Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় মেধাপাচার

মো. জিল্লুর রহমান

মো. জিল্লুর রহমান

জুন ১৬, ২০২২, ০১:০৯ এএম


উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় মেধাপাচার

মেধা পাচার একটি আন্তর্জাতিক ঘটনা যা মানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটি অনুষঙ্গ। কারিগরি দক্ষতা-সম্পন্ন কিংবা শিক্ষিত মেধাবীদের বিরাট অংশের অভিবাসন অথবা অন্যদেশে গমনের ফলশ্রুতিতে মেধা পাচার ঘটে। সাধারণত যুদ্ধ, সুযোগ সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জীবন যাপনের ঝুঁকির এড়াতে মেধা পাচার ঘটে থাকে। মেধা পাচারের কারণে একটি দেশ তার সবচেয়ে মেধাবী, জ্ঞানী, দক্ষ ও যোগ্য নাগরিককে হারায়। 

ইদানীং বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পেয়ে এক সময় হতাশ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। বৃত্তিসহ লোভনীয় সব সুবিধার কারণে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। সিংহভাগ শিক্ষার্থীর গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি শিল্পোন্নত দেশ। 

এসব দেশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও লোভনীয় অন্যান্য সুবিধা দিয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বড় অংশই পড়াশোনা শেষ করে আর দেশে ফেরে না। এর মধ্যে অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন। অভিবাসী হওয়া দেশগুলোয় চাকরি, বসবাসের সুযোগ ও জীবনযাত্রার উচ্চ মানের কারণে তারা দেশে ফেরেন না বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। 

তবে দেশের অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে এ দেশের মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা। বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই যুগে যখন বিশ্বের অনেক দেশই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রণোদনা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে তখন আমাদের দেশ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে না। সৃজনশীল গবেষণা খাতে নেই উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ। ফলে উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলেও উদ্ভাবনের সুযোগ পাচ্ছেন না এ দেশের অসংখ্য উদ্ভাবনশীল বিজ্ঞানীরা। যার ফলে ঘটছে অনিবার্য মেধা পাচার।

আসলে একটি দেশের উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে মানসন্মত অবদান রাখার সামর্থ্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা যখন নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে সে দেশের স্বার্থে স্থায়ীভাবে কাজ করে বা মেধাকে কাজে লাগায় তখন এই বিষয়টিকেই মেধা পাচার বলে। এসব ব্যক্তিরা হলেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, বিজ্ঞানী ইত্যাদি। 

এমনকি যার শিক্ষাগত যোগ্যতা কম কিন্তু একটি বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক অভিজ্ঞ ও পারদর্শী তার ক্ষেত্রেও মেধা পাচার বিষয়টি প্রযোজ্য। প্রতি বছর আমাদের দেশের একটি বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। কিন্তু তারা আর দেশে ফেরত আসে না বা আসতে চায় না। তাদের শিক্ষা খরচের বাবদ দেশের একটা বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করা হয়। 

এ কারণে ইদানীং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মেধা পাচার একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এটি সম্ভাব্যভাবে একটি জাতির সমগ্র উন্নয়নকে স্থবির করে দিতে পারে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও মেধা পাচারের ঘটনা প্রতি বছরই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। 

সামপ্রতিক বছরগুলোয় মেধা পাচার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দেয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ছাড়িয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। দুঃখের বিষয়, তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই আর ফিরে আসে না। 

এভাবে মেধা পাচার হতে থাকলে দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাবে অথচ সরকার এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের পেছনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। এক তথ্যে জানা যায়, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করে পাঁচ লাখ টাকা, একজন বুয়েটের শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করে ১০ লাখ টাকা আর একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তাদের পেছনে এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে জনগণের কষ্টার্জিত ঘামের টাকায়। অথচ মেধা পাচারের সুফল ভোগ করছে উন্নত বিশ্ব। 

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অনুন্নত বিশ্ব থেকে ১০ লাখ মেধাবী, দক্ষ, কারিগরি ও পেশাদার ব্যক্তি গ্রহণ করেছে। বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে একটি জরিপ ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। উক্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ বিদেশে পাড়ি জমাতে পছন্দ করে। 

এই সমীক্ষায় প্রতীয়মান হয় দেশের একটি বিরাট অংশ ধরেই নেন তাদের মেধা, সৃষ্টিশীলতা ও যোগ্যতার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন এ দেশে সম্ভব নয়। তাই তারা নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দেয়াটা বেছে নেয় যেন তাদের মেধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। সম্ভাবনাময় এই প্রজন্মকে হারিয়ে স্বদেশের উন্নয়নের যাত্রায় ধাক্কা, অগ্রগতিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 

২০২১ সালের ওপেন ডোর রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জের এক তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ৫৯৮ জন বাংলাদেশিকে স্টাডি পারমিট দিয়েছে এবং এটি ২০০৯ সালের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। এফএসিডি-ক্যাব বলছে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বৃত্তি পাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। 

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রায় ২৪ হাজার ১১২ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায় এবং ২০২০ সালে এ সংখ্যা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ হিসাবে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার জন্য ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায়। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রতি ব্যাচের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীই বিদেশে চলে যায়। তাদের খুব কিয়দাংশই দেশে ফিরে আসে। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বুয়েটের ১১৮ জন শিক্ষক বিদেশে গেলেও ফিরেছেন মাত্র ৩৮ জন। 

এদিকে বিশ্বিবদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ জন শিক্ষক অবৈধভাবে দেশের বাইরে ছিলেন। তারা ছয় বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন ভাতা গ্রহণ করেছেন ঠিকই অথচ তারা বিনা বেতনে বিদেশে থাকার অনুমতি চেয়ে আবেদনও করেননি। তবে ২০২০ সালে ১০৩ জন শিক্ষক বিনা বেতনে বিদেশে ছিলেন। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি ছাড়া বিদেশে থাকায় ৫২ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একই অভিযোগে ১৯৭২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮০ জন শিক্ষককে অব্যাহতি দিয়েছে। 

তবে এসব অভিবাসীরা দেশে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠালেও অনেকে একে ‘ব্রেইন ড্রেন’ বা মেধা পাচার বলে অভিহিত করেন। তারা রেমিট্যান্সে পর্যাপ্ত অবদান রাখলেও তাদের শূন্যতার কারণে দেশে উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের অভাব শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করলে দেশ ও জাতি নানাভাবে উপকৃত হতে পারে।

মেধা পাচারের কারণগুলো খুঁজতে গেলে দেখা যায় মেধা পাচারের সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেকেই একটি সুস্থ ও উন্নত জীবন-যাপনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়, তবে আমাদের শিক্ষার্থীরা যে প্রত্যেকেই এই আশায় দেশ ছাড়ে তা বলা যায় না। আমরা অনেক সময়ই তাদের কটাক্ষ করে বলে থাকি, তারা স্বার্থপর ও দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। 

দেশের টাকা খরচ করে তারা বিদেশে সুখের জীবনযাপন করছে, কিন্তু তা পুরোপুরি সঠিক নয়। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীই হতাশ হয়ে দেশ ছাড়ে। একটা অসুস্থ সিস্টেমের জন্য অনেকেই দেশ ছাড়ে। অনেকেই বারবার চাকরির চেষ্টা করে যখন মেধা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পায় না তখন বাধ্য হয়ে তাদের দেশ থেকে দূরে বসবাস করতে হয়। আবার আমাদের দেশে জব সেক্টরগুলোর ভিন্নতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক অনেক বিভাগ খুললেও আমরা কাজের বৈচিত্র্যতা আনতে পারিনি। 

তাই কাজের সুযোগ না পেয়েও অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমায়। স্বাধীনতার এত বছর পর বিজ্ঞানের তেমন কোনো উন্নতি ছাড়াই আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশগামী হচ্ছে বেশি করে। কারণ তাদের যে কর্মক্ষেত্রের সুযোগ দরকার, তা দেশে নেই বললেই চলে। 

আবার বিপরীত দিকে যারা বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরত আসতে চায়, তারা আসার পর নানারকম জটিলতার সম্মুখীন হয়। অনেকেই দেশে ফিরে এলেও তারা আর কর্মক্ষেত্রে তেমন সুযোগ পায় না। কারণ, যে সেক্টরে তারা পড়াশোনা করেছে তা দেশে অপ্রতুল। তাই তারা আবার বিদেশে ফেরত যায়। আমাদের দেশে চাকরি পেতে হলে তোষামোদকারী হতে হয় যেটা অনেকেরই পছন্দ নয়। সে জন্য তারা দেশ ছেড়ে অন্য দেশের স্থায়ী নাগরিক হয়। 

সত্যিকারভাবে মেধা পাচার বন্ধে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে মেধাবীদের দেশে যথাযথ মূল্যায়নে এখনই সচেতন হতে হবে। এ দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের দেশের কল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে। বৃদ্ধি করতে হবে গবেষণা খাতে বরাদ্দ। বিজ্ঞানীদের বেতনসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। 

বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতাকে সম্মান ও পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। সর্বোপরি দেশের মেধাকে দেশেই কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে যেন তাদের মেধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং দেশের অগ্রযাত্রায় তারা ভূমিকা রাখতে পারে। একটি মেধাহীন জাতিতে পরিণত হওয়ার আগেই উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। 

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক, সতিশ সরকার রোড, গেন্ডারিয়া, ঢাকা
 

Link copied!