Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

না ফেরার দেশে রুপা, বাঁচিবে কেমনে নার্গিস?

মার্চ ১৫, ২০১৫, ০৬:০৯ এএম


না ফেরার দেশে রুপা, বাঁচিবে কেমনে নার্গিস?

 

পৃথিবীতে যত ধাতব পদার্থ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে দামী পদার্থ হীরা। তবে দামী হলেও হীরার নিজস্ব স্বত্তা বলতে তেমন কিছুই নেই। হীরা যেন একটি পরাশ্রয়ী ধাতব পদার্থ অর্থাৎ অন্য ধাতব পদার্থ ছাড়া তার কোন মূল্য নেই। হীরা দিয়ে কারিগর কখনও এককভাবে কোন অলঙ্কার বানাতে পারেনা। হীরাকে জাহির করতে হলে প্রয়োজন হয় সোনা নতুবা রূপা নতুবা তামা, নতুবা পিতল।

 যে নিজে ব্যবহৃত হতে পারেনা এককভাবে তার আবার কী মূল্য? পাশাপাশি সোনা, রূপা কম দামী হলেও তা দিয়ে অন্য ধাতব পদার্থ মিশিয়ে তাকে গোপন রেখে দামী গহনা তৈরী করা যায়। যাকে বলে খাঁদ। খাঁদ দিলেও সোনা রূপা অন্যের উপর ভর করে কারো দেহে সোভা বর্ধন করেনা। সোনার কদর তাইতো হীরার চেয়েও বেশী। তাই বলে চকচকে ধাতু রূপাকে আপনি অবহেলা বা অবমূল্যায়ন করতে পারবেন না। রূপাও কখনও কখনও নিজ গুণে গুণান্বিত হয়ে ওঠে।

যত কিছুই থাক না কেন রূপার যেন আলাদা কদর। রূপা দিয়ে তৈরী নুপুর পায়ে পরে যখন কোন অষ্টাদশী কিশোরী আটপৌরে শাড়ি পরে, আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে ক্ষেতের আইল দিয়ে লাফাতে লাফাতে যায় তখন নুপুরের শব্দে দুরন্ত কিশোরীর যে সৌন্দর্য আঁছড়ে আঁছড়ে পড়ে তা দেখে কি কেউ কবি না হয়ে আছে? নাকি আছে বিশ্ব প্রেমিক না হয়ে? প্রিয় পাঠক, এখানেই কি রূপার কারিশমা শেষ? এখানেই শেষ নয়। রূপা ছাড়া শ্বাশ্বত বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্যকে কি তুলে ধরা সম্ভব? আমি অন্তত বলি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের একটি ছায়াছবির বিখ্যাত গানের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই প্রিয় পাঠককে। গানটি এমন-“ও আমার রসিয়া বন্ধুরে তুই কেন কোমরের বিছা হইলি না, কাছে কাছে রাখিতাম, জড়াইয়া রাখিতাম, কোনদিন দূরে যেতে দিতাম না..না..নারে”।

কী আবেদন কী রোমান্স এই গানে! কোমরে রুপার বিছা শ্বাশ্বত বাঙালি নারীর কোমরে ৬০ এর দশক পর্যন্ত দেখা গেছে।  নতুন বিয়ে হলেই আগেই দেওয়া হতো কোমরের বিছা যা তৈরী হতো রুপা দিয়ে। এ ছাড়া মোঘল আমলে রুপার বিছা এবং হাতে বাঁজুবন্ধ পরানো হতো শাহী বাঈজি খানায়। বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিল রাজা বাদশা আমলে নর্তকীদের নৃত্য প্রদর্শন। সুন্দরী, সুশ্রী মেয়েদেরকে ধরে ধরে নাচ শিখিয়ে তাদের নাচ উপভোগ করতেন স¤্রাট এবং বাদশারা। পায়ে থাকত রূপার নুপুর, হাতে রূপার বাঁজুবন্ধ, কোমরে বিছা, চুলের খোঁপায় পরা হতো ইংরেজী ইউ আকৃতির রূপার কাঁটা। যার মাথায় ছোট ছোট রুপার বল লাগানো হতো। কোন বাঈজির শরীরে সোনার গহনা পরানো হতোনা কারণ সোনা ছিল বেশ দামী পক্ষান্তরে রুপা ছিল সস্তা এবং সহজলভ্য। বর্তমানে রূপার ব্যবহার নাই বললেই চলে তবে পায়ে পরার জন্য রূপার তৈরী নুপুর প্রচলিত আছে।

ছেলেরা এখনও হাতে রুপার আংটি ব্যাবহার করে থাকে। সত্তদর দশকের দিকেও মেয়েদের পায়ের আঙুলে আংটি পরা দেখা গেছে তবে বর্তমানে তা বিরল। সোনার চেয়ে রুপার দাম ৯৫ ভাগ কম কিন্ত এমন এক রূপা আছে যা খুবই মূল্যবান। সে রূপা হোকনা সাদা হোক না কালো। সে রূপার মূল্য কত তা একজন মা ভাল বলতে পারবেন। মায়ের কাছে সে রূপা অমূল্য সম্পদ। প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়ত এতক্ষণে প্রশ্ন করে বসেছেন কী সেই রূপা, কেমন রূপা যে রূপার দাম কত তা একজন মাই বলতে পারেন?

প্রিয় পাঠক, একটি রূপার দলা নয় একজন রূপার গল্প শোনাব আজ আপনাদেরকে। যে রূপা পাওয়া যায় একজন মায়ের কাছে থাকা অমূল্য খনি ‘মাতৃ গর্ভে’। মাতৃ গর্ভ নামের এই খনিতেইতো একজন রূপার জন্ম। যে রূপা দিয়ে একজন প্রধানমন্ত্রী বানানো যায়, একজন, স্পীকার বানানো যায়, ডাক্তার বানানো যায়, প্রকৌশলী থেকে বৈমানিক, বিজ্ঞানী বানানো যায়। যে রূপা দিয়ে একজন বিচারক, হাকিম বানানো যায়। সর্বোপরি সেই রূপা দিয়ে বানানো যায় একজন বধূ এবং একজন মা, একজন দাদী। বানানো যায় সেই রূপা দিয়ে একজন নানী। প্রিয় পাঠক, সেই নানী সানিয়া বানুর সাথে করে জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে বাসে গাজীপুর যাচ্ছিল মরিয়ম আক্তার রূপা বয়স ৫ বছর। এই রূপা সেই রূপা, যে- রূপা হলেও মা নার্গীস আক্তারের কাছে সোনা-দানা-দামী গহনা-হীরা-মুক্তার চেয়েও দামী ছিল। নাড়ি ছেড়া ধন এই রূপা।

রূপার বাবা আব্দুল মতিন খোকন ২ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন। রূপাকে মানুষের মত মানুষ গড়ার মানসে বিধবা গার্মেন্টস কর্মী নার্গীস আক্তার দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, বড় কঠিন এক হিসাব সেই রূপা লুট হয়ে গেল চিরদিনের মত। চলে গেল বিধবা মায়ের বুক খালি করে, ঘর উজাড় করে, হৃদয় খানখান করে না ফেরার দেশে। যে মা একজন রূপাকে হীরের টুকরো বানানোর জন্য দ্বিতীয় বার বিয়েও করেন নি। কী মহান এহেন আত্ম ত্যাগ, কী অপূর্ব চেতনাবোধ যে দ্বিতীয় বিয়ে করলে হয়ত রূপাকে নামী দামী করে গড়ে তোলা যাবেনা। কিন্তু কে জানত রূপা একদিন পুড়ে খাাঁটি সোনা না হয়ে অঙ্গার হয়ে চলে যাবে কবরে। যেখানে কালের ব্যবধানে মিশে যাবে রূপার অস্তিত্ব। একদিন রূপার কথা মুছে যাবে স্মৃতি থেকে।

 কিন্তু হতভাগী মা, গভধারিনী নার্গীস আক্তার কি কখনও কোনদিন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পারবে কি রূপাকে ভুলে থাকতে? যে রূপাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে যেয়ে ২য় বিয়ে না করে নিজের ভরা যৌবনকে বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই  নার্গীস কি পারবেন বাকি দিনগুলি একা একা কাটাতে?  রূপা নেই, যার জন্যে বিশাল আত্মত্যাগ সেই রূপাই যখন চলে গেল তখন কি আর থাকা সম্ভব  হবে নার্গীসের একা পথ চলা? সম্ভব হবে না কারণ কোন অবলম্বনই থাকল না নার্গীসের। প্রিয় পাঠক, দীর্ঘ ৬৭ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল ভুতেরা পেট্রল বোমা মেরেই চলেছে। পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে স্বপ্ন, পুড়ছে সম্পদ। আগে মানুষেরা অপরাধ করতো কিন্তু সে ধারা পাল্টে বর্তমানে ভুতেরা ছুঁড়ে মারছে পেট্রল বোমা। তাইতো ভুতকে থামানো যাচ্ছে না।

 সেই ভুতেরা গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯ টার দিকে গাজীপুর ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এর সামনে একটি বাসে পেট্রল বোমা ছোড়ে এবং যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরে যায়। সেই অগুনে পুড়ে যায় নিষ্পাপ মরিয়ম আক্তার রূপা। রূপার শরীর ৪৫ ভাগ পুড়ে যায়। অবস্থা ভাল না থাকায় আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল রূপাকে আইসিইউতে নিবীড় পরিচর্যায় রাখেন। ডাঃ পার্থ দীর্ঘ ৩৫ দিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেন রূপাকে বাঁচাতে। কিন্তু সব প্রচেষ্টাকে ব্যার্থ করে দিয়ে রূপা মাকে ফাঁকি দিয়ে অতি দ্রুতযানে  চড়ে চলে গেল না ফেরার দেশে গত ১১ই মার্চ। রূপা আর কখনও মা বলে ডাকবেনা, খেলবেনা সহপাঠিদের সাথে নানা খেলা। রূপা জয়দেবপুর বোরদা মুসলিমবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।

গত ১১ই মার্চ রূপা সকল হিসাব নিকাস চুকিয়ে চলে গেল চিরদিনের মত কিন্তু রেখে গেল একটি কষ্ট, একটি আর্তনাদ, একটি অভিশাপ। রূপা নানীর সাথে আসছিল। নানীও বিমূঢ়।  আজ সকলের একটিই প্রশ্ন আর কতদিন ভুতের ছোড়া পেট্রল বোমায় পুড়ে মরতে হবে নিষ্পাপ নিরাপরাধ মানুষকে? যদি মানুষে বোমা ছুঁড়ত তাহলে বার্ন ইউনিট সম্পর্কে ধারনা হতো তাহলে হয়তো আর পেট্রল বোমা ছুঁড়ে মারত না। কিন্তু বোমা মারছে ভুতে। ভুত যখন বোমা মারতে  পারে তাহলে নিশ্চয় তাদের হাত-পা, হৃদয়, কলিজা আছে? তা না হলে কি সম্ভব হতো বোমায় পুড়িয়ে মানুষ মারতে? কি অপূর্ব আন্দোলন চলছে সরকার পতনের জন্য! একটি স্বাধীন দেশে এমন নৈরাজ্য হবে আগে জানলে কেউই মুক্তি যুদ্ধে যেত না। এ পর্যন্ত ১৩ জন শিশু পেট্রল বোমায় পুড়ে ছাঁই হয়ে গেল।

যে সকল মা তাদের সন্তান হারিয়েছেন তারাই বলতে পারবেন এমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দিয়ে রাজ্য জয় করা যাবে কিনা? পেট্রল বোমা সংস্কৃতি একদিন বন্ধ ঠিকই হবে তবে সেদিন হয়তো ঐ সব ভুতের পরিণতি হবে ভীষণ ভয়ঙ্কর। বিবেকের দংশনে নীল হয়ে যাবে বোমাবাজদের শরীর। ১৬ কোটি মানুষ কোনদিনই হয়তো দেখতে পারবে না কখনই প্রকৃত বোমা নিক্ষেপকারীদের। হয়ত দেখতে  পারবে না তাদের করুণ পরিণতি। তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে নার্গীস আক্তারের কী অবস্থা? কী ভাবে বেঁচে আছে একজন সন্তান হারা মা? বড় আজব এক জাতিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমরা মানুষ হত্যা করছি জবাই  করে, হত্যা করছি জীবন্ত পুড়িয়ে, আমরা হত্যা করছি পেট্রল বোমা ছুঁড়ে, আমরা হত্যা করছি গুলি করে, চাকু মেরে। আমরা হত্যা করছি সড়ক দুর্ঘটনা দিয়ে। থামছেনা কোন মতে মৃত্যুর মিছিল, থামছেনা ভয়ঙ্করতা, থামছেনা নিষ্ঠুরতা।

 তবুও চলছে মানুষ নিয়তির উপর ভরসা করে। ঘরে ফিরতেও পারে  নাও পারে। এমন আতঙ্কে কাটছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন বাঙালি জাতির। বড় অপূর্ব আমাদের কপাল যে স্বাধীনতার পর থেকে আমরা জ্বলেই চলেছি, পুড়েই চলেছি, কেঁদেই চলেছি, মরেই চলেছি। তাই সবশেষে একটি কথায় বলতে হয়-‘ক্ষমা কর হে প্রভু’। পৃথিবীতে আগুনে পুড়িয়ে শিশু হত্যার নিদর্শন আছে বলে হয় না। আন্দোলনের ৬৭ দিন পার হলেও এত গুলো দিন খুব স্বস্তিতে ১৬ কোটি মানুষ পার করেনি। শঙ্কার ভিতরে থেকে দেশ জাতিকে কখনও সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই ভুতদের কাছে অনুরোধ করবো ভুত বাবা আপনারা এবার খান্ত দেন এমন নিষ্ঠুর কাজ।