Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪,

আত্মহত্যা রোধে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস

জুন ৩০, ২০২২, ০১:৫৯ পিএম


আত্মহত্যা রোধে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা
ছবি-প্রতীকী

বর্তমানে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তুচ্ছ ব্যাপার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা হতাশা থেকে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। আত্মহত্যার আগে তারা মনে করে, আত্মহত্যার মাঝেই রয়েছে সকল সমস্যা থেকে মুক্তির শ্রেষ্ঠ পথ। তাই বস্তুত নিজের মনের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে একটি মারাত্মক ভুল করে বসেন আত্মহত্যাকারীরা। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও আকুলতা মানুষের চিরন্তন সহজাত প্রবণতা। 

পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার উদগ্র বাসনায় মানুষ কত কিছুই না করছে! অথচ যারা আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথকে বেছে নেয়, তারা যে কতটা বোকার স্বর্গে বাস করেছে তা অনুমান করা দুঃসাধ্য। হয়তো আত্মহত্যাকারীর দুঃখ-বেদনা, হতাশা সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি, তাই বলে কি নিজেকে বিসর্জন দেয়া? 

এর থেকে দুঃখজনক কি-বা হতে পারে। সমাজের মানুষের স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন, সুন্দর পৃথিবীর মায়া-মমতা ও সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন ত্যাগ করে এক শ্রেণির মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে গলায় রসি দিয়ে, বিষপান করে, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে ও অন্যান্য নানা অপকৌশলে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যা করছে। 

তবে তার থেকেও অশনি বিষয় হলো এর মধ্যে দেশে এবং পৃথিবীজুড়ে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এ পথে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। যেসকল তরুণ প্রজন্মরা আগামী দেশ এবং পৃথিবীতে নতুন দ্বার উন্মোচন করার কথা তারাই নাকি ঠুনকো বিষয়েও এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছেন সহজে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। 

ধারণা করা হয়, যে সময়ে একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, ঠিক তখনই আরও ২০ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বব্যাপী ১৫-২৯ বছর বয়স্ক ব্যক্তিদের মৃত্যুর জন্য আত্মহত্যা দ্বিতীয় বৃহৎ কারণ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। 

গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের পরিমাণ বেশি। দেশের প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংখ্যাটি পেয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন। আঁচলের হিসাবে, ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অর্নাস কলেজের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননের এই ভয়াবহ প্রবণতা নতুন কিছু নয়। 

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো আগেকার সময়ে প্রেম-ভালোবাসা বা মাদকাসক্তি থেকে আত্মহননের কথা শোনা গেলেও এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারণটা ভিন্ন বরং সামপ্রতিককালে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, অপমানবোধ আর নিজের মধ্যে হতাশা থেকেই শিক্ষার্থীরা এমন করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এছাড়া সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, দেশে তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর চাকরি না পাওয়া, জীবনের প্রতি হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মতো ব্যবহার, পরিবারের প্রত্যাশা মেটাতে না পারার হতাশা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের অর্জনের খবরের সাথে নিজেদের অর্জনের তুলনা করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষন্নতা ও হতাশার হার বাড়ছে- যেই বিষন্নতা ও হতাশা এক সময় তাদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে। যদি ধরে নেয়া হয়, ডিপ্রেশন বা মানসিক চাপের কারণেই আত্মহত্যা বাড়ছে, তাহলে বলতে হবে কেন ডিপ্রেশনে ভোগে মানুষ? 

বিশেষজ্ঞদের মতে ডিপ্রেশন হচ্ছে সেই রোগ যেটি মূলত চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্যের কারণে সৃষ্টি হয়। এটি অনেকটা সামাজিক আর পারিবারিকভাবে সৃষ্ট। ‘অমুকের ছেলের এই রেজাল্ট, তোর এরকম কেন?’ ‘অমুকের দুটো গাড়ি, আমাদের নেই কেন?’ ‘আমার কী নেই যে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল?’ হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয় এভাবে। সেখান থেকেও ঘটে আত্মহত্যা। আরেকটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বাংলাদেশে অবস্থিত এক লাখ ২৪ হাজারের বেশি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে একজন করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থাকা দরকার। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই যা নেই। কাজেই শিক্ষকদের সতর্ক থাকতে হবে। 

শিক্ষার্থীদের আনন্দের মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে। তাদের আচরণ হতে হবে শিক্ষার্থীবান্ধব। সার্বিক বিষয়ে বিশ্লেষণ করলে আমরা সাধারণত দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা দেখতে পাই। এক. আগে থেকে পরিকল্পনা করে, আয়োজন করে, সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন অনেকে। যেটাকে বলা হয় ডিসিসিভ সুইসাইড। দুই. হুট করে আবেগের রাশ টানতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলেন অনেকে, যেটাকে বলা হয় ইমপালসিভ সুইসাইড। ডিসিসিভ সুইসাইড যারা করেন, তারা আগে থেকেই কিন্তু আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। এ ধরনের মানুষ আত্মহননের আগে যেভাবে সেটা প্রকাশ করেন, তার মধ্যে আছে—

এক. তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। 

দুই. আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক কবিতা-গান লিখতে, শুনতে বা পড়তে থাকেন।

তিন. নিজের ক্ষতি করেন। প্রায়ই এরা নিজের হাত-পা কাটেন, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খান।

চার. মনমরা হয়ে থাকা, সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী ভাবা— এগুলো বিষন্নতার লক্ষণ; যা থেকে আত্মহত্যা ঘটে।

পাঁচ. মাদকাসক্তি বা ইন্টারনেটে মাত্রারিক্ত আসক্তি আত্মহত্যায় সহায়তা করে।

ছয়. সারা রাত জেগে থাকা আর সারা দিন ঘুমানো।

সাত. নিজেকে গুটিয়ে রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়া।

আট. পড়ালেখা, খেলাধুলা, শখের বিষয় থেকে নিজে দূরে থাকা। তবে আত্মহত্যা মহাপাপ। আইনের দৃষ্টিতেও অপরাধ। পৃথিবীর সব ধর্মে এবং নৈতিকতায় আত্মহত্যার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। তাহলে মানুষ কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? 

আত্মহত্যা নির্মূল বা কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা রয়েছে। আইন, বিধি ও নীতিমালাও রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে পারে। 

আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

 পাশাপাশি বিষন্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্ত করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে আর পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকেও সব সময় অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে চলা উচিত।

 প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। 

আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি সার্বক্ষণিক হটলাইন এখন সময়ের দাবি। আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই আত্মহত্যা ঠেকানো যায়। এ জন্য সবাইকে যার যার ক্ষেত্র থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!