Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪,

মিটার ছাড়া দরকষাকষিতে অবাধে চলছে অটোরিকশা

মার্চ ৫, ২০১৫, ০২:৩৮ পিএম


মিটার ছাড়া দরকষাকষিতে অবাধে চলছে অটোরিকশা

 

কিবরিয়া নামে একজন যাত্রী প্রায় আধাঘন্টা ধরে অটোরিকশা খুঁজছেন রামপুরা যাবেন। কিন্তু চালকদের সাথে দারকষাকষিতে কোনভাবেই দর ঠিক হচ্ছেনা। ভিক্টোরিয়া থেকে রামপুরা যেতে ভাড়া চাচ্ছে ৪০০ টাকা।

একপর্যায়ে যাত্রী কিবরিয়া তালেব নামে একজন ট্রাফিক পুলিশের আশ্রয় নিলেন। তালেব নিজেও কয়েকজন চালককে বললেন কিছুটা কম ভাড়ায় যেতে। কিন্তু সে বলে, ‘ভাই আমাদেরকে তো জমা বেশি দিতে হয়। কি করবো বলেন? কম টাকায় যেতে পারিনা। তাছাড়া রাস্তায় অনেক জ্যাম। যেতে সময় লাগবে দুই ঘন্টা।’

 এভাবে কয়েকজনকে অনুরোধ করার পর একজন চালকের উপর ট্রাফিক পুলিশ তালেব চড়াও হয়ে গেলেন। হাতে থাকা কাঠের বাটাম দিয়ে মারতে গেলেন। পরে মাত্র ২০০ টাকায় যেতে রাজি হলেন চালক।

এই ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার দুপুরে পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে অটোরিকশা স্ট্যান্ডে।

এভাবেই মিটার ছাড়া দরকষাকষির মাধ্যমে অবাধে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলেছে রাজধানীর রাস্তায়। বর্তমানে এটি নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর জনসাধারণ অটোরিকশায় যাতায়াত করতে গেলেই চরম দূর্ভোগের শিকার হচ্ছেন অহরহ। অটোরিকশাতে মিটার প্রতিস্থাপন করা থাকলেও রাজধানীর প্রায় ৯৫ ভাগই যাতায়াতে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে ইচ্ছামত।

এছাড়া সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনও কোনও অটোরিকশাতে মিটারই বসানো নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের(বিআরটিএ) নীতিমালা অনুযায়ী মিটার ছাড়া সিএনজিচালিত অটোরিকশা যাত্রী বহন করতে পারবে না। মিটার ছাড়া তা রাস্তায় বেরও করা যাবে না। এটি সম্পূর্নভাবে অবৈধ্য।

কোন চালক এই অবৈধ্য পথ অবলম্বন করে যাত্রী বহন করলে সেই চালকের জন্য জরিমানা সহ গাড়িটি জব্দ এবং মালিকের নামে মামলা করার বিধান রয়েছে। গুলিস্তান মোড়ে সিএনজির জন্য অপেক্ষাকারী বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা রত্না বললেন, ‘গত এক ঘণ্টা ধরে সিএনজি খুঁজছি। দেখতেই পাচ্ছেন এখানে কতগুলো সিএনজি। কিন্তু কেউ যাবে না। যত টাকা চাইবে তত টাকা দিলেই কেবল তারা রাজি। মিটারের কথা বললে উল্টো শুনতে হয় ঢাকায় কি নতুন আসছেন নাকি?’ এমনটিই বলেন রত্না। ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই নারীর প্রশ্ন, ‘তাহলে কি সিএনজি চালকদের কাছে ঢাকার বাসিন্দা হওয়ার সার্টিফিকেট দিতে হবে? এমনিতেই সবক্ষেত্রে আমরা জিম্মি।

এখন সিএনজি চালকদের দৌরাত্মে খুব অসহায় মনে হয়।’ মিটারে না যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সব চালকের মুখে একই কথা, ‘সিএনজি মালিকের জমার টাকা বেশি। পেট চলেনা।’ অটোরিকশা চালক মো. বাবুল বলেন, ‘আমি এক বেলা গাড়ি চালাই, আমাকে এর জন্য ৯’শ টাকা জমা দিতে হয়। অফিসের সময়, এ সময় জ্যাম বেশি, মিটারে গেলে পোষাবে না। এজন্য চুক্তিতে যাব।’ পাশে দাঁড়ানো রত্না তখন বলে উঠেন, ‘এমন একটা অবস্থা হয়েছে যেখানেই যান না কেন, ভাড়া চাইবে ২’শ টাকা। এর নিচে কোন ভাড়া নেই। তার উপরে সিএনজিতে বসার পরে চালকরা বলবে, সার্জেন্ট ধরলে মিটারের কথা বইলেন।’ কথা হল সমির নামের একজন অটোরিকশা চালকের সাথেও।

তিনি বলেন, ‘আমাদের জমার টাকা অনেক বেশি। মালিক আমাদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা জমা রাখে। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে যা পায় তাতে সংসার চলে না। যদি মিটার হিসেবে চলি তাহলে তো না জমার টাকায় উঠবে না।’ দরকষাকষি করে যাত্রী বহন করলে পুলিশ ধরে না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যাত্রীকে আগে থেকেই বলে দেই ট্রাফিক জিগাইলে বলবেন মিটারে যাচ্ছি। যাত্রী নিজেও হয়রানির হাত থেকে রেহায় পেতে মিথ্যা কথা বলে দেয়। যাত্রীরা সত্য কথা বললে কিভাবে হয়রানি হয় ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সত্য কথা বললে তো আমাকে পুলিশে আটকাইবো তখন তো যাত্রীও যেখানে যেতে চাই সেখানে যেতে পারবেনা। এটা তো তার একপ্রকার  হয়রানি।

তাছাড়া আমাদেরকে ধরলে পুলিশ আমাদের কাছ ৫‘শ থেকে ১ হাজার টাকা নেয়।’ সাধারণত কোন কোন স্থানে আপানাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়? তিনি বলেন নিউমার্কেট, আজিমপুর, গুলিস্তান, যাত্রবাড়ী, শ্যামলী, গাবতলী, সায়দাবাদ ছাড়াও আরও অনেক এলাকা থেকে পুলিশ এভাবে টাকা নেয়।

এ ব্যাপারে গুলিস্তান মোড়ে কর্তব্যরত সেলিম নামে একজন ট্রাফিক পুলিশের কাজে জিজ্ঞসা করলে, তিনি এটি সম্পূর্ন অস্বিকার করেন। তিবি বলেন, ‘অন্তত আমি এ ধরনের কাজ করিনা তাছাড়া কেউ এমন করে কি না তাও জানিনা।’ এই বিষয়ে জানতে ট্রাফিক (দক্ষিণ) বিভাগের ধানমন্ডি জোনের সহকারি কমিশনার (এসি, ট্রাফিক) হাসান মোস্তফা স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘মিটার ছাড়া সিএনজি চলাচল আমার নজরে পড়েনি। এই অভিযোগের সঙ্গে আমি একমত নই। আমি নিশ্চিতভাবে বলছি- আমার এলাকাতে মিটার ছাড়া অবৈধভাবে সিএনজি চলাচল করে বলে কোনো তথ্য আমরা এখনও পাইনি। তবে তথ্য পেলে বা এমন কোনো সিএনজি নজরে পড়লে অবশ্যই তার মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

মতিঝিলের ৩৫টি সিএনজির মালিক আব্দুর রশিদকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘এখন সিএনজির দাম বেশি। একটি গাড়ি একদিন ভাড়া দিলে পরের দিন বসিয়ে রাখতে হয়। কারণ একদিন চালানোর পরে গাড়ির অনেক সমস্যা দেখা দেয়। সেগুলো সারাই করে পরেরদিন আবার বের করি। এইসব কারণে আমাদের জমার টাকা একটু বেশি নিতে হয়। তবে আমি নেই ৬’শ থেকে ৭’শ টাকা। আমি অন্যদের মত ১ হাজার টাকা নেই না।’ সিএনজি অটোরিকশার কারণে ভোগান্তির বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (প্রশাসন) মো. মশিয়ার রহমান বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় রাস্তায় আমাদের তিনটি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে থাকি। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। চালকরা বিভিন্ন সময় মালিকদের বিষয়ে অভিযোগ তোলেন।

 কিন্তু যখন অভিযান চলে তখন কেউ কোনো কথা বলতে চান না। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় করেও অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন।’ মিটারে যেতে না চাওয়া অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযানের সময় যাত্রীদের ‘অসহযোগিতা’ পাওয়ার কথাও বলেন তিনি। জানা জায়, বায়ু দূষণের হাত থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে চলতি বছরের শুরুতে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা তুলে দিয়ে রাজধানীতে চার স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। চালকদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকা জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, ‘অটোরিকশাগুলো যে মিটারে চলে না এর জন্য সরকারের পলিসির ভুল রয়েছে। যখন এগুলো রাস্তায় নামানো হয়, সে সময় এগুলোর ইকোনমিক লাইফ (আয়ুস্কাল) ছিল ৯ বছর। তখন সরকার জমা নির্ধারণ করেছিল ৬’শ টাকা। কিন্তু এখন বেশি নেয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

ভাড়া: সর্বশেষ গত বছরের ৪ নভেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় চালক-মালিকদের চাপে রাজধানী ঢাকায় চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া ও মালিকের জমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ভাড়া ধার্য করা হয়েছে ২৫ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৭ টাকা। মালিকের দৈনিক জমা করা হয়েছে ৬’শ টাকা। প্রতি মিনিট অপেক্ষার (যানজট, যাত্রাবিরতি ও সিগন্যাল) জন্য এক টাকা ২৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ১৪ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৬ টাকা নির্ধারিত আছে।

 প্রতি মিনিট অপেক্ষার জন্য নির্ধারিত আছে এক টাকা। মালিকের জমা ৪৫০ টাকা। মিটার অনুযায়ী ঢাকায় যেকোনো গন্তব্যে যেতে হবে, মিটারের বাইরে ভাড়া নেওয়া যাবে না, মিটার কারসাজি (টেম্পারিং) না করা, চালকের কাছ থেকে নির্ধারিত হারের বেশি জমা আদায় না করা ইত্যাদি নিয়ম করা আছে। এসব সিদ্ধান্ত মানার বিষয়ে মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, বিআরটিএ এবং পুলিশের মধ্যে ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে যৌথ চুক্তিনামা সই হয়েছে গত বছরের ৯ জানুয়ারি। কোনও অটোরিকশাচালক এসব সিদ্ধান্ত না মানলে যাত্রীদের পুলিশকে ফোন করতে বলা হয়েছে। পুলিশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে বলে জানানো হয়েছে। ফোন নম্বর অটোরিকশার গায়ে লেখা আছে।