Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

গরুর দুধ নকল হচ্ছে, অসহায় ক্রেতারা

মার্চ ২২, ২০১৫, ০৬:০৩ এএম


গরুর দুধ নকল হচ্ছে, অসহায় ক্রেতারা

 

সৃষ্টির সেরা নেয়ামতের অভাব নেই। কোনটিকে বাদ দিয়ে কোনটিকে আপনি খাটো করে দেখবেন? অসংখ্য স্বাস্থ্য সম্মত নেয়ামত দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা তার মধ্যে প্রথমেই যেটি মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য তা হলো খাদ্য সামগ্রী। শুধু খাদ্য সামগ্রী দিয়েই কি উপরওয়ালা খান্ত হয়েছেন? হয়নি। মানব দেহের উপকার এবং কল্যাণের কথা ভেবে, সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে প্রত্যেকটি খাবারের ভেতরে দিয়েছেন বিভিন্ন ধরণের স্বাদ, গন্ধ। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দিয়েছেন পুষ্টি তথা নিউট্রিশন, ভিটামিন তথা খাদ্য প্রাণ। সুখাদ্যের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা সেরা এক খাদ্য হিসেবে আমাদেরকে দান করেছেন দুধ। দুধ এমন একটি খাদ্য, এমন একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য যার গুণাবলী এবং উপকারিতা বলে শেষ করা যাবেনা।

 মানব দেহ এবং পশু দেহে দুধের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তার মধ্যে মাতৃ দুগ্ধ সবচেয়ে শক্তিশালী, উপকারি এবং স্বাস্থ্যকর। মায়ের দুধ পান করেই আজ আমরা লালিত। মায়ের দুধের কোন বিকল্প করে পৃথিবীতে কোন খাবার পাঠাননি সৃষ্টিকর্তা। মায়ের দুধ সবচেয়ে শক্তিশালী এবং রোগ প্রতিরোধোক। মায়ের দুধের শাল দুধকে বিজ্ঞানীরা বলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং পুষ্টিকর। সেই শাল দুধ খেয়েই একটি শিশুর দুনিয়ার জীবন শুরু। মায়ের দুধের বিকল্প  নেই, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী ‘শাল দুধ’। যে সকল শিশুরা শাল দুধ খেতে পায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী। কিন্তু মা যদি নিয়মিত ভেজাল খাবার খায় তা হলে কি শিশুর জন্য কল্যাণকর বা মঙ্গলজনক হবে? পাঠক এ প্রশ্নের জবাব পরবর্তীতে দেব তার আগে আমরা জ্ঞানার্জনের জন্য  আলোচনা করব দুধ নিয়ে।

 দুধ পৃথিবীর একটি মৌলিক এবং শক্তিশালী তরল খাবার। যার তুলনা করা যাবেনা অন্য খাবারের সাথে। দুধ নিয়ে আলোচনা অল্পতে হয়না তথাপি আমরা দুধ নিয়ে এবং দুধের অপব্যবহার নিয়ে আলোচনা করব। পৃথিবীতে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে আমরা মাত্র কয়েকটি প্রাণীর দুধ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পান করে থাকি এবং দুগ্ধজাত খাবার প্রস্তুত করে থাকি। দুধের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবেনা। এ  দেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যেমন-“আমার ছেলে যেন থাকে দুধে-ভাতে”। এটি শুধু প্রবাদ নয়। এর ভেতরে আছে দোয়া, আশীর্বাদ। দুধ যেন সুখী মানুষেরা খায়, দুধ খেলে শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকে এমন ধারণা এ দেশে ইদানিংকালের মানুষের নয়। এ ধারণা পাঁচ হাজার বছর ধরে প্রচলিত। প্রখ্যাত গুণী মহিয়ষী রমণী খনা বলে গেছেন -“মাংসে মাংস বাড়ে, শাকে বাড়ে মল, ঘিতে বুদ্ধি বাড়ে, দুধে বাড়ে বল”। কাাঁসার বাটিতে দুই-এক সের দুধ না  খেলে এক সময় চলত না। আর এখন সে বাস্তবতা শুধু যেন রূপ কথার গল্প। আমাদের শিশু খাদ্যের মধ্যে প্রথমেই যোগ হয় দুধ। গরুর দুধে সাগু-বার্লি মিশিয়ে একসময় মায়েরা বাবুদেরকে খাওয়াতেন। বর্তমানে সাগু-বার্লি কোন শিশুই চোখে দেখেছে বলে মনে হয় না। নেই  সেই সাগু বার্লি, নেই কাঁসার ঝিনুক। মায়ের হাতে কাঁসার ঝিনুকে গড়গড়িয়ে দুধ খাওয়ানোর যে চিত্র তা আর কখনই ফিরে আসবেনা। নেই এমন দৃশ্যের কোন চিত্র জাতীয় জাদুঘরে। কিন্তু সেই চিত্র এখনও আমাদের অন্তরে গেঁথে আছে।

বর্তমানে মায়ের হাতের ঝিনুকে খাওয়া পদ্ধতির বদলে এসেছে ফিডার। যা শিশু স্বাস্থ্যের জন্য বড়ই হমকি স্বরূপ। দুধ-সাগু-বার্লিতে  যে পরিমাণ শক্তি আছে তা কি বর্তমানের কৌটার দুধে আছে বলে মনে হয়? কখনই না। কারণ বেশীর ভাগ আমদানীকৃত কৌটার দুধে নেই মাখন, নেই ঘি, নেই ল্যাক্টোজ। আছে ম্যালামিন। যার জন্য বর্তমানের অধিকাংশ শিশুর স্বাস্থ্য রোগাটে, পাতলা, শুকনা। প্রিয় পাঠক, আমরা সাধারণতঃ মায়ের দুধ খেয়ে গড়ে তুলি ভিত তথা ফাউন্ডেশন আর গৃহপালিত পশুর দুধ খেয়ে আমরা অর্জন করি দীর্ঘায়ু। এ ছাড়াও অর্জন করি  নিরোগ হয়ে, সবল হয়ে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি। আমরা সাধারণত গরু, ছাগল, দুম্বা এবং উটের দুধ সরাসরি পান করি আবার বিবিধ খাদ্য সামগ্রী তৈরী করে খাই। দুধ থেকে আমরা পাই ঘি, মাখন, সর, ঘোল, ছানা, ননি, ক্ষির ইত্যাদি। দুধের এক স্বাদ আবার দুধের গর্ভে জন্মানো উপরের সামগ্রীর মজা এবং স্বাদ আরো লোভনীয়।

 পৃথিবীর এমন কোন খাদ্য নেই যার গর্ভে বহুবিধ শক্তিশালী খাদ্য সামগ্রী উৎপাদিত হয়। খাঁটি দুধের পায়েস, ঘিয়ে ভাজা লুচি, মাখন দিয়ে গরম পাউরিুটি, সর দিয়ে গরম রুটি, ননি দিয়ে বিরিয়ানি, ছানা দিয়ে পেড়া সন্দেশ, কাঁচা গোল্লা, রসমালায়, রাজভোগ, পানতোয়ার সাদ কি অন্য কোন খাদ্য সামগ্রীতে মিলবে? অসম্ভব? কখনই সম্ভব নয়। তাছাড়া নববিবাহিত স্বামীকে রাতে গরম দুধ দিতে ভুল করে কি শাশুড়ি?  ছানা ছাড়া রসগোল্লা কল্পনায় করা যায় না। আর সেই রসগোল্লা ছাড়া কি কখনও আত্মিয়তা চলে? চলেনা। আগে নেওয়া হতো মাটির হাড়িতে মিষ্টি, বর্তমানে কাগজের প্যাকেট। তবে মাটির হাড়িতে রসগোল্লা মানে প্রকৃত বাঙালিয়ানা। নতুন মাটির হাড়িতে রসগোল্লা ভরলে মাটির সেদো গন্ধে রসগোল্লার স্বাদ হয়ে উঠতো অন্য রকম। যার ঘ্রাণ বাস্তবিকই স্বর্গীয় ছিল। কিন্ত সেখান থেকে আমরা যেন আজ হাজার বছর পিছিয়ে। দুধ দিয়ে তৈরী গামছা পাতা দই ছাড়া কি কোন মেহমানদারি সম্ভব? দই ছাড়া কি খাওয়ায় তৃপ্তি আসে পরিপূর্ণ? আসেনা। কিন্তু সেই দুধকে আমরা খাদ্য থেকে রুপান্তরিত করে ফেলেছি বিষে।

এখন দুধ মানেই বিষ, দুধ মানেই মৃত্যুর এক হাতিয়ার, দুধ যেন বর্তমানে সক্রেটিসের হাতে তুলে দেওয়া মিষ্ট হেমলক। যে হেমলক খেতে সুস্বাধু কিন্তু প্রাণঘাতি। বিখ্যাত-প্রখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসকে হত্যা করা হয়েছিল হেমলক দিয়ে। হেমলক মধুর মত মিষ্টি বিষ যা মধুর মত চেটে খাওয়া যায়। সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য সক্রেটিসকে বাটি ভরে দেওয়া হয়েছিল হেমলক। যখন হেমলক খাওয়া হবে তখন কেউই বুঝতে পারবেনা এটি বিষ। খাওয়ার পর ধীরে ধীরে এর বিষক্রিয়া শুরু হবে এবং একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। প্রিয় পাঠক, সেই হেমলকের মত বিষ এখন আমাদেরকে নিয়মিত খাওয়াচ্ছে কুখ্যাত মোনাফেক, নিমক হারাম, জাতীয় বেঈমান, জাতির কলঙ্ক এক শ্রেণীর কুলাঙ্গার সন্তানরা। কুলাঙ্গার এবং জারজ কতিপয় বাঙালি সন্তান মোনাফার লোভে কেউ কেউ মেশাচ্ছে ফরমালিন আবার কেউ কেউ তৈরী করছে নকল দুধ।

দুধে একসময় ভেজাল দিত পানি দিয়ে। বর্তমানে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে ফরমালিন দিয়ে যা হেমলকের মত ধীরে ধীরে মানব সন্তানকে হত্যা করছে। এদেরকে আপনি বলতে পারেন নির্দি¦ধায় নরপশু, হায়েনা, খুনী। প্রিয় পাঠক, দুধ সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব নেয়ামত যার গুণ এবং উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবেনা। তাছাড়া এমন কোন লোক নেই যিনি দুধের উপকারিতা সম্পর্কে জানেন না। দুধ একটি মিশ্র বা যৌগিক পদার্থ। অনেক গুলো মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে দুধ আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন। যেমন দুধে আছে- ১) পানি ২) ল্যাকটোজ ৩) চর্বি বা ফ্যাট ৪) আমিষ বা প্রোটিন ৫) খনিজ পদার্থ বা মিনারেলস্ ৬) খাদ্য প্রাণ বা ভিটামিন ৭) এবং অন্যান্য পদার্থ। যার প্রতিটি উপাদান নির্দিষ্ট একটি মাত্রায় প্রয়োগ করেছেন আল্লাহ পাক আমাদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। কিন্তু সেই অপূর্ব নেয়ামত দুধ এখন এক  শ্রেণীর পাপিষ্ট, নালায়েক, কুলাঙ্গার তৈরী করছে নকল দুধ। তাতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর সব বস্তু দিয়ে। যা ভাবতে গেলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন। বলবেন এটা কি করে সম্ভব একজন সুস্থ্য মানুষের পক্ষে? দুর্নীতিবাজ মানুষ কখনও মানুষ হতে পারে না। তারা প্রকৃতপক্ষে অমানুষ এবং সাক্ষাৎ জমদূত। আসুন আমরা জেনে রাখি কী কী দ্রব্য দিয়ে কুলাঙ্গার নর পিশাচরা নকল দুধ তৈরী করে ভাল দুধের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করছে। প্যাকেট হুবহু একরকম। কিন্তু তার মধ্যে ভরে দিচ্ছে নকল দুধ।

এই নকল দুধ খেয়ে কি একজন শিশু কি সুস্থ্য থাকবে? সেই শিশু কি মেধাবী হয়ে বড় হবে নাকি প্রতিবন্ধী হয়ে বেড়ে উঠবে? এর জবাব আপনারাই দিতে পারবেন। কিন্তু আইন তাদেরকে কিছুই করতে পারছেনা। একদিকে জরিমানা করছে অন্য দিকে আবার প্রোডাকশন করে বাজারে ছাড়ছে। কেউ যদি সৎ না হয় তাহলে সামান্য হাতে গোনা পুলিশ দিয়ে কি বিশাল সমাজ পাহারা দেওয়া সম্ভব? সম্ভব হতো যদি ভেজাল এবং নকল দুধ প্রস্তকারীদেরকে ধরে দু-পাঁচট কে ফাঁসি দেওয়া যেতো প্রকাশ্যে। তাহলে হয়ত কমতো কিছুটা নকল দুধ তৈরী। শিশু খাদ্যে যারা ভেজাল মেশায় এবং নকল দুধ তৈরী করে থাকে তাদের জন্য একটায় শাস্তি মৃত্যু দন্ড। কিন্তু কে দেবে এই মৃত্যু দন্ড? নকল দুধ তৈরী করা হয়- আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, এ্যারারুট, বরিক পাউডার, ইউরিয়া সার, চিনি, সোডিয়াম বেনজোনেট, ফরমালিন, দুষিত পানি, রঙ ওি স্কম মিল্ক বা পাউডার দুধ। এই নকল দুধ খেয়ে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ছে। কিডনির নেফরোটিংসিটি লিভারের হেম্পাটোটোস্কিন সহ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে।

 প্রিয় পাঠক, এই নকল দুধ বেশী বেশী তৈরী হচ্ছে পাবনা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ১৩ টি গ্রামে। এই কৃত্রিম নকল দুধ ভালো কোন ব্রান্ডের নকল প্যাকেটে করে সরবরাহ করা হচ্ছে বিভন্ন দোকানে। তবে নকল দুধের সবচেয়ে বড় মার্কেট ঢাকাতে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার একটি মাত্র পথ তা হলো আইনের আওতায় এনে গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এ জাতি পরিণত হয়ে যাবে অসুস্থ্য এবং প্রতিবন্ধী জাতিতে। সেই সাথে আসুন আমরা হয়ে উঠি সচেতন। বিগত ১৮ই মার্চ-২০১৫ ইং তারিখে ব্রাজিলের বিজ্ঞানীদের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে মায়ের বুকের দুধ বুদ্ধিমত্তা বাড়ায়। কিন্তু প্রিয় পাঠক, মায়ের বুকের দুধ কি খাঁটি না কি ভেজাল? এমন প্রশ্নের উত্তরও আপনারা নিজেরাই জানতে পারবেন। যেমন মা খাচ্ছে ফরমালিন, কেমিকেল মেশানো নানাবিধ খাবার। যে খাবারে মেষানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত ৩০০ কেমিকেল। সেই মায়ের বুকের দুধ কি খাঁটি থাকতে পারে? নাকি বিষাক্ত হয়ে গেল? বিজ্ঞানীরা বলছেন বর্তমানে যে সকল কেমিকেল খাচ্ছে মানুষ তার অস্তিত্ব মরার ২০ বছর পরেও পাওয়া যাবে। এর পরেও কি আমরা কেমিকেল মুক্ত খাবার কিনব নাকি ভেজাল এবং নকল দুধের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলব। মহান স্বাধীনতার মাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের একটি বাক্য ভীষণ মনে পড়ছে-“তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো”। আমার মনে হচ্ছে দীর্ঘ ৪৪ বছর পর এই ভাষণের আদেশ যেন সময়োপযোগী। বিক্রেতারা বনে যাচ্ছে কোটিপতি, বিত্তশালী, ক্রেতারা হয়ে পড়েছে অসহায়। মৌমাছির মত যেন ছুটে আসছে দলে দলে! তাই বলতে হচ্ছে দুঃখ করে-‘হে বাঙালি পালাবি কোথায়’?