Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

রোগীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না চিকিৎসা সেবা

মার্চ ৩১, ২০১৫, ১২:৪২ পিএম


রোগীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না চিকিৎসা সেবা

 ঢাকায় সরকারী, বেসরকারী মিলিয়ে হাসপাতালের সংখ্যা অনেক। রাজধানী হওয়ার কারণে দেশের উন্নত চিকিৎসা সেবাটা এখানেই পাওয়া যায়। কেবল ঢাকাবাসীরাই নন, প্রতিদিনই ঢাকার বাইরে থেকে বহু রোগী এখানে আসেন চিকিৎসার জন্য। সরকারী হাসপাতালগুলোয় বেড এবং কেবিনের সংকটের চিত্র চিরচেনা। দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি চিকিৎসা সেবার মান। হাসপাতাল আছে, যন্ত্রপাতি ওষুধপথ্যের সরবরাহ যাচ্ছে নিয়মিত, আছে চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী; শুধু নেই কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসকের বদলে নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়াসহ দালালরা চিকিৎসার নামে অসহায় রোগীদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। সরকারি স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার অবহেলার সুযোগে প্রাইভেট কিনিক ও চিকিৎসকের অযথা টেস্ট করানোর প্রবণতাকে পুঁজি করে সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে প্রতিনিয়তই চিকিৎসার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে কাড়িকাড়ি অর্থ।

 তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীরা কেবিন এবং বেড পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রাধিকার পান। তবে সেগুলো পেতে হলে খরচ করতে হয় অনেক অর্থ। অন্যদিকে বেসরকারী হাসপাতালগুলোয় বেড এবং কেবিনের সংকট সাধারণত থাকে না। তবে খরচটা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। সাধারণভাবে যেকোন চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (সাবেক পিজি হাসপাতাল), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মিডফোর্ট হাসপাতালসহ বড় সরকারি হাসপাতালগুলোয় যান। অবশ্য বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালও রয়েছে ঢাকায় এগুলোর মধ্যে শিশু হাসপাতাল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, কিডনী এন্ড ইউরোলজি ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।

বর্তমানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে বড় বড় বেশ কয়েকটি হাসপাতাল হয়েছে দেশে। এসব হাসপাতালের মধ্যে এ্যাপোলো হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাব এইড হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল, মেডিনোভা হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।

এদিকে রাজধানীর দুই সিটিতে বসবাসকারী জনগণ প্রায় দেড় কোটিরও বেশি। ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি মিলিয়ে নিজস্ব দুটি হাসপাতাল ও ১টি মাতৃসদন কেন্দ্র আছে। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু কমিউনিটি কিনিকও পরিচালিত হচ্ছে। এসব জায়গায় প্রধানত মা ও শিশুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়। নগরীর অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে উপচেপড়া ভিড় থাকলেও রোগীর অভাবে অধিকাংশ সময় ওই সব হাসপাতালের অর্ধেকের বেশি শয্যা খালি পড়ে থাকে। দুই কর্পোরেশনের নারী, মা ও শিশুর চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এনজিও পরিচালিত ১০টি মাতৃসদন ও ৫৫ টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থাও বেহাল। সব শ্রেণীর নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্মিত হলেও উন্নত সেবা না পাওয়ায় কর্পোরেশনের হাসপাতাল, মাতৃসদন ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো কেবল গরিব ও নিম্নবিত্তের সেবাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেবার মান এতটাই খারাপ যে কোন উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত লোক সেবা গ্রহণে যেতে রাজি হন না।

নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য গত ২৬ বছরে (১৯৮৯, ১৯৯০ ও ২০০১ সাল) মাত্র ২ টি হাসপাতাল ও ১ টি মাতৃসদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে অবিভক্ত ডিসিসি। যেগুলো বর্তমানে ডিএসসিসির আওতাধীন। বিশ্বের সব দেশেই নগরে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল দায়িত্ব নগর কর্তৃপক্ষের। সেই অনুযায়ী রাজধানীর মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির। অথচ দেড় কোটিরও বেশি মানুষের বিপরীতে দুই কর্পোরেশনের নিজস্ব মোট চিকিৎসক আছে মাত্র ৪৯ জন। অর্থাৎ রাজধানীর প্রতি ৩ লাখ মানুষের বিপরীতে দুই কর্পোরেশনের নিজস্ব চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। যে উদ্দেশ্যে রাজধানীতে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়া হয়েছিল তাও ব্যর্থ হতে চলেছে। দুই কর্পোরেশনের ৯২ টি ওয়ার্ডের মধ্যে এ ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে মাত্র ৪২টিতে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের আহ্বায়ক করে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি থাকার নিয়ম রয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে চারজন ডিপ্লোমা চিকিৎসক, চারজন সার্ভিস প্রমোটর ও চারজন বহিরাঙ্গনকর্মী থাকার কথা। তবে নির্বাচিত কাউন্সিলর না থাকায় প্রতিটি ওয়ার্ড কমিটির কার্যক্রমই বর্তমানে বন্ধ। ছয়টি এনজিও পরিচালিত ৬৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে দুই বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে ১০টি। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সেবাদান কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশ ওমেন্স হেলথ কোয়ালিশন নামের একটি এনজিওকে বাদ দেয়া হয়েছে।

 এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, সীমিত জনবল নিয়ে ডিএসসিসি অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে যাচ্ছে। নানা সীমাবদ্ধতার পরও চিকিৎসা সেবা বাড়াতে সম্প্রতি ডিএসসিসি অন্তর্গত দুটি হাসপাতাল ও ১টি মাতৃসদন কেন্দ্রে মোট ১৪ জন চিকিৎসক ও ২৬ জন নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হাসপাতাল ও সদনটিতে আউটডোরে সেবা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাছাড়া শিশু হাসপাতালের বর্তমান সেবার মান আগের যে কোনো সময়ে চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে হাসপাতালগুলোতে ইনডোর সেবার মান বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। সেবা বাড়াতে আমাদের নতুন করে আরও চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনায় অতিষ্ঠ হয়ে নগরবাসি এখন ভালো চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, কিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ধরনা দিচ্ছে।

অপর দিকে রাজধানীর অভিজাত হাসপাতাল-কিনিকগুলোর বিরুদ্ধেই অবহেলা, ভুল চিকিৎসা আর পদে পদে রোগী হয়রানির সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিজেদের আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান দাবি করে একশ্রেণীর বেসরকারি হাসপাতাল রোগীদের থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সেসব স্থানে রোগীদের রীতিমতো জিম্মি করেই মুক্তিপণ স্টাইলে টাকা আদায় করা হয়ে থাকে। সাধারণ জ্বর বা পেটব্যথা নিয়ে কোনো রোগী হাজির হলেও কয়েক ডজন টেস্ট, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অপারেশন করাসহ জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে উল্টো রোগীকে পাঠিয়ে দেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। আর এর প্রতিটি ধাপেই চলে টাকা আদায়ের ধান্দা। চিকিৎসকদের কিনিক-বাণিজ্য, নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে পাঠানো, নিম্নমানের ওষুধ চালিয়ে দেয়ার জন্য কমিশন নেয়া, অযথা টেস্ট করানোর অধিক প্রবণতা চিকিৎসা-ব্যবস্থাকে করে তুলেছে আরও শোচনীয়। এর পরও উপায়ান্তরহীন রোগীরা বারবার যেতে বাধ্য হচ্ছেন এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে।