অক্টোবর ২১, ২০২১, ০৭:১০ পিএম
বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি জনগণের আয় বাড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি খাদ্য চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেবল পরিমাণে নয়, গুণ-মানেও উন্নত খাদ্য চাইছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। তারা ভাতের সাথে ডাল-সবজি-মাছ-ডিম-মাংস-দুধ-ফল চাইবে। জনগণের বহুমুখী চাহিদা জমি থেকেই পূরণ করতে হবে।
আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের নগর ও যোগাযোগ অবকাঠামো সমপ্রসারিত হতে থাকবে। কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এ ধরনের সুবিধা বেড়ে চলবে। গ্রামের তুলনায় শহরবাসীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য চাপ পড়ছে জমির ওপর। তাই কৃষিজমি সুরক্ষার বিকল্প নেই। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনের খসড়া হয় ২০১১ সালে।
এরপর ১০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু চূড়ান্ত হয়নি কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন। বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষিজমি সুরক্ষিত করে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় খাল কেটে মরুভূমিতে ফসল ফলানো হচ্ছে।
ভিয়েতনামে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে জমির ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে কৃষিজমি রক্ষা করা হচ্ছে। এর বিপরীতে প্রকৃতিগতভাবে আমাদের দেশ কৃষি উপযোগী এবং কোনো ধরনের চাষ ছাড়াই বীজ ফেলে রাখলে গাছ জন্মে যায়। কোনো কোনো জমিতে বছরে দুবারের অধিক ফসল ফলানো যায়। এমন উর্বর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।
অথচ বছরের পর বছর ধরে প্রকৃতির এ অপার দান স্বেচ্ছায় বিনষ্ট করা হচ্ছে। যেখানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত ফসল রপ্তানি করার অপার সুযোগ রয়েছে, সেখানে কৃষিজমি ধ্বংসের এ প্রক্রিয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশে ভূমি অনুযায়ী লোকসংখ্যা অনেক বেশি। প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বাড়লেও, কৃষিজমি ১ শতাংশ বাড়ছে না।
বরং মোট আয়তনের ১ শতাংশ জমি কমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সমুদ্রে দ্বীপ এবং নদীতে চর জেগে ওঠার কথা শোনা গেলেও সেগুলো কবে চাষযোগ্য হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ফলে আমাদের বিদ্যমান কৃষিজমির দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। এসব জমি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে সংকট যে তীব্র হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিজমি সুরক্ষার কোনো আইন নেই ভাবতেই অবাক লাগে। যে যার মতো করে কৃষিজমিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। জমির শ্রেণিকরণ না থাকায় চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কৃষি ও শিল্পের জমি। জমির সিএস, আরএস বা বিআরএসে কোথাও উল্লেখ নেই যে জমিটি কৃষিজমি না অন্য কোনো জমি। জমির ধরনে যেটা উল্লেখ থাকে সেটি হলো নামা, বিল, উঁচু বা কান্দা, বাড়ি ইত্যাদি। জমির সর্বশেষ যে মাঠ পর্চাটি বাংলাদেশ সরকার তৈরি করেছে যেটি বিআরএস নামে পরিচিত, সেখানেও জমিকে ভূমির বন্ধুরতা অনুযায়ী শ্রেণিকরণ করা হয়েছে, জমির উপযোগিতা বিবেচনা করে নয়।
এতে একজন কোম্পানির মালিককে কৃষিজমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। এসব কোম্পানি কৃষিজমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে বিশাল অঞ্চলজুড়ে কৃষি পরিবেশ নষ্ট করছে। রাসায়নিক দূষণের ফলে শিল্প-কারখানার আশপাশের কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা স্থায়ীভাবে হ্রাস পাচ্ছে। রাতারাতি নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা ভরাট করে কৃষিজমির স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব বন্ধ করতে হবে।
কৃষিজমি রক্ষায় সরকারকে সুনির্দিষ্ট আইন দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এক যুগ ধরে কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ঝুলিয়ে রাখার অর্থ হচ্ছে, কৃষিজমিকে হারিয়ে যেতে দেয়া। এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে দেশ খাদ্যে উৎপাদন বাড়ছে, তবে যেভাবে অলক্ষ্যে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে, তাতে সংকট দেখা দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশের মানুষের খাদ্য সংস্থান যে জমি থেকে হয়, তা রক্ষায় সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।