Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বেঁচে থাকার খাদ্যই মৃত্যুর কারণ

মার্চ ১৫, ২০১৫, ০১:৫৯ পিএম


বেঁচে থাকার খাদ্যই মৃত্যুর কারণ

 

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরীসিম। ক্ষুধা নিবারনের জন্যই মানুষ পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু যে খাদ্য খেয়ে মানুষ বাঁচবে সেই খাদ্য খেয়ে আজ মানুষ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করছে। দেশের সর্বত্রই চলছে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য সামগ্রী বাজারজাতকরণের চেষ্টা। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি খাদ্যেই ভেজাল। আর এই ভেজাল খাদ্য এক ধরনের বিষ।

অথচ জীবনধারনের পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্য। তাই নিরুপায় হয়েই জেনেশুনে নগদ টাকায় এ বিষ কিনে খাচ্ছে অসহায় মানুষ। নিরাপদ খাদ্য প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫নং ধারায় এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বহীনতা এবং আইনের দুর্বলতার কারণে এই অধিকার পূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে (ক্রেতা) মানুষ। ভেজাল খাদ্য নাগরিক জীবনে বড় রকমের ভীতি তৈরি করেছে। এমন বাস্তবতায়  রোববার পালিত হল বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘স্বাস্থ্যকর খাদ্য ভোক্তার অধিকার’।

জানা গেছে, ভেজাল নিয়ন্ত্রণে দেশে এখন পর্যন্ত ১৬টি আইন তৈরি হয়েছে। ভেজাল নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ খাদ্য আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, বিশেষ নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব আইন প্রয়োগের জন্য রয়েছে বেশ কিছু সংস্থা। বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, মেট্রোপলিটন পুলিশ, ওষুধ প্রশাসন, উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বিভাগ, আণবিক শক্তি কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এসব আইন প্রয়োগের।

এ বিষয়ে বিশেজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল বিরোধী অভিযানের স্বল্পতা, কম শাস্তির বিধান এবং কিছুক্ষেত্রে জনবল সংকটের কারণে সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হচ্ছে। আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থাকার পরও আইনের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর দেশকে ভেজালের কাছে অসহায় করে রেখেছে ঘাতক অপরাধীরা।

বিভিন্ন আইনে জরিমানার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে সংশোধিত ১৯৫৯ সালের ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ’ অনুসারে, খাদ্য ভেজাল করার সাজা সর্বোচ্চ এক বছর সশ্রম কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড। ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদন্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের কথা। সর্বশেষ ২০১৩ সালের আইনে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের কথা বলা হয়েছে। অথচ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ)-এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজালকারীদের মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা ছিল। কিন্তু এ আইন আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হচ্ছে না। এটা নিশ্চিত করতে যে ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সে দায়িত্ব পালন করছে না সরকারি সংস্থাগুলো।’ সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান আইন অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে নিরাপদ খাদ্য ও ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’

এ ব্যাপারে কৃষি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে কোনো সরকারই ১৯৭৪ সালের খাদ্য আইন প্রয়োগ করতে চায় না। ফলে লাখ লাখ টাকা লাভের মধ্যে সামান্য কয়েক হাজার টাকা জরিমানাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না।’

সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বিদ্যমান আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে দায়িত্ববানদের রয়েছে অনীহা। ১৯৫৯ সালের ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ’ ২০০৫ সালে সরকার বেশ উৎসাহের সঙ্গে সংশোধন করে। সংশোধিত আইনে খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগ, খাদ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তদারকি করা ও জেলায় জেলায় খাদ্য আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো ঢাকা ছাড়া আর কোথাও খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। এরপর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সব আইন মিলিয়ে ‘মাদার ল’ হিসেবে ২০১৩ সালে তৈরি করা হয় ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’। ছয় বছর আগে ‘ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ তৈরি হয়। কিন্তু এখনো এ-সংক্রান্ত বিধি তৈরি হয়নি। ফলে আইনটি কার্যকর করা যাচ্ছে না।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ বাড়ছে। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড তিন কোটি ৮১ লাখ টন খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয়েছে। মন্ত্রণালয় দাবি করছে, চলতি অর্থবছরে খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে রয়েছে দেশ। প্রতিবছর কৃষি জমি কমে যাওয়ার পরও খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি বর্তমান সরকারের একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে দেশের দরিদ্র মানুষের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এ কর্মসূচির আওতায়  দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় নিয়ে এসেছে। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৩০ শতাংশে বেশি। কিন্তু খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে না পারায় সরকারের এসব সাফল্যের সুফল আসছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, আইন বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বরাবরই বলে আসছে। তাদের দাবি, ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া গেলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ পাওয়া যায় না। তাই অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে। বিএসটিআই সূত্র জানায়, ‘এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শুক্র ও শনিবার অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। পরর্বতিতে সেই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা যায়নি।

 ফলে প্রতিনিয়ত নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।’ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল খাবার খেয়ে ভোক্তারা আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যান্সার, স্নায়ুবিক গোলযোগ, এলার্জি, শ্বাসকষ্ট, জ-িস, টাইফয়েড, গ্যাস্ট্রিক, মস্তিষ্ক ও হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি ও প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি, অঙ্গহানি ও বিষন্নতাসহ নানা গুরুতর রোগব্যাধিতে। এছাড়া ভেজাল খাবার গ্রহণের ফলে খাদ্যে অরুচি সৃষ্টি, এমনকি আলসারের মতো রোগব্যাধি হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রক্তকণিকার স্বাভাবিক বৃদ্ধি। যার ফলে থ্যালাসেমিয়া ও লিউকেমিয়ার মতো মারাত্মক ব্যাধিও দেখা দিতে পারে। হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সার।