হাজীগঞ্জ উপজেলার সভাপতি বাবু রুহিদাস বণিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি গুজব বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সত্যব্রত ভদ্র মিঠুন, হাজীগঞ্জ থানার ওসি হারুনুর রশীদ এবং হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শোয়েব আহম্মেদ চিশতীও এই ঘটনাকে মিথ্যে এবং গুজব বলে জানান। তবে এই গুজব পার্শ্ববর্তী দেশেও ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মত, টুইটারে হ্যাশট্যাগের ঝড় শুরু হয়ে যায়। 

অজানা কেউ একজন মূর্তির নিচে পবিত্র কোরআন রাখলো। যে রেখেছে সে মুসলমান হোক আর হিন্দু হোক, সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার জন্যই রেখেছিল। ঘটনা ঘটলো কুমিল্লায়, আর অত্যাচারিত হলো অন্যান্য জেলার নিরপরাধ হিন্দু সমাজ। আজ যারা পবিত্র কুরআন অবমাননার বিচার চাইতে গিয়ে গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে নিরপরাধ হিন্দু সমাজের প্রতি অবিচার করলো, তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। ধর্মের নামে এধরণের অরাজক কার্যকলাপ কখনও ইসলাম সমর্থন করে না। সমাজে মুসলমান, হিন্দু, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি নাস্তিকও থাকবে। প্রতিটি ধর্মেই অন্য ধর্মের উপর হস্তক্ষেপের উপর বিধিনিষেধ দেয়া আছে। এক ধর্মাবলম্বী অন্য ধমার্বলম্বীকে সম্মান করার আদেশ বিদ্যমান। রাজনৈতিক আদর্শে বিভেদ থাকতেই পারে, স্বাধীন বাংলার মাটিতে সবাই বাঙালি, সাম্প্রদায়িক বিভেদের কোন স্থান নেই এদেশে।

এই করোনার ভয়াল থাবায় জর্জরিত আমাদের ব্যক্তি তথা সমাজ জীবন। পেশাগত ভাবেও আমাদের নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ডেঙ্গু সমস্যা, বিশুদ্ধ পানি সমস্যা থেকে শুরু করে বিদ্যুতের সমস্যা, গ্যাস সিলিন্ডারের উচ্চমূল্য, দ্রব্যমূল্য বাড়ার সমস্যা, শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা, স্বাস্থ্যখাতে সমস্যা, দুর্নীতির চাপে নিষ্পেষিত সমাজ। অথচ এগুলো নিয়ে আমরা কথা না বলে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক রোষানল উস্কে দিতে সদা প্রস্তুত। একটি মানচিত্র, একটি সংবিধান। সেই সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার। কেউ সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকতে পারে না এই দেশের মাটিতে। বাংলাদেশের উন্নয়ন তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিকাশ যদি আমাদের মূল উদ্দেশ্য হয়, তা হলে সাম্প্রদায়িকতার দাগ এদেশের মাটি থেকে মুছে ফেলতে হবে।

একাত্তরে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান থেকে আজকের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরের মাথায় সেই পাকিস্তান আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যেখানে ভারতও এখন চরম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের পরিচয় দিচ্ছে, সেখানে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের উদাহরণ হয়েই থাকুক। শুক্রবারে বিসর্জনের দিন হওয়ায় এবার পূজা উদযাপন পরিষদ বলে দিয়েছিল, জুম্মার নামাজের সময় যেন পূজা বা বিসর্জনের কোনো আয়োজন না করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবারের ন্যায় আজান এবং নামাজের সময় যেন মন্দিরে পূজা বন্ধ থাকে। কেননা বাংলাদেশে অনেক জায়গায় পাশাপাশি মসজিদ আর মন্দির আছে। এভাবেই সাম্প্রদায়িকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের উদাহরণ থাকবে বাংলাদেশ এটাই কাম্য।

লেখক: ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান। 

আমারসংবাদ/এমএস